যোগী আদিত্যনাথ বলেছিলেন, তিনি সিএএ বিরোধী আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ‘প্রতিশোধ’ নেবেন। সরকারি সম্পদের তথাকথিত ক্ষতিকে ফিকির বানিয়ে জরিমানা আদায়ও কি সেই প্রতিশোধের অঙ্গ হয়েছিল? কয়েকদিন আগে, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের একটা রায় যেন এই বিষয়টাকেই প্রতিপাদিত করল। জরিমানা আদায়ের গোটা প্রক্রিয়াটাকেই অবৈধ ঘোষণার আবেদন জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছিলেন সমাজ আন্দোলনের কর্মী পারভেজ টিটু। বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় এবং সূর্যকান্তর বেঞ্চ তাঁদের রায়ে বলেন, আন্দোলনকারীদের থেকে জরিমানা আদায় বৈধ পথে হয়নি, আর তাই সেই অর্থ যাদের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে তাদের ফেরত দিতে হবে। বিচারপতিরা তাঁদের রায়ে বললেন, “চূড়ান্ত বিচারে, রাষ্ট্রের সম্পদকে রক্ষা করতেই হবে। কিন্তু এরই সাথে একটা বিচারবিভাগীয় ফোরামকেই তার পরিচালনা করতে হবে যাতে যথাযথ প্রক্রিয়া সুনিশ্চিত হয়। এটাই হল আমাদের দুটো রায়ের মোদ্দা কথা।” অর্থাৎ, জরিমানা আদায় করতে গিয়ে ২০০৯ ও ২০১৮ সালে দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের দুটো রায়ে যোগী প্রশাসন কোনো গুরুত্বই দেয়নি। রায় দুটোতে সুস্পষ্টরূপে বলা ছিল, জরিমানা আদায় আইনি ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে করতে হবে, আমলাদের জরিমানা আদায় প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখতে হবে। কিন্তু মোদী প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা শাসকরা জরিমানা আদায়ের নোটিশ ছেড়েছেন, আদায় প্রক্রিয়ায় সক্রিয় হয়েছেন।
মামলার নথিপত্র খতিয়ে দেখার পর বেঞ্চের বিচারপতিদের ধারণা হয় যে, জরিমানা আদায় করতে গিয়ে উত্তরপ্রদেশ সরকার নিজেই “অভিযাগকারী, বিচারক এবং মামলার আইনি পরিচালক” হয়ে দেখা দিয়েছে। ফলে, গোটা ব্যাপারটায় নিরপেক্ষতা না থাকা এবং প্রশাসনের স্বেচ্ছাচারের সম্ভাবনাই প্রবল ছিল। আর বৈধ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করার বাস্তব ব্যাপারটাতো ছিলই। প্রত্যাশিতভাবেই, মামলার এর আগের শুনানিতে ১১ ফেব্রুয়ারি বিচারপতিরা উত্তরপ্রদেশ সরকারের প্রতিনিধি অতিরিক্ত অ্যাডভোকেট জেনারেলকে বলেন, “হয় আপনারা এই জরিমানা প্রক্রিয়া বাতিল করবেন, আর তা না হলে আমরা এই আদালত দ্বারা তৈরি আইনের লঙ্ঘন হয়েছে বলে সেগুলো খারিজ করে দেব।” এই নির্দেশের পরিণাম স্বরূপ উত্তরপ্রদেশ সরকার ২৭৪টা মামলা তুলে নেয়। এবং সেগুলোকে নতুন গঠিত সাংবিধানিক ট্রাইব্যুনালে হস্তান্তরিত করা হয়েছে বলে আদালতকে জানায়। অর্থাৎ, যাদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হয়েছে তাদের রেহাই না দেওয়ার অভিপ্রায়ে রাজ্য সরকার ‘সাংবিধানিক ট্রাইব্যুনাল’ প্রসঙ্গের অবতারণা করে। আদালতের কাছে উত্তরপ্রদেশ সরকারের প্রতিনিধি নিবেদন করেন যে, জরিমানা হিসাবে আদায় করা টাকা হয়েছে ‘বহু কোটি’ আর তা ফেরানো রাজ্য সরকারের পক্ষে অসুবিধাজনকই হবে। কিন্তু বিচারপতিরা রাজ্য সরকারের অনৈতিকতা সম্পর্কে এবং আদায় করা জরিমানা ফেরানোর ব্যাপারে এতটাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন যে, রাজ্য সরকারের প্রতিনিধির মিনতিকে খারিজ করে বিচারপতি চন্দ্রচূড় বলেন, “নাগরিকদের সম্পত্তি যখন বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, এবং সরকারের যে নির্দেশ অনুসারে ঐ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল তা বাতিল করা হয়েছে, আমরা তখন কি বলতে পারি যে, নির্দেশগুলো বাতিল হয়ে গেলেও বাজেয়াপ্ত হওয়াটা চলতে থাকবে? আপনারা যখন নির্দেশগুলো প্রত্যাহারের ন্যায্য সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আমরা তখন বলতে পারি না যে বাজেয়াপ্ত হওয়াটা অব্যাহত থাকবে।”
মামলার শুনানির সময় বিচারপতিরা যখন বলেন যে, ‘বিচারকোচিত মানসিকতার’ তত্ত্বাবধানেই জরিমানা আদায় প্রক্রিয়া পরিচালিত করতে হবে, তখন তা আমাদের বিবেচনাকে গোটা প্রক্রিয়াটার আইনসিদ্ধতার মধ্যে নিবদ্ধ না রেখে তার ন্যায়নিষ্ঠতার অনুসন্ধানেও আগ্ৰহী করে তোলে। আমাদের জিজ্ঞাসাকে নিয়ে যায় এই প্রশ্নগুলোর দিকে — যাদের কাছে নোটিস পাঠিয়ে জরিমানা আদায় করা হয়েছিল তাঁরা কি সত্যই অপরাধী ছিলেন? তাঁদের হাতে রাষ্ট্রীয় সম্পদের প্রকৃতই কোনো ক্ষতি কি হয়েছিল? নোটিশ প্রাপকদের মধ্যে সবাই কি প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিলেন? জরিমানা আদায়ের তৎপরতার মধ্যে প্রশাসনিক প্রতিহিংসার কোনো স্পৃহা কি সক্রিয় ছিল?
সিএএ বিরোধী আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল ২০১৯’র শেষ দিকে। সে সময় উত্তরপ্রদেশের প্রশাসনিক পদক্ষেপগুলোর পর্যালোচনা দেখাচ্ছে, যোগী আদিত্যনাথের প্রশাসন এই আন্দোলনের মোকাবিলায় পৈশাচিক দমন নামিয়েছিল, পুলিশকে লেলিয়ে দিয়েছিল প্রতিবাদকারীদের ওপর। পুলিশী দমনের পরিণতি কি হয়েছিল তা জাহির করতে সে সময় মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথের সচিবালয় থেকে করা একটা টুইট জানিয়েছিল, “প্রত্যেক দাঙ্গাকারীই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। প্রত্যেক বিক্ষোভকারী হতভম্ব হয়ে গেছে। যোগী আদিত্যনাথ সরকার কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ায় প্রত্যেকেই চুপ মেরে গেছে। যাই করা হোক না কেন, যারা সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করছে তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকেই ক্ষতিপূরণ আদায় করা হবে। প্রতিটি সহিংস বিক্ষোভকারীকেই কাঁদতে হবে, কেননা উত্তরপ্রদেশে যোগী সরকার রয়েছে।” মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়ের এই টুইটে সে সময়ের বাস্তব পরিস্থিতির, পুলিশী নির্মমতার প্রতিফলন ঘটেছিল। সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারকে অস্তিত্বহীন করা হয়েছিল। সে সময়ের একটা তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, সিএএ বিরোধী আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে অন্তত ৩২৭টা এফআইআর দায়ের হয়েছিল, অপরাধ নিবারণের অজুহাতে ৫,৫৫৮ জনকে গ্ৰেপ্তার করা হয়েছিল। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল, যাতে মারা গিয়েছিল অন্তত ২৩ জন। রাজ্য সরকার পুলিশের গুলিতে এত মৃত্যুর কথা অস্বীকার করলেও তথ্যানুসন্ধানী কমিটির রিপোর্ট পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর তথ্যকেই প্রতিষ্ঠিত করেছিল। মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথও এই সমস্ত মৃত্যু সম্পর্কে বলেছিলেন, “কেউ যদি মৃত্যুর ইচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসে তাহলে সেই ব্যক্তি বেঁচে থাকবে কী করে।” প্রতিবাদকারীদের ঘরে ঢুকে পুলিশ তাদের সম্পদের ধ্বংসে মেতে উঠেছিল। প্রতিবাদীদের ধাওয়া করে হিন্দু মহল্লার দিকে নিয়ে গিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের উদ্দেশ্যে জনৈক পুলিশ অফিসারের আহ্বান ছিল, “আমরা হিন্দু, তোমরাও হিন্দু, ওদের মারো”। আর, মুসলিমদের ছবি দেওয়া পোস্টারে সারা রাজ্যকে ছেয়ে দেওয়া হয়েছিল, পোস্টারের ছবি দেখে মুসলিমদের অনুসন্ধান দিতে পারলে পুরস্কার দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। আদালতের নির্দেশে সেই সমস্ত পোস্টার অবশ্য পরে আদিত্যনাথ প্রশাসনকে সরিয়ে নিতে হয়।
এ হল সিএএ’র বিরুদ্ধে আন্দোলনের মোকাবিলায় মুসলিম-বিরোধী রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের সংক্ষিপ্ত আলেখ্য। তবে, জরিমানা আদায়কে কেন্দ্র করেও চলেছিল চরম স্বেচ্ছাচার, শুধু মুসলিম নাম পেয়েই নোটিশ পাঠানো হয়েছিল, তারা আন্দোলনে বা সহিংস কার্যকলাপে যুক্ত ছিল কিনা তা বিবেচিত হয়নি। যাদের গৃহবন্দী করা হয়েছিল, রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ ধ্বংসের কোনো সুযোগ যাদের ছিল না, তাদের কাছেও জরিমানা জমা করার নোটিশ পাঠানো হয়েছিল। পারভেজ টিটু তাঁর আবেদনপত্রে জানিয়েছেন, যাদের নামে নোটিশ গিয়েছিল তাঁদের মধ্যে ছিলেন ছ’বছর আগে মারা যাওয়া ৯৪ বছর বয়স্ক এবং দীর্ঘদিন রোগে ভুগতে থাকা ৯০ বছরের বেশি বয়স্ক দুজন মানুষ। পারভেজ টিটুর আইনজীবী নীলোফার খান আদালতে জানিয়েছেন, “রিকশাচালক, সব্জি বিক্রেতা এবং মুরগির মাংসের দোকানদাররাও অন্যায়ের শিকার হয়েছেন এবং তাঁদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হয়েছে। … নিজেদের ঠেলাগাড়ি বিক্রি করে তাঁদের রাষ্ট্রের চাপানো ক্ষতিপূরণ মেটাতে হয়েছে।” জরিমানা আদায়ে কেমন স্বেচ্ছাচার চালানো হয়েছে সে সম্পর্কে নিজের মতামত পেশ করে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মার্কাণ্ডেয় কাটজু ‘দ্য ওয়্যার’ ওয়েব পত্রিকায় ২০২০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি একটা নিবন্ধে জানিয়েছেন, “মোরাদাবাদের শাহেনশাহ, সেখানকার জেলা শাসক রাকেশ সিং কবি ইমরান প্রতাপগড়ির ওপর চাপিয়েছেন ১.০৫ কোটি টাকার জরিমানা এবং তা মোরাদাবাদের ইদগাহতে সিএএ বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত থাকার জন্য। এই জরিমানার হিসাব কষা হয়েছে ইদগাহের প্রতিবাদ স্থলে পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনীর নিয়োগে দৈনিক খরচের ভিত্তিতে।” ঐ নিবন্ধে শ্রীযুক্ত কাটজু আরো জানিয়েছেন, মুজাফ্ফরনগরের জেলাশাসক ৬৭টা দোকান বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন যেগুলোর মালিক নাকি সিএএ বিরোধী আন্দোলনকারীরা। কিন্তু কোন আইনের বলে এবং কিসের ভিত্তিতে তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে, এবং নিজেদের বক্তব্য পেশের কোনো সুযোগ তাদের দেওয়া হয়েছিল কিনা তা প্রশাসনের কাছ থেকে জানা যাচ্ছে না। জরিমানা আদায়ে চালানো স্বৈরাচারিতার নিদর্শন স্বরূপ এখানে আর মাত্র একটা ঘটনারই উল্লেখ করা যাক। লক্ষ্ণৌয়ের হজরতগঞ্জের পরিবর্তন চকে সিএএ বিরোধী আন্দোলনের জন্য অভিযুক্ত করে নোটিশটা পাঠিয়েছিলেন অতিরিক্ত জেলা শাসক কে পি সিং। নোটিশে ২৮ জন সিএএ বিরোধী আন্দোলনকারীর নাম ছিল, এবং তাঁদের ৩০ দিনের মধ্যে ৬৩ লক্ষ টাকা জমা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। যাঁদের নামে নোটিস গিয়েছিল তাঁদের মধ্যে ছিলেন ৭৭ বছরের অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস অফিসার এস আর দারাপুরি এবং সমাজ আন্দোলনের কর্মী ৭৩ বছর বয়স্ক মহম্মদ সোয়েব যাঁরা সে সময় গৃহবন্দী ছিলেন।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা যোগী আদিত্যনাথ সরকারের একটা স্বৈরাচারী পীড়নকে অবৈধতার অভিযোগে বিদ্ধ করে ন্যায়বিচারকেই ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। ওপরের আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে, যারা প্রতিবাদে অংশ নেয়নি, কোনো সহিংস কার্যকলাপে এবং সরকারি সম্পদের ধ্বংসে যুক্ত ছিল না, যারা গৃহবন্দী ছিল, তাদেরও সম্পদ ধ্বংসে অভিযুক্ত করে নোটিশ পাঠিয়ে তাদের কাছ থেকে জোরজবরদস্তি জরিমানা আদায় করা হয়েছে। জরিমানা আদায় যে প্রতিশোধ গ্ৰহণের স্পৃহা থেকেই চালানো হয়েছিল, সিএএ বিরোধী আন্দোলনের মোকাবিলা যে নির্ভেজাল হিন্দুত্ববাদী আগ্ৰাসনে পরিণত হয়েছিল, তা নিয়ে প্রশ্নের কোনো অবকাশ থাকতে পারেনা। তবে, আইনি আদালতে ধাক্কার সাথে জনতার আদালতে ধাক্কাটাও অত্যন্ত জরুরি। উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যের জনগণ মোদী-যোগীদের পরাজয় ঘটিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের জোরালো ধাক্কা দিতে পারেন কিনা তার দিকে আমরা সাগ্ৰহে তাকিয়ে থাকব।
- জয়দীপ মিত্র