সম্পাদকীয়
ঝাঁপাতে হবে নাছোড় লক্ষ্যে
jump to the goal

বোধহয় শীতঘুম ভেঙেছে। কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি অবশেষে সুপারিশ করল এমএনআরইজিএ খাতে বছরে ন্যূনতম একশো দিনের বদলে দেড়শো দিনের কাজের লক্ষ্যমাত্রা পাকা করতে হবে। কিন্তু মজুরি বৃদ্ধির কোনও সুপারিশ করেছে বলে শোনা যায়নি। এর আগে উদ্যোগী হয়ে এরকম সুপারিশ না করলেও, অনেক দেরীতে হলেও, লাগাতার চাপের মুখে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির নতুন সুপারিশ – জারি থাকা দাবির প্রাসঙ্গিকতাকে আরও একবার অংশত কোনো-না-কোনো মাত্রায় স্বীকার করল। তবে কোভিড পরিস্থিতির অনেক আগে থাকতে, সম্ভবত ২০১৪-তে মোদী জমানার গোড়াপত্তন থেকেই প্রকল্পটির সপক্ষে স্বতঃস্ফূর্ত দাবি উঠতে থাকে – বছরে অন্তত দুশো দিনের কাজ আর ছয়শো টাকা মজুরি চাই। পক্ষান্তরে মোদী সরকার প্রথম থেকেই একে ‘গর্ত খোঁড়ার প্রকল্প’ বলে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করে বন্ধ করে দিতে চেয়েছিল। কাজের সংস্থান করে দেওয়ার নাম নেই, মজা মারার মাস্টার! কিন্তু সামগ্রিক বেড়ে চলা বেকারত্ব, প্রধানত ক্রমবর্ধমান গ্রামীণ বেকারির চাপের মুখে কোনো সুরাহা দিতে পারেনি, সেই বাধ্যতা থেকে প্রকল্পটিকে ইচ্ছা না থাকলেও রেখে দিতে বাধ্য হয়। তবে বছর বছর এর বাজেট বরাদ্দের প্রশ্নে – হয় খুব নগণ্য পরিমাণ বৃদ্ধি, নয়তো যথাস্থিতি বা সংকোচনের পন্থা অবলম্বনের পন্থা নিয়ে আসছে।

কোভিড-১৯ সংক্রমণের হানার পর ২০২০-২১ বাজেট বছরে কেন্দ্র যা বরাদ্দ করেছিল তাতে পরিকাঠামো খাতে ব্যয়বৃদ্ধির শর্ত জুড়ে দেয়, ফলে কার্যত মজুরি বাবদ অর্থের কোটা কমে যায়। তবু কোভিডে কাজ হারানো অসংগঠিত ক্ষেত্রের মজুরদের নিরুপায় হয়ে গ্রামেই ফিরে কাজের দাবি প্রচন্ড বেড়ে যায়। সেই চাপে কেন্দ্র ২০২০-২১ আর্থিক বছরে এই খাতে সংশোধিত বরাদ্দ অনেক বাড়াতে হয়। সংসদীয় স্থায়ী কমিটিই জানাচ্ছে সেবছর মোট খরচ হয়েছিল ১ লক্ষ ১১হাজার কোটি টাকা। কোভিডের জের চলে পরের বছরেও। যারা অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ হারিয়ে জীবন ও জীবিকার তাগিদে গ্রামে ফিরে আসে, তারা পুনরায় পরিযায়ী কর্মসংস্থানের ডাক পাননি। ফলে গ্রামেই রয়ে যান, আর নির্ভর করতে হয় এমএনআরইজিএ প্রকল্পের উপর। অর্থাৎ এই খাতে কাজের চাহিদার তীব্রতা-ব্যাপকতা একই রকম থেকে যায়। অথচ মোদী সরকার কী নির্মম অমানবিক! ২০২১-২২ আর্থিক বছরে বরাদ্দ নামিয়ে আনে ৭৩ হাজার কোটি টাকায়। ২০২০-২১-এর সংশোধিত ব্যয়ের তুলনায় ৩৮ হাজার কোটি টাকা ছেঁটে দেওয়া হয়। কিন্তু তার পরেও চাহিদার প্রবল চাপ একেবারে উড়িয়ে দিতে পারে নি। তাছাড়া কেন্দ্রকে তাড়া করতে শুরু করে কৃষক আন্দোলনের বছরভর ঐতিহাসিক উত্তর-পশ্চিমী গরম হাওয়া-বজ্র বরিষণ-শৈত্য প্রবাহ। বিজেপির ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন। এসবের সম্মিলিত ঠ্যালা সামলাতে এমএনআরইজিএ-তে সংশোধিত বরাদ্দ ৯৮ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত বাড়ায়। পূর্ববর্তী বছরের সংশোধিত বরাদ্দের তুলনায় ঘাটতি রেখে দেয় ১৩ হাজার কোটি টাকার। এবারের অর্থবর্ষে (২০২২-২৩) নির্লজ্জের মতো ফের বরাদ্দ কমিয়ে এনেছে ৭৩ হাজার কোটি টাকায়। প্রকৃত নির্মম বাস্তবতা হল, কোভিডে কাজ হারানো কর্মপ্রার্থীদের বড় অংশ, যারা পরিযায়ী মজদুর, এখনও পুরানো কর্মস্থলে ফিরে যেতে পারেনি। উপরন্তু এই প্রকল্পে রাজ্যে রাজ্যে মজুরি স্তর চালু রয়েছে ২০০-৩০০ টাকা মাত্র। সরকারি গণবন্টন ব্যবস্থায় বিনামূল্যে যে পরিমাণ খাদ্যশস্য মেলে তা ন্যূনতম প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। সব মিলে কি এই দুর্গতিতে দিন চলে? অধিকন্তু যখন মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে রমরমিয়ে? এই ব্যবস্থার কী নিষ্ঠুর প্রহসন! সরকারি কোভিড সচেতনকরণের প্রচার চলে ‘জীবনীশক্তি বাড়াতে হবে’! বঞ্চনার শেষ নেই, সমান তালে চলছে প্রতারণা ও প্রহসন।

কিন্তু না, হাল ছেড়ে দিলে চলবে না! সংসদীয় কমিটির সুপারিশ আর কেন্দ্রের মর্জির ওপর ভাগ্য ছেড়ে রাখার কোনো মানেই হয় না। বরং ঝাঁপাতে হবে নতুন করে, অধিকার আদায়ে নাছোড় লক্ষ্যে।

খণ্ড-29
সংখ্যা-6