সম্পাদকীয়
রুখতে হবে একসাথে
Must be stopped together_ed

তৃণমূল চলন-বলন-শরীরী ভাষায় বুঝিয়ে দিচ্ছে বিন্দুমাত্র কোনোরকম সমালোচনা বা বিরোধিতার তোয়াক্কা না করে স্বৈরাচারের পথ অনুসরণ করে চলার পক্ষপাতী। তার আরও একবার ন্যক্কারজনক প্রমাণ পাওয়া গেল সদ্য অনুষ্ঠিত এককালীন চার পুরনিগমের নির্বাচনে এবং কয়েকটি পুরসভা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দখল নেওয়ার মধ্যে। টিএমসি-র পৌর বিজয়রথজবরদস্তি ছোটানোর এটাই শুরু নয়। প্রথমবার এই অপরাধ করল তা নয়। যে কলকাতা মহানগরীকে দলনেত্রী ‘ঝাঁ চকচকে’ বিজ্ঞাপিত করতে শুরু করেছেন তার কর্পোরেশনও উপর্যুপরি কব্জায় আসা পুরোপুরি নিরামিষভাবে হয়নি। ‘কর্পো-ক্ষমতা’য় একদশক থাকা হয়ে যাওয়ার পরেও বর্ষা এলেই জীবন নরক করে তোলে পচা জল জমে থাকা পথঘাট, ঘরদুয়ার,হাটবাজার। উপরন্তু, মাঝেমধ্যেই গরিব-নিম্নবিত্তদের তাড়া করে পানীয় জলের সংকট। বঞ্চনার বিস্তারিত খতিয়ান জনমানসে রয়েছে। একটু কান পাতলেই শোনা যায়। সেই ট্র্যাডিশন চলছে সমানে। দুর্নীতি একেবারে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আজও ‘চোরপরেশন’ ব্যঙ্গ শুনতে হয়। টিএমসি কলকাতা কর্পোরেশন চালায় কর্পোরেট কায়দায়। কয়েক হাজার পদ শূন্য হয়ে রয়েছে, নিয়োগ হয় না, নিয়োগ না হওয়া মানে পরিষেবা প্রদানের পুঁজি বরাদ্দে ও পরিকাঠামোয় প্রবল সংকোচন। কিছু আপ্ত বাক্য আউরে নাগরিক সমাজকে ধোঁকা দেওয়া হয়। ‘পৌর উন্নয়নের’ ভাগ্য ঠিক করে দেওয়ার মালিক শাসকের দলতন্ত্র। পরিষেবা সরবরাহে ক্রমেই বাড়ছে আউটসোর্সিং বরাত, ঠিকেদার-ঠিকা চুক্তির সমীকরণ সর্বস্বতা। এতো সমস্যার মধ্যেও যে বিশাল আসন সংখ্যার ব্যবধানে সিএমসি জিতে নিয়েছে, এটা সম্ভব হয়েছে অন্য খেলা খেলে। তৃণমূল যেভাবে কলকাতা নির্বাচন সেরেছে, সেই ধারাতেই মরীয়া হচ্ছে — মরীয়া হবে বাকি সব পৌর নির্বাচন দখলে। দুটি পুরসভা জিতে নিয়েছে তথাকথিত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, চারটি পুরনিগমের দখল নিয়েছে মূলত সন্ত্রাসের অনেক কারসাজি করে — যেমন, জলের লাইন, বিদ্যুতের খুঁটি যাবে না, এই সুবিধা হবে না — ঐ সুবিধা পাবে না। বিজেপি’র ‘ডবল ইঞ্জিন’ ধারণাকে টিএমসি রাজ্য সরকার থেকে শুরু করে পঞ্চায়েত ও পৌরসভায় নিজের মতো করে চালাতে বেপরোয়া। তার জন্যই যাবতীয় পৌর ক্ষমতা বিরোধী শূন্য একচেটিয়া করে নিতে চাইছে। ধমকি-হুমকিতে বিরোধী প্রার্থীদের মনোনয়ন না দিতে, প্রত্যাহার করাতে বাধ্য করাই টিএমসি-র মূল প্রবণতা। এই প্রতিযোগিতায় উন্মত্ত করে তোলা হচ্ছে গোটা দলকে, করে দেখাতে পারলে ‘পুরস্কার’। ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে ঠিক এই মারমুখো আগ্রাসন চালিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন দলের বীরভূমের ‘বীর নেতা’। তার বিনিময়ে ‘বীরের’ শিরোপা পেয়েছিলেন দলনেত্রীর কাছ থেকে। এবার পৌর নির্বাচনের আগে সেই ডাকসাইটে মাথা তাঁর বিরুদ্ধে কোনও এক মামলায় হাইকোর্ট থেকে স্থগিতাদেশ জোগার করেই দলকে একের পর এক পৌর চ্যাম্পিয়ন করার ‘খেলা’ দেখাতে নেমেছেন। ‘পুরস্কার’ও মিলেছে দলের ‘জাতীয় কর্মসমিতি’তে পদোন্নতির। মমতা সরকার একদিকে এই সবই ‘মা-মাটি-মানুষের আশীর্বাদ’ বলে ধূর্তামি আর অন্যদিকে ‘নম্র ও দায়িত্বশীল’ হওয়ার লোকদেখানো ভন্ডামী করছে।

এরাজ্যের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ট্র্যাজেডি চলার এক বিশেষতা হল, একদিকে ফ্যাসিবাদী বিজেপির বিরোধিতার মহিমা আত্মসাৎ করতে অনেকবেশী সফল টিএমসি, সেই আবরণে স্বৈরাচার কায়েম করছে; অন্যদিকে, তৃণমূলের বিপরীতে বিজেপি এখনও প্রধান বিরোধী পক্ষের ভাবমূর্তি ধরে রাখতে পারছে, যদিও গত বিধানসভা নির্বাচনে উচ্চাকাঙ্খায় ধাক্কা খাওয়ার পর থেকে ক্রমশ জনবিচ্ছিন্নতা ও গোষ্ঠীভাঙনের মধ্য দিয়ে চলছে।

এহেন ট্র্যাজিক পরিস্থিতি আপনা আপনি পাল্টে যাবে না। এই অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার জন্য সব ধরনের বাম শক্তিসমূহকে দায় স্বীকার করতে হবে। সেসব নিয়ে অকপট আত্মানুসন্ধান, পর্যালোচনা, চিন্তাশীল স্বাস্থ্যকর তর্ক-বিতর্ক চলবে, চলুক। তবে বাম পুনরুজ্জীবনের চ্যালেঞ্জ নেওয়াকেই পাখীর চোখ করতে হবে। সেটা সম্ভব আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে প্রাথমিকতা দিয়ে। নিরন্তর জনগণের কাছে যাওয়া, জনগণকে সংগঠিত করা, সমাবেশিত করার ধারা সৃষ্টি করে। পরিস্থিতিতে আশার শর্তগুলো বিভিন্ন ইস্যুতে বিভিন্ন মাত্রায় বিকাশমান হচ্ছে। স্কুল শিক্ষায় শিক্ষক কর্মপ্রাথীদের লাগাতার আন্দোলন, যা যুব আন্দোলনেরই এক জীবন্ত রূপ, দেউচা-পাঁচামীর উচ্ছেদের আশঙ্কায় প্রতিবাদ শুরু আদিবাসী মানুষেরা, আক্রান্ত ছাত্রছাত্রী ও মহিলাদের রুখে দাঁড়ানো, এবং আরও কিছু সম্ভাবনা সৃষ্টি হচ্ছে। এই নতুন নতুন বিষয়গুলোতে নিছক হস্তক্ষেপের রাজনীতি নয়, আলোড়ন তোলার উদ্যোগ ও সক্রিয়তা প্রয়োজন। বাকি পৌরসভাগুলোর নির্বাচনও লড়ে যাওয়ার দাবি জানাচ্ছে।

খণ্ড-29
সংখ্যা-7