২০২২-২৩ অর্থবর্ষে ৩টি জিডিপি বৃদ্ধির হারের মধ্য থেকে বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা
choose from 3 GDP growth rates

২০২২-২৩ সালের জিডিপি বৃদ্ধির হার কত হবে বলে অনুমান করছে মোদী সরকার?

বছরের এই সময়ে এরকম প্রশ্ন শেয়ার বাজার, শিল্পপতি-ব্যবসায়ী, অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠান ও অর্থনীতিবিদদের মধ্যে অবশ্যই চর্চিত হতে থাকে। ওই অনুমিত জিডিপি বৃদ্ধির হারের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও সম্যক আলোচনা করেন অর্থনৈতিক-পরিসংখ্যানবিদরা। সাধারণত, চলতি বছরের (২০২১-২২) অর্থনৈতিক সমীক্ষা (যা কেন্দ্রীয় বাজেট পেশের একদিন আগে পেশ করা হয় ও যার কথা কেন্দ্রীয় বাজেটে উল্লেখিত হয়) পরবর্তী আর্থিক বছরের জন্য জিডিপি বৃদ্ধির একটি আনুমানিক পরিমাণ পেশ করে। ওই অনুমানই বাজেটে প্রতিফলিত হয় কারণ সরকারের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টাই সমীক্ষাটি পেশ করেন; এবং তিনি হলেন ভারত সরকারের অর্থমন্ত্রকের অধীন অর্থনীতি বিষয়ক বিভাগের প্রধান। ফলে অর্থমন্ত্রক যখন অর্থনৈতিক সমীক্ষার পরদিন বাজেট পেশ করে তখন তাদের মন্ত্রকের অধীন বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত জিডিপি বৃদ্ধির হারকেই মেনে নেবে বলে অনুমান করা যেতে পারে। এছাড়াও নামে স্বশাসিত রিজার্ভ ব্যাঙ্ক রয়েছে যাদের গুরুত্বপূর্ণ মানিটারি পলিসি কমিটি বাজেট পেশের এক সপ্তাহের মধ্যেই মিটিং করেন সুদের হার ও অন্যান্য আর্থিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। তারাও জিডিপি বৃদ্ধির ও মুদ্রাস্ফীতির আনুমানিক হার সম্পর্কে দৃষ্টিপাত করে। যেহেতু সরকার একটিই তাই সকলেই একই হারে জিডিপি বৃদ্ধির কথা বলবে ও মুদ্রাস্ফীতি সংক্রান্ত অনুমানও একই হবে এটা ধরাই যেতে পারে।

কিন্তু ২০২২-২৩ʼর জিডিপি বৃদ্ধির হার সংক্রান্ত অনুমান দেখিয়ে দিচ্ছে যে সরকারটি এতই অস্বচ্ছ যে সেটির বাঁ-হাত কী করছে সে সম্পর্কে ডান-হাত অবহিত নয়। ৩১ জানুয়ারি পেশ করা অর্থনৈতিক সমীক্ষা থেকে শুরু করে ১০ ফেব্রুয়ারি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ঘোষণা, এই ১১ দিনে ৩ রকম জিডিপি বৃদ্ধির হার সরকারের বিভিন্ন দফতর বা প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া গেছে, যেগুলি ৬.৬ শতাংশ থেকে ৮.৫ শতাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত।

২০২১-২২ʼর অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২২-২৩ʼর ৩১ জানুয়ারিতে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার (স্থিরমূল্যে জিডিপি বৃদ্ধির হার) ৮ থেকে ৮.৫ শতাংশের মধ্যে থাকবে বলে অনুমান করেছিল। পরবর্তীতে বাজেট পেশের সময়ে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে চলতি মূল্যে (স্থিরমূল্যে বৃদ্ধির হার+ মুদ্রাস্ফীতির হার) জিডিপি বৃদ্ধির হার ১১.১ শতাংশ হবে বলে অনুমান করেন। ১০ জানুয়ারি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার গভর্ণর শক্তিকান্ত দাস ২০২২-২৩ সালে মুদ্রাস্ফীতির হার ও জিডিপি বৃদ্ধির হার যথাক্রমে আনুমানিক ৪.৫ শতাংশ ও ৭.৮ শতাংশ বলে ঘোষণা করেন। যদি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অনুমানে ২০২২-২৩ সালে মুদ্রাস্ফীতির হার ৪.৫ শতাংশ (মুদ্রাস্ফীতির হার অনুমানে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অধিকতর দক্ষ) ও অর্থমন্ত্রীর বাজেট পেশকালীন চলতি মূল্যে জিডিপি বৃদ্ধির হারকে ১১.১ শতাংশ ধরা হয়। তাহলে অর্থমন্ত্রীর হিসেব অনুযায়ী স্থিরমূল্যে জিডিপি বৃদ্ধির হার হবে ২০২২-২৩ সালে ৬.৬ শতাংশ।

ফলে ১১ দিনের মধ্যে সামনের বছরের জিডিপি বৃদ্ধি বিষয়ে ৩টি অনুমান পাওয়া গেল। অর্থনৈতিক সমীক্ষায় ৮ থেকে ৮.৫ শতাংশ; বাজেটে ৬.৬ শতাংশ ও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অনুমানে ৭.৮ শতাংশ।

আগে হিন্দু বৃদ্ধির হার বলে একটি কথা চালু ছিল। এখন হিন্দুত্ব বৃদ্ধির হার, যেখানে একই সঙ্গে গোটা কয়েক অপশন থাকবে। মাথায় কাপড় পরা বা না পরার ক্ষেত্রে মুসলিম ছাত্রীদের পছন্দের স্বাধীনতা না থাকলেও, জিডিপি বৃদ্ধির হারের সরকারি অনুমানের ক্ষেত্রে বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে সে বিষয়ে যুক্ত সকলকে।

আধ্যাত্মিক গুরুর কাছে গোপন তথ্য প্রদান গোপনীয়তা ও সততা লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য করা যায় না — এনএসইʼর প্রাক্তন মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিক চিত্রা রামকৃষ্ণের যুক্তি!

ভারতের অর্থনৈতিক বন্দোবস্তে হিন্দুত্বের তথা আধ্যাত্মিকতার উপস্থিতি কত প্রবল হয়েছে তা শেয়ার বাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেবির সাম্প্রতিক একটি তদন্তের থেকে বোঝা যেতে পারে। ২০১৩ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ এনএসইʼর মুখ্য প্রশাসনিক অফিসার (সিইও) পদে থাকা চিত্রা রামকৃষ্ণের প্রশাসনিক অবহেলার তদন্ত করতে গিয়ে সেবি দেখতে পায় যে, তিনি নিয়মিত এনএসইʼর কাজকর্ম সংক্রান্ত ইমেইল এক ‘অজানা’ ব্যক্তিকে পাঠিয়েছেন। প্রশ্নের উত্তরে চিত্রা জানিয়েছেন যে ওই অজানা ব্যক্তি একজন ‘আধ্যাত্মিক শক্তি’ যার কাছ থেকে তিনি ২০ বছর ধরে পথনির্দেশ গ্রহণ করেছেন। সেবির তদন্তে এও প্রকাশ পেয়েছে যে, ওই ‘আধ্যাত্মিক’ গুরুর প্রভাবেই চিত্রা মূলধনী বাজারে কোনো অভিজ্ঞতাহীন একজন ব্যক্তিকে মাঝারি স্তরের কর্মকর্তা হিসেবে অন্যান্য অভিজ্ঞ এনএসই কর্মকর্তাদের থেকে বেশি বেতনে নিজের উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। সেবির তদন্তকারীদের বক্তব্য অনুসারে চিত্রা মূলত ওই ততাকথিত গুরুর একজন পুতুল হিসেবে কাজ করতেন।

সবথেকে উপাদেয় ও আশ্চর্যের কথা হল যে, চিত্রা রামকৃষ্ণ তাঁর কাজের যাথার্থকে প্রতিষ্ঠিত করতে যুক্তি দিয়েছেন যে, কোনো আধ্যাত্মিক ব্যক্তির কাছে এক্সচেঞ্জের গোপন তথ্য প্রদান করে তাঁর থেকে উপদেশ ও দিকনির্দেশ নেওয়াকে গোপনীয়তা ও সততা লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য করা যায় না।

বোঝাই যাচ্ছে, রামরহিম, আশারাম বাপু, নিত্যানন্দ, সদগুরু, চিন্ময়ানন্দদের প্রভাবে ‘হিন্দুত্বের ভারত’ কী হতে চলেছে।

- অমিত দাশগুপ্ত

খণ্ড-29
সংখ্যা-9