সরকারি প্রকল্পে বঞ্চিত কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে হবে
deprived farmers in government projects

কয়েক বছর ধরে বিশেষ করে ২০১৯ লোকসভা ভোটের পর থেকে বিভিন্ন ধরনের সাহায্য/অনুদান প্রকল্প চালু হয়েছে। গ্রামবাংলার গরিব জনগণও এসব সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। এসব সংস্কার কার্যক্রম তৃণমূল সরকারের আপন খেয়ালবশত চালু হয়নি। একে নিছক সরকারের গরিবের দুর্দশা দেখে বিচলিত হয়ে দয়ার দান মনে করার কারণ নেই। সংকটের চাপ সামলানোর ব্যবস্থা নেওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই এইসব নানা খয়রাতি প্রকল্প চালু হয়েছে। অন্যদিক থেকে দেখলে এরফলে অভাবগ্রস্ত জনগণের মধ্যে কিছুটা উপকৃত হওয়ার ভাব সৃষ্টি হচ্ছে, রাজ্য সরকারের প্রতি কোনো না কোনো ধরনের আশায় আশায় থাকার মনোভাব তৈরি হচ্ছে। মানুষের ওপর সরকার তার এক ধরনের প্রভাব ফেলতে সফল হচ্ছে। বড় সংখ্যক মানুষ সুযোগ-সুবিধা হারানোর কল্পিত ভয়ে শাসকদলের শত অনাচার-দুর্নীতি দেখেও সরকার বিরোধী হতে চাইছে না।

বামফ্রন্ট সরকারের আমলে বর্গা আইন হয়েছিল, বর্গার অধিকার ছিল, সেই আইনের কড়াকড়ির ফলে উচ্চবর্ণের মানুষ কষ্ট স্বীকার করে নিজেরা জমি চাষ করতো। এখন এই আইন হিমঘরে চলে যাওয়ার ফলে আবাদী জমি মালিকরা বর্গা হওয়ার ভয় থেকে বেরিয়ে এসে ব্যাপকভাবে জমি লিজ/ভাড়া দিচ্ছে। এতে এদের লাভ বেশি। জমি লিজ দেওয়ার বিনিময়ে টাকা বা সমমূল্যের ফসলের ভাগ পাচ্ছে, সরকারের আইন মোতাবেক এদের জমির কাগজপত্র থাকার ফলে এরা সরকারি অনুদানের টাকা পাচ্ছে, ফড়ে বা দালালদের কাছে নিজের জমির কাগজপত্র ভাড়া দিয়ে তাদের সরকারি দরে ফসল বিক্রির টাকা থেকেও একটা কমিশন পাচ্ছে এবং আবার নিজেরা অন্য কাজ করে রোজগার করছে। এরপর এদের বাড়ীর মেয়েরা লক্ষ্মীর ভান্ডার, কন্যাশ্রী ইত্যাদির মাধ্যমে অনুদান পাওয়ার ফলে এই মুহূর্তে এই শ্রেণীর মানুষজনকে সরকার বিরোধী কৃষক আন্দোলনে নামানো যাচ্ছে না। বিপরীতে ব্যাপক ভুমিহীন কৃষিমজুর যারা কাজের জন্য বাইরে চলে যেতে বাধ্য হোত, কোভিডের কারণে তারা ভিনরাজ্যে বিভুঁইয়ে হয়রানির শিকার হয়ে গ্রামে ফিরে আসতে বাধ্য হল। গ্রামে ফিরে এসে রুজি-রোজগারের অন্য কোনো উপায় না দেখে ফের জমির প্রতি স্বভাবজাত টান অনুভব করতে দলে দলে জমি ভাগ বা লিজ নিতে শুরু করল। তবে এদের কাছে কোনো জমির কাগজপত্র না থাকায় এরা সরকারি সমস্ত ধরনের অনুদান পাওয়া এবং সরকারের মান্ডিতে ফসল বেচার অধিকার থেকে বঞ্চিত। নিজেদের শ্রম মুল্য হিসেবে ধরলে এই ব্যবস্থায় তাদের প্রচুর আর্থিক-মানসিক ক্ষতি হচ্ছে। এই ক্ষতি তারা সবক্ষেত্রে বুঝতে পারছেন না বা অন্য কোনো উপায় না থাকার ফলে বুঝতে পারলেও কিছু করার থাকছে না। গ্রামাঞ্চলে এই শ্রেণীটিকে সচেতন ও সংগঠিত করতে সর্বাত্বক সক্রিয় উদ্যোগ দরকার।

সরকারি প্রকল্প নীতির মধ্যে যে বৈষম্য রয়েছে, সে সম্পর্কে চেতনা জাগিয়ে তুলে আন্দোলনে সামিল করাতে হবে। ধারাবাহিকভাবে এই কাজ চালাতে হবে। আওয়াজ তুলতে হবে — কাগজ নয়, কৃষিদপ্তরের কোনো অফিসারকে দিয়ে সরেজমিন তদন্ত করে প্রকৃত চাষিদের মরশুমি ভিত্তিতে কৃষক অনুদান, ফসলের বীমা এবং সরকারি মান্ডিতে ফসল বিক্রী করার অধিকার দিতে হবে। গ্রামাঞ্চলে এই গরিব-ভূমিহীন কৃষকশ্রেণীকেই নতুন সংগ্রাম ও সংগঠনের ভিত্তি করে তুলতে হবে। এদের দাবিসমূহকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। চাষাবাদে সরকারি আর্থিক সহায়তা, ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মুল্য নিশ্চয়তা আইন লাগু করার সাথে সাথে চাষের খরচ কমানোর দাবিতে জোর দিতে হবে। এজন্য দাবি তুলতে হবে সস্তার চাল-গম পাওয়ার রেশন কার্ডের মতো চাষিদের সুলভে কৃষি উপকরণ সংগ্রহের কার্ড দেওয়া হোক, যে কার্ড দেখিয়ে সরকারের দোকান থেকে কম দামে চাষি পরিমাণ মতো সার-বীজ-ওষুধ কিনতে পারবেন। সেচের খরচ বেড়ে গেছে বহুগুণ। এরজন্য দাবি তুলতে পারি সেচের জন্য বিনামূল্যে বিদ্যুৎ/ডিজেল দিতে হবে। নিয়মতান্ত্রিকতার থেকে বেরিয়ে এসে এই দাবিগুচ্ছ নিয়ে যদি লাগাতার সচেতন ও সংগঠিত করা যায়, ছোট-বড় সংগ্রাম-সমাবেশে সামিল করা যায়, তবে অনুদান নির্ভরতাজনিত ভয়-ভীতি কাটিয়ে সন্ত্রাস মোকাবিলা করে সরকার বিরোধী আন্দোলনে নামানো সম্ভব।

- বাবলু ব্যানার্জী

খণ্ড-29
সংখ্যা-12