শ্রীলঙ্কায় গ্রীষ্ম-অভ্যুত্থান : ভারতের জন্য এক শিক্ষা
A Lesson for India

শ্রীলঙ্কার জনগণ রাজাপক্ষ সরকার ও তার অপশাসনের বিরুদ্ধে গত মার্চ, ২০২২ থেকে লাগাতার প্রতিবাদে উঠে দাঁড়িয়েছেন। অর্থনৈতিক অব্যবস্থা থেকেই প্রতিবাদ জ্বলে ওঠে, কারণ এই বিশৃঙ্খলায় খাদ্য ও জ্বালানির দাম আকাশ ছুঁয়েছে, জ্বালানী সংকট তৈরি হয়েছে এবং অনির্দিষ্টকাল ধরে বিদ্যুৎ বিভ্রাট চলেছে, জ্বালানির লাইনে দাঁড়িয়ে বয়স্ক মানুষরা প্রাণ হারিয়ে লুটিয়ে পড়েন।

কিন্তু এই প্রতিবাদ দ্রুতই এক সর্বাত্মক অভ্যুত্থানের চেহারা নেয় — রাজাপক্ষ ভাইদের নেতৃত্বাধীন সরকারকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার দাবিতে। এই ভাইয়েরা, গোটাবায়া এবং মাহিন্দা দ্বীপরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। সরকারের প্রকাশ্য স্বজনপোষণ জনতার রোষকে আরও বাড়িয়ে তোলে। আমাদের লেখার সময় পর্যন্ত, প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দাকে পদত্যাগ করতে হয়েছে, যে লোকটির হাত তামিল-গণহত্যার রক্তে রাঙানো — যে তামিলরা আত্ম নির্ধারণের লড়াই লড়ছিলেন; আর তার ভাই প্রতিবাদীদের ঠাণ্ডা করার জন্য দেখামাত্র গুলির নির্দেশ জারি করেছে।

বিদ্রোহী তামিলদের ‘জয় করার’ দরুণ ‘বলিষ্ঠ নেতা’ হয়ে ওঠার ভাবমূর্তির জোরে রাজাপক্ষ ভাইয়েরা ক্ষমতায় এসেছিল। তখন তামিল জনগণের প্রতি ধারাবাহিক নির্যাতনের সঙ্গে মিশেছে ইসলাম-ভীতির রাজনীতি (হালাল-মাংসে ও হিজাবে নিষেধাজ্ঞা, আরএসএস ও বিজেপি ভারতে যার প্রতিধ্বনি তুলেছে, তারসঙ্গে জুড়েছে ঘৃণা ছড়ানো বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মদত) এবং মুসলিম ও খ্রিস্টানধর্মের সংখ্যালঘু জনগণের বিরুদ্ধে হিংসা। এই অভ্যুত্থান সম্পর্কে ভারতীয়দের জন্য যেটা সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ সেটি হল — জাতিগত ও ধর্মীয় বিভাজনের বেড়া ভেঙে শ্রীলঙ্কার জনগণের একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়া। শ্রীলঙ্কার জনগণ সেই বিপর্যয়টা উপলব্ধি করতে পেরেছেন যেটা রাজাপক্ষ সরকার হিংসাশ্রয়ী রাজনীতির আবরণে অনেক কসরৎ করে তাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছিল।

মোদী-সৃষ্ট বিপর্যয় ভারতবর্ষকে ইতিমধ্যেই গ্রাস করেছে; আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, বিগত অর্ধ শতকের ভয়ঙ্করতম বেকারত্ব, তার সঙ্গে মোদী সরকার ও বিজেপি-শাসিত রাজ্য সরকারগুলির ঘৃণা-ভাষণ ও বিদ্বেষমূলক নীতির ক্রমাগত হট্টরোল (যা মগজ বিষিয়ে তুলতে বদ্ধপরিকর)। এসব কিছুই শ্রীলঙ্কাকে মনে করিয়ে দেয়। কৃষকদের প্রতিবাদ, বিহার ও উত্তর প্রদেশে বেকার যুবকদের প্রতিবাদ — এগুলো সবই সেই প্রবল আলোড়ন আর অস্থিরতার ইঙ্গিত যা শুধু মুসলিম-বিরোধী আর খ্রিস্টান-বিরোধী হিংসা দিয়ে বিজেপি সামাল দিতে পারবে না।

ভারতে সঙ্ঘ-পোষিত ঘৃণার কারবারিরা মুসলিম সংখ্যালঘুদের গণহত্যার হুমকি দিয়েই চলেছে; আর মুসলিম ও খ্রিস্টান ধর্মের প্রতিদিন হিন্দু আধিপত্যকামীদের হাতে বাষ্ট্র-পোষিত হিংসার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। শ্রীলঙ্কা প্রকৃতপক্ষে এক গৃহযুদ্ধের সাক্ষী থেকেছে যা শেষ হয়েছে তামিল-গণহত্যা দিয়ে। তখন থেকে শ্রীলঙ্কার শাসকরা শুধু যে মানবতার বিরুদ্ধে তাদের অপরাধের সমস্ত দায় এড়িয়ে চলেছে তাই-ই নয়, রাজনৈতিক ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে গণহত্যাকে পুঁজি করারও চেষ্টা করেছে। এবং তারা অন্যান্য সংখ্যালঘু-মুসলিম ও খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে নয়া নয়া ঘৃণার ঢেউকে ইন্ধন যোগানোর, এমনকি এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলিকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেওয়ারও চেষ্টা চালিয়ে গেছে। তামিল ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং সিংহল-আধিপত্যকামী জাতীয়তাবাদের বাগাড়ম্বর অনিষ্পন্নই থেকে গেল; আর সেখান থেকেই উন্মোচিত হল যে নিপীড়িতদের ‘পরাজয়’ অনিবার্যভাবেই ডেকে আনে সকলের পরাজয়। শ্রীলঙ্কার জনগণের থেকে ভারতীয়দের এই শিক্ষাটিও নিতে হবে।

ভীষণ দমনপীড়নের মুখেও গভীর সংকল্পবদ্ধ শ্রীলঙ্কার জনগণের অভ্যুত্থান ভারতীয়দের কাছে গভীর অনুপ্রেরণাদায়ক। প্রতিবাদী শ্রীলঙ্কার জনগণের জয় হোক! তাদের দৃষ্টান্ত ভারত এবং দক্ষিণ এশিয়ার সমস্ত দেশকে ঘৃণার রাজনীতি ও কর্পোরেট নয়া-উদারবাদী লুন্ঠণকে প্রত্যাখ্যান করতে এবং জনগণের অধিকার দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করতে অনুপ্রাণিত করুক!

- এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৬ মে ২০২২

 

খণ্ড-29
সংখ্যা-19