খবরা-খবর
কাওয়াখালি-পোড়াঝাড় জমি আন্দোলন কোন পথে
Kawakhali-Porajhar

শিলিগুড়ি সন্নিহিত কাওয়াখালি পোড়াঝাড় অঞ্চলের প্রায় ৩০২ একর জমি থেকে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে ২০০৪ সালে জনস্বার্থের ট্যাগ লাগিয়ে সেখানকার মানুষদের উচ্ছেদ করা হয়েছিল। এরমধ্যে এক বড় অংশই অনিচ্ছুক কৃষক পরিবার। কিন্তু কিছু ইচ্ছুক পরিবার এককালীন ক্ষতিপূরণ পেলেও তৎকালীন সরকার যখন মুখে জনস্বার্থের কথা বলে উপনগরী তৈরিতে হাত দেয় তখন থেকেই ক্রমশ আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। এরই মধ্যে তৈরি হয় কাওয়াখালি-পোড়াঝাড় ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি। ২০০৭ সালে আন্দোলনের ফলে সরকারের পক্ষ থেকে একটি উপদেষ্টা কমিটি তৈরির কথা হলেও সেখানে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির কোনো প্রতিনিধিদের রাখা হয়নি। নিম্ন আদালত এবং হাইকোর্টে মামলাও করা হয় অনিচ্ছুক কৃষক পরিবারগুলোর তরফ থেকে, কিন্ত সেই মামলা সম্ভবত অনেক মামলার ভিড়ে কার্যত হারিয়ে যেতে বসেছে। তবে বিষয়টি যেহেতু এখনও বিচারাধীন, ফলে প্রশ্ন থেকেই যায় কিভাবে একটি বিচারাধীন বিষয়কে সরিয়ে রেখে উপনগরীর কাজ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে?

অন্যদিকে কখনো কখনো থিতিয়ে গেলেও এতগুলো বছরে আন্দোলন কিন্তু অব্যাহত থেকেছে। ক্ষমতার পালাবদল হওয়ার পর তৃণমূল সরকারের এতগুলো বছরেও অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি। বরঞ্চ তৃণমূল সরকার এই জমি তুলে দিয়েছে নেওটিয়াদের হাতে, যে জমির বাজার মূল্য ৩৫৩ কোটি টাকা, সেখানে তারা মাত্র ৮৩ কোটি টাকায় তা কিনে নেয়। সরকার এখানে সাধারণ মানুষ, অনিচ্ছুক পরিবারগুলির স্বার্থ চিন্তা না করে কার্যত জমির দালালির ভূমিকা পালন করছে বলা যায়। এই অবস্থায় এলাকার অনিচ্ছুক মানুষদের আন্দোলন স্বাভাবিকভাবেই আরও তীব্র হয়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ে ভূমি প্রতিরোধ কমিটির সদস্য সহ এলাকার এক বড় অংশের মানুষেরা শিলিগুড়ি শহরে বিভিন্ন কর্মসূচি সংঘটিত করেছেন। বিভিন্ন পর্যায়ে কৃষক সংগঠন এআইকেএম, শ্রমিক সংগঠন এআইসিসিটিইউ সহ সিআইটিইউ, এআইকেএমএস, ইউটিইউসি সহ পিসিসি সিপিআই (এম-এল), সিপিআই (এম-এল) এনডি সকল প্রতিনিধিরা সংহতি কর্মসূচির শরিক। আলোচনা বৈঠক চলছে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কর্মপন্থা নিয়ে। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি মুখ্যমন্ত্রীর উত্তরবঙ্গ সফরের অজুহাত দেখিয়ে ১৩ জন আন্দোলনকারীকে পুলিশ জোর করে তুলে নিয়ে যায়। যেখানে মুখ্যমন্ত্রী বলছেন মানুষের সঙ্গে কথা না বলে রাজ্যের কোথাও বলপূর্বক জমি নেওয়া হবেনা, সেখানে পুলিশ (মুখ্যমন্ত্রী নিজেই আবার পুলিশমন্ত্রী) তাঁরই আসার অজুহাত দেখিয়ে আন্দোলনকারীদের গ্রেপ্তার করছে! এসব থেকে পরিস্কার ধরা পড়ে সরকারের উদ্দেশ্য। পূর্ব ঘোষণা মতোই ১৮ ফেব্রুয়ারি জমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি, এআইকেএম, এআইকেএস, সিআইটিইউ, ইউটিইউসি’র নেতৃত্বে বিশাল মিছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়াম গেট থেকে শুরু হয়ে এসজেডিএ অভিযানের উদ্দেশ্যে শিলিগুড়ি জংশন অভিমুখে রওনা দিলে এসজেডিএ অফিসের গেটে উপস্থিত বিশাল পুলিশ বাহিনী মিছিল আটকে দেয়। সকলে সেখানেই বসে পড়ে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে। সাফ জানিয়ে দেয় পুলিশ গ্রেপ্তার করলে করুক, তারা শেষ দেখে ছাড়বেন।

পরবর্তীতে আলোচনার মাধ্যমে সকলকে বুঝিয়ে এআইকেএমএ’র তরফে অভিজিৎ মজুমদার, সিআইটিইউ’র গৌতম ঘোষ, ইউটিইউসি’র তাপস গোস্বামী, এআইকেএমএস’এর অমল রায় এবং জমি উচ্ছেদ কমিটির দুজন প্রতিনিধির নেতৃত্বে ছ’জনের প্রতিনিধি দল এসজেডিএ আধিকারিককে স্মারকলিপি দেয়, দাবি জানানো হয় অবিলম্বে ডিএম-এসডিও সহ জমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির প্রতিনিধি এবং কৃষক ও শ্রমিক সংগঠনসমূহের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় বসে পুরো বিষয়টি পরিষ্কার করতে হবে। ইচ্ছুক জমিদাতাদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসন এবং পরিবারের অন্তত একজনকে চাকরি দিতে হবে, এবং অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ফিরিয়ে দিতে হবে। বিক্ষোভ চলাকালীন বক্তব্য রাখেন, এআইকেএম’এর পক্ষে অভিজিৎ মজুমদার, পবিত্র সিংহ, শ্রমিক কৃষক সংগ্রামী মঞ্চের রতন দে, ইউটিইউসি’র তাপস গোস্বামী, সিআইটিইউ’র গৌতম ঘোষ, এআইকেএমএস’এর অমল রায় সহ প্রতিরোধ কমিটির প্রতিনিধিরা। দাবি না মানা হলে আন্দোলন শিলিগুড়ির সীমানা ছাড়িয়ে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে যাবে সকলেই এই হুঁশিয়ারি দেন। যতদিন না সরকারের প্রতিনিধিরা বিষয়টি সম্পর্কে আলোচনায় বসছেন, ততদিন উপনগরীর কাজ বন্ধ রাখতে হবে।

আন্দোলনকারীদের আটদফা দাবি হল

১) অবিলম্বে অনিচ্ছুক জমির মালিকদের জমি ফেরত দিতে হবে।
২) সমস্ত ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৩) দীর্ঘদিন জমিতে কাজ করা আদিবাসী কৃষক, বর্গাদারদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৪) সমস্ত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের প্যাকেজ অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ ও অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষার বন্দোবস্ত করতে হবে।
৫) মামলা-যুক্ত জমির কেনাবেচা বন্ধ করতে হবে।
৬) পূর্বঘোষিত বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী অবিলম্বে উপদেষ্টা কমিটি তৈরি করতে হবে, উপদেষ্টা কমিটিতে জমিহারা ও ভূমিহারা রক্ষা কমিটির প্রতিনিধিকে উপদেষ্টা কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করে একমাসের মধ্যে উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক করতে হবে।
৭) প্রতিটি জমিহারা পরিবারকে অধিগ্রহণ সার্টিফিকেট দিতে হবে।
৮) সমস্ত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সরকারী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।

খণ্ড-29
সংখ্যা-8