দেউচা-পাঁচামী কয়লাখনি প্রকল্প সম্পর্কে কিছু তথ্য
Deucha-Panchami coal project

প্রকল্পের ভূগোল

বীরভূম জেলার মহম্মদবাজার ব্লকের দেউচা-পাঁচামী এলাকায় এই কয়লাখনি হবে। জেলা সদর সিউড়ি থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে। ১৪ নম্বর জাতীয় সড়কের পশ্চিমে। নিকটবর্তী রেল স্টেশন মল্লারপুর।

  • ১২ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে খোলামুখ খাদান হবে। মোট ১০টি মৌজার ১৯টি গ্রাম এই খনিগহ্বরে বিলীন হয়ে যাবে। ৪,৩১৪টি পরিবারকে উচ্ছেদ হতে হবে, মোট ২১,০০০ জনকে। এরমধ্যে ৯,০৩৪ জন আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের (৪৩ শতাংশ)। এছাড়া আছেন এসসি ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। এগুলো সরকারি হিসাব। অনেকে বলছেন সব মিলিয়ে প্রায় ৭০,০০০ মানুষকে উচ্ছেদ হতে হবে।
  • এখানে এমন বহু মানুষ আছেন যারা এরআগে অন্য কোনও ‘উন্নয়ন’ প্রকল্পে উচ্ছেদ হয়ে এখানে এসে বসবাস করছেন এবং সরকারের খাতায় তাঁদের অনেকের নাম নাই। বহু মানুষ আছেন যাদের জমি জায়গার কাগজপত্র নাই।
  • এখান দিয়ে বয়ে গেছে দ্বারকা নদী। নদীর ওপর আছে ১৭ লক্ষ কিউবিক মিটার আয়তনের দেউচা ব্যারেজ। দক্ষিণে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে ময়ুরাক্ষী নদীর ওপর তিলপাড়া ব্যারেজ ও ৩০ কিমি দূরে বক্রেশ্বর উষ্ণ প্রস্রবণ, পশ্চিমে মাসাঞ্জোর বাঁধ এখান থেকে ৩৭ কিলোমিটার।
  • প্রকল্প এলাকাকে সরকার দুটো ভাগে ভাগ করেছে। প্রথম ভাগ দেওয়ানগঞ্জ-হরিণসিঙ্গা ২.৬ বর্গ কিলোমিটার। দ্বিতীয় ভাগ দেউচা-পাঁচামী ৯.৭ বর্গ কিলোমিটার।
  • প্রথম ভাগে প্রথমে খনন শুরু হবে। এখানে পড়বে দেওয়ানগঞ্জ, হরিণসিঙ্গা, কেন্দাপাহাড়ি, নিশ্চিন্তপুর, তেতুলবাঁধ, পাথরচাল, তালবাঁধ ও হারমাডাঙ্গা।
  • দ্বিতীয় ভাগের গ্রামগুলি হল, বাহাদুরগঞ্জ (দেউচা), আলিনগর, মকদমনগর, কাবিলনগর, সালুকা, মথুরাপাহাড়ি, গোবরবাথান, বারমেসিয়া, সাগরবান্দি, পাথরপাড়া ও শালডাঙ্গা। সমগ্র প্রকল্পটির সরকারি নাম দেউচা-পাঁচামী-দেওয়ানগঞ্জ-হরিণসিঙ্গা কয়লাখনি।

ইতিহাস

  • এখানে কয়লার কথা বহু আগে থেকেই জানা ছিল। ১৯৮০-র দশক জুড়ে বেশ কয়েকবার ভারতের ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষা দপ্তর কিছু কূয়ো খুঁড়ে নিরীক্ষা চালিয়েছিল। কিন্তু কোল ইণ্ডিয়া লিমিটেড এখানে খনি করতে কখনও সম্মত হয়নি।
  • ২০১১ সালে কেন্দ্রীয় সরকার আরও ৫৮টি ব্লকের সাথে এই কয়লা ব্লকটিও নিলামের কথা ঘোষণা করে। ২০১৪ সালে কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, তামিলনাড়ু, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ এবং কর্ণাটক সরকারকে একযোগে কয়লা উত্তোলনের জন্য প্রস্তাব দেয়, বেঙ্গল বীরভূম কোলফিল্ডস লিমিটেড নামে একটি সংস্থা তৈরি করা হয়। কিন্তু লাভজনক হবেনা ভেবে সকলে পিছিয়ে যায়।
  • শেষে পশ্চিমবঙ্গ পাওয়ার ডেভেলাপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড (ডব্লিউবিপিডিসিএল)-এর সাথে কেন্দ্রীয় সরকারের চুক্তির মাধ্যমে রাজ্য সরকার এই প্রকল্প হাতে নেয়। ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার কয়লাখনিতে ১০০ শতাংশ বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগের ছাড়পত্র দিয়ে রেখেছে।
  • ৯ নভেম্বর ২০২১ মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় এই প্রকল্পের ঘোষণা দেন। সরকার ৩৫,০০০ কোটি টাকা খরচ করবে বলে জানান তিনি, যারমধ্যে ১০,০০০ কোটি টাকা পুনর্বাসনে খরচ করা হবে।
Some information about Deucha-Panchami

ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষার তথ্য

১৯৮৮-৮৯ সালে ভারতের ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষা (জিএসআই) প্রকাশিত রিপোর্ট, ২০১৬ সালে বিহার সরকারকে দেওয়া জিএসআই’এর তথ্য এবং ডব্লিউবিপিডিসিএল’এর একটি প্রেজেন্টেশন থেকে দেখা যাচ্ছে,

  • দেওয়ানগঞ্জ-হরিণসিঙ্গা ব্লকে ৩টি স্তরে এবং দেউচা-পাঁচামী ব্লকে ৪টি স্তরে কয়লা আছে। দেওয়ানগঞ্জের স্তরগুলির গভীরতা ১২ মিটার থেকে ৩৮০ মিটার, পাঁচামীর দিকে ১৩৫ মিটার থেকে ৮৫০ মিটার। কয়লার স্তরগুলির বেধ ৫ মিটার থেকে ৮০ মিটার এবং সবচেয়ে পুরু স্তরগুলি আছে সবচেয়ে বেশি গভীরতায়।
  • এখানে জমা থাকা কয়লার মান অত্যন্ত নিম্ন। তারমধ্যে অপেক্ষাকৃত ভালো মানের কয়লা আছে সবচেয়ে নিচের স্তরটিতে। এই স্তরটি আছে ৪২০ মিটার থেকে ১,০০০ মিটার গভীরতার মধ্যে।
  • সমগ্র এলাকাতেই কয়লার স্তরের ওপরে আছে অত্যন্ত শক্ত আগ্নেয়গিরিজাত পাথরের স্তর। ভূতাত্বিক পরিভাষায় এই ব্যাসল্টের স্তরের নাম রাজমহল ট্র্যাপ। এই ব্যাসল্ট পাথরের স্তর ৯০ মিটার থেকে ২৪৫ মিটার পুরু।
  • সব কয়লা তুলতে হলে খোলা খাদানের চূড়ান্ত গভীরতা হবে প্রায় ১,২০০ মিটার। ১২ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে এক কিলোমিটার গভীর খোলামুখ খাদান খোড়া হবে।

২০১৬ সালে বিহার সরকারকে দেওয়া জিএসআই’এর তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে,

  • এখন পর্যন্ত বিভিন্ন গভীরতার সর্বমোট ৩৬টি কূয়ো (বোরহোল) খনন করা গেছে। কোথায় কীভাবে কয়লা আছে তার সুস্পষ্ট চিত্র পেতে আরও ৮০টি কূয়ো খোড়া দরকার।
  • এত গভীর থেকে সুড়ঙ্গ কেটে কয়লা তোলার কারিগরি বর্তমানে দুনিয়ায় নেই। শক্ত ব্যাসল্ট ভেদ করে কূয়োগুলো খুড়তেও বিদেশি প্রযুক্তি লাগবে। খোলামুখ খনি এখানে তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব, কিন্তু বাস্তবে খুবই কঠিন।
  • ব্যাকফিলিং, অর্থাৎ খোড়া অংশ আবার বুজিয়ে দেওয়ার কাজ, সম্ভব হবে কেবলমাত্র খনির জীবনের একদম শেষ ভাগে গিয়ে। অর্থাৎ বিপুল পরিমান ওভার বার্ডেন ঢিবি করে রাখার জন্য খনির বাইরে আরও জায়গা দরকার হবে। পরিবহনের জন্য রেল, রোড ও অন্যান্য পরিকাঠামো নির্মাণে জমি নিতে হবে।
  • এখানকার কয়লা-স্তরের বেধ অস্বাভাবিক বেশি, এক জায়গায় দুটি স্তর মিশে গিয়েছে। এত পুরু স্তরবিশিষ্ট খনি কোথাও নেই। পুরু স্তরের ক্ষেত্রে খননের সময় কয়লাতে আগুন লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেড়ে যায়।

মাটির তলায় তলায় সুরঙ্গ করে মাল কেটে বের করে আনার পদ্ধতিতে এখন আর খনিকাজ হয় না। এখন হয় খোলামুখ খনি। ওপেন কাস্ট মাইনিং প্রজেক্ট বা সংক্ষেপে ওসিপি। ওপর থেকে সমস্ত কিছু সরিয়ে দিয়ে — বাড়িঘর গাছপালা, রাস্তাঘাট, মানুষ, পাখি, মাটি, পাথর — সবকিছু উপড়ে খুড়ে তাড়িয়ে অন্যত্র ডাম্প করে তলার মাল চেঁছে নিয়ে যাওয়ার নাম খোলামুখ খনি। খনিবিদরা ওপরের এই সবকিছুকে বলেন ওভার বার্ডেন বা ওপরের বোঝা। ওভার বার্ডেনের মধ্যে যদি মানুষের বসতিও থাকে তখন সেই প্রকল্পকে ওঁরা বলেন গ্রিনফিল্ড প্রজেক্ট। দেউচা-পাঁচামী-দেওয়ানগঞ্জ-হরিণসিঙ্গা খোলামুখ কয়লাখনি প্রকল্প বহু হাজার মানুষকে অন্যত্র ডাম্প করবে, তাই ওদের পরিভাষায় এটি একটি সবুজক্ষেত্র প্রকল্প। খোলামুখ খনির সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাব অনেক বেশি। ডব্লিউবিপিডিসিএল’র প্রেজেন্টেশনে বলা হচ্ছে যে তারা সামাজিক প্রভাব সমীক্ষা করেছে যদিও তা অসম্পূর্ণ, এলাকার মোট গ্রামের অর্ধেকও কভার করা যায়নি। এই অসম্পূর্ণ সমীক্ষা-রিপোর্টটিও সরকার এখনও জনসমক্ষে আনেনি এবং পরিবেশ সংক্রান্ত কোনওরকম সমীক্ষাই সরকার এখনও করেনি, কোন আইন বলে সরকার জমি নিতে শুরু করেছে তাও কদাপি জানায়নি।

খণ্ড-29
সংখ্যা-11