উড়িষ্যার ধিনকিয়ায় জবরদস্তি জমি গ্রাসের বিরুদ্ধে তদন্তকারী দল
CPIML Team Meets Protestors At Dhinkia

২৩ জানুয়ারি উড়িষ্যার জগৎসিংপুর জেলার ধিনকিয়া গ্রামে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের একটি টীম পরিদর্শনে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন রাস্তা থেকে কোর্ট পর্যন্ত গণ আন্দোলন করবে গ্রামবাসীদের ওপর পুলিশী উৎপীড়নের বিরুদ্ধে এবং গ্রামবাসীরাও আন্দোলন ও সংহতির জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

তদন্তকারী টিম দেখেছেন ধিনকিয়া গ্রামবাসীদের ওপর জেলা প্রশাসন ও পুলিশের মিলিত অত্যাচার অব্যাহত রয়েছে। প্রশাসন উচ্চ আদালতের নির্দেশ অমান্য করছে। প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র, রেশন ইত্যাদির প্রয়োজনে গ্রামের বাইরে যাওয়ার জন্য গ্রামবাসীদের পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে অনুমতি ভিক্ষা করতে হচ্ছে।

তদন্তকারী টীমে রয়েছেন সিপিআই(এমএল) বিধায়ক বিনোদ সিং (ঝাড়খণ্ড), মার্কসবাদী কো-অর্ডিনেশন কমিটি নেতা ও প্রাক্তন বিধায়ক অরূপ চ্যাটার্জী, আদিবাসী সংঘর্ষ মোর্চার জাতীয় আহ্বায়ক দেবকীনন্দন বেদিয়া, সিপিআই(এমএল) ওড়িশা রাজ্য কমিটির সদস্য ও শ্রমিক নেতা মহেন্দ্র পরিদা এবং মধুসূদন ও অন্যান্যরা। এঁদের নজরে এসেছে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে গ্রামবাসীদের ওপর পুলিশের পাশবিকতা। গ্রামবাসীরা বলেছেন, পুলিশ তাদের ওপর লাগাতার উৎপীড়ন করছে, লাঠি চার্জের ফলে মহিলা ও শিশুসহ কমপক্ষে ৪০ জন আহত হয়েছেন। উড়িষ্যা হাইকোর্ট এই ব্যাপারে অবগত হয়ে গত ২০ জানুয়ারি নির্দেশ দিয়েছেন এই অত্যাচার অবিলম্বে বন্ধ করতে ও স্বাস্থ্য পরিষেবা ও জনকল্যাণ কর্মসূচি পুনরায় চালু করার জন্য।

২৩ জানুয়ারি তদন্তকারী টীম গ্রামে পৌঁছে দেখেন উচ্চ পদাধিকারী পুলিশ অফিসাররা এক প্ল্যাটুন পুলিশ নিয়ে প্রতিবাদী স্থানীয় নেতাদের ঘিরে ফেলার আয়োজন করছে। নেতাদের থেকে টীম জানতে পারেন যে সেই দিনও তিনজন প্রতিবাদী নেতাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।

৬৫ বছরের এক বৃদ্ধা শান্তিলতা মালিককে প্রাতঃকৃত্যের সময় পুলিশ তাড়া করে এবং তিনি ভয়ে অর্ধনগ্ন অবস্থায় কাছের জঙ্গলে লুকিয়ে পড়েন। পরে পুলিশ তাঁকে হুমকি দেয় সামনে না এলে খারাপ ফল হবে। তদন্তকারী টিম পুলিশকে কড়া প্রশ্ন করেন এবং হাইকোর্টের আদেশনামা দেখান, বাধ্য হয়ে পুলিশ পিছু হটে।

পুলিশের আতঙ্ক কাটিয়ে ওঠার জন্য এবং গ্রামবাসীদের সংহত করার জন্য তদন্তকারী টিম গ্রামের ভিতর তাদের নিয়ে একটি মিছিল করেন। সেখানে পুলিশের অত্যাচার নিয়ে স্লোগান দেওয়া হয়। লুকিয়ে থাকা ভীত গ্রামবাসীরা একে একে বেরিয়ে আসেন ও সমাবেশে যোগ দেন।

হাইকোর্টের আদেশ সত্বেও পুলিশের অত্যাচার কমেনি। পুলিশী অত্যাচারে পানচাষিদের প্রভূত ক্ষতি হয়েছে। যাঁরা অভিযোগ দায়ের করেছিলেন তাদেরকে দিয়ে জোর করে সাদা কাগজে সই করানো হচ্ছে অভিযোগ তুলে নেওয়ার জন্য। লাঠিচার্জে আহত ব্যক্তিদের দূরের হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যেতে হচ্ছে। বৃদ্ধরা যেতে পারছেন না। রাত্রে পুলিশ বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভয় দেখাচ্ছে। যুবকরা ভয়ে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকছে। গ্রামবাসীরা মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনে জর্জরিত।

এত অত্যাচারের কারণ হল একটি সরকারী প্রকল্পের জন্য এই গ্রামের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে। ৫ বছরের বেশি হয়ে যাওয়ার পরও ঐ জমিতে প্রকল্প শুরুই হয়নি। জমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসন এবং রিসেটেলমেন্ট আইন ২০১৩ অনুযায়ী কোন অধিগৃহীত জমি/ভূমি পাঁচ বছরের বেশি অব্যবহৃত থাকলে তা মালিককে ফিরিয়ে দিতে হবে। কিন্তু সরকার বেআইনিভাবে এই অধিগৃহীত জমি ‘ভূমি ব্যাঙ্কে’ (ওড়িশা শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন ব্যাঙ্কে) জমা রেখেছে এবং পরিকল্পনা করছে এই জমি ‘জেএসডব্লিও’- কে হস্তান্তর করবে। প্রায় দশ বছর ধরে এই জমি অধিগৃহীত আছে।

ভালো সেচ ব্যবস্থার জন্য এই উপকূলীয় জমি উচ্চ ফলনশীল। এখানে ভালো ধানচাষ, পান, মাছচাষ হয়। বহু শতক ধরে এখানকার মানুষ বসবাস করছেন, গ্রামকে গড়ে তুলেছেন। সরকার ২০০৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার ‘পসকো’ কোম্পানিকে ৪,০০০ একর জমি দেওয়ার চুক্তি করে। গ্রামবাসীরা কেউ কেউ ক্ষতিপূরণও পান। কিন্তু অধিকাংশ গ্রামবাসীরা ‘পসকো’-র বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন এবং ‘পসকো’ পিছু হটে ও চলে যায়। সরকার এতে রাগান্বিত হয়ে জমিহারাদের তাদের প্রাপ্য “বন্দোবস্তি পরচা” দিতে অস্বীকার করে। পরিবর্তে সরকার মুখ্যমন্ত্রী বিজু পট্টনায়কের বন্ধুস্হানীয় জিন্দাল কোম্পানিকে শিল্প স্থাপনের জন্য ২,৯০০ একর উর্বর জমি দেয়। এরমধ্যে বর্তমানে ধিনকিয়ার প্রায় ১,০০০ একর জমি স্টীল পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য জিন্দালকে দেওয়া হয়। জনগণ এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালে সরকার বিশেষ পুলিশ বাহিনী নিয়োগ করে। ১৪ জানুয়ারি পুলিশ প্রচন্ড লাঠিচার্জ করে, ফলে মহিলা ও শিশুসহ বহু মানুষ আহত হন। নেতাদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ, পানচাষ ধ্বংস করে ও গ্রামবাসীদের ওপর সন্ত্রাস সৃষ্টি করে গ্রামত্যাগের জন্য চাপ দেয়।

খণ্ড-29
সংখ্যা-7