বিকল্প খামার গড়ার লড়াই
alternative farms

ঘুরে এলাম নিয়ামগিরি থেকে। দেখে এলাম নিয়ামগিরির পালিত পুত্রদের। দেখলাম বেদান্ত খনি কোম্পানিকে উৎখাত করতে চাওয়া নিয়ামগিরি কিভাবে পরম মমতায় বুকে টেনে নিয়েছে বাংলার অবহেলিত, অনাদৃত, দুই সন্তানকে। তাঁদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে খাদ্য স্বাধীনতার লড়াই গড়ে তুলেছে নিয়ামগিরির অন্য সন্তানেরাও।

ছোটখাটো এক দেশীয় ধানের চাষি হিসেবে বসুধা খামারে হাজির হয়েছিলাম দেশীয় প্রজাতির ধান সংরক্ষণের প্রাণপুরুষ দেবল দেব মহাশয়ের কাছে। আমার হাতে থাকা দুই প্রকার দেশী ধান প্রজাতি কলমকাঠি ও দেরাদুন গন্ধেশ্বরীর বিশুদ্ধতা নিয়ে সংশয় তৈরি হওয়ায় এই যাত্রা। আগামী বছরগুলোতে গাঁওতা খামারকে ক্রমে ক্রমে মানভূম অঞ্চলের পুরোনো ধানগুলোর একটা সংরক্ষণ ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য রসদ সংগ্রহও এই যাত্রার আর এক উদ্দেশ্য ছিল। জানা গেল কিভাবে পদে পদে অসহযোগিতায় নিজের কর্মক্ষেত্র উড়িষ্যার রায়গড়ায় স্থানান্তরিত করতে হয়েছে। জানলাম আদিবাসীদের জাহের থানের বহু বছরের পুরনো অনেক গাছ ফরেষ্ট ডিপার্টমেন্ট কেটে নেওয়ার বিরোধিতা করায় ঐ ডিপার্টমেন্ট তাঁকে ও দেবদুলালবাবুকে কাঠ চুরির কেসে ফাঁসিয়েছে। ধান ও পরিবেশের বিষয়ে গবেষণায় আন্তর্জাতিক স্তরের একাধিক গবেষণা পত্র থাকা এক বৈজ্ঞানিক ও তাঁর সহকারীকে এখনও নিয়মিত কোর্টে হাজিরা দিতে হয়। তৎকালীন বাম সরকার বা অধুনা তৃণমূল সরকার কেউই কোনো উদ্যোগ নেয়নি এ বিষয়ে। মিডিয়াও কোনো ষ্টোরি করেনি। বাংলার প্রতি একরাশ অভিমান নিয়ে জানালেন বিগত এগারো বছরে বাংলা থেকে যাওয়া আমি দ্বিতীয় চাষি যে বসুধা থেকে ধান বীজ আনতে গেছে।

অথচ একই সময়কালে অন্যান্য রাজ্য থেকে বহু চাষি ওনার থেকে ধান বীজ নিয়ে গেছেন এবং দায়িত্বের সঙ্গে সংরক্ষণ করছেন।

দেখলাম দেবলবাবুর তিন মানুষের বাহিনী কি অক্লান্ত পরিশ্রম করে বীজতলা থেকে পেকে যাওয়া প্রতি ধাপে প্রতি প্রজাতির ধানের ছাপান্ন রকম বৈশিষ্ট্য নজরে রেখে প্রায় চোদ্দশো প্রজাতির ধান সংরক্ষণ করছেন। সংরক্ষণের ধান বীজ ব্যাঙ্কে বিনা পারিশ্রমিকে ই-সংরক্ষণ করছেন স্থানীয় গ্রামের মানুষজন। কৃষি দফতরের আধিকারিকদের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে আধুনিক ধান প্রজাতির থেকে দেশী প্রজাতি বহুরূপীর বেশি ফলন দেখিয়েছেন আর এক প্রতিবেশি গ্রামের চাষি। দেবলবাবুর সাহচর্যে মিলেট সংরক্ষণের এক ক্ষেত্র গড়ে তুলেছেন আরো এক প্রতিবেশি।

সরকারি বেসরকারি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্য না নেওয়া, বসুধা পরিবারের সংসার চলে কৃচ্ছসাধন করেই। প্রায় দু’বিঘা জমির এই খামারের বেশিরভাগই আমন, আউস আর বোরো ধানের সংরক্ষণের কাজে ব্যবহার হয়। বাকি অংশে থাকার জন্য কাঁচা ইটের কুঁড়েঘর। কিচেন গার্ডেন, বড় গাছপালা, বুনোগাছ এইসব। নিয়ামগিরির আশীর্বাদে চব্বিশ ঘণ্টা ঝর্ণার জল পাইপ দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বণ্টনের ব্যবস্থা আছে। আলো জ্বলে সোলার সিস্টেমে। জিরো কার্বন ফুটপ্রিন্ট যাপনে বদ্ধপরিকর দেবলবাবুর পরিকল্পিত ড্রাই টয়লেট ব্যবহারের সুযোগ পাওয়া গেল।

কৃচ্ছসাধনে চলা এই প্রতিষ্ঠানের আন্তরিকতা বহুদিন মনে থাকবে।

সন্ধ্যায় ছ’রকমের দেশী ধানের বীজ আনা হল বীজ ব্যাঙ্ক থেকে। দেবলবাবু বার বার শপথ করালেন আগামী পঞ্চাশ বছর এই প্রজাতিগুলো বিশুদ্ধভাবে সংরক্ষণ করার দায়িত্ব নিতে। আমার মতো নভিসের দূর্বলতাকে মাথায় রেখে ছাপান্ন রকমের বদলে সাত আট রকমের বৈশিষ্ট্য নজরে রাখতে বললেন।

এ বিষয়ে সচিত্র ক্লাসও নিলেন। হাতে কলমে দু’একটা বৈশিষ্ট্য দেখালেন।

এই কটা ব্যাপারও আমার মতো অমনোযোগী ছাত্রের মাথায় তালগোল পাকিয়ে গেল। দেবদুলালবাবুকে সে কথা জানাতে তিনি বরাভয় দিলেন। জানালেন ফোন করে এবং সশরীরে আমাদের গাঁওতা খামারে এসে সমস্যা মেটাবেন।

আলাপ হলো গোলাপদির সঙ্গে। পেশায় শিক্ষিকা এই দিদি আগামীতে বসুধাতেই ডেরা গাড়বেন ঠিক করেছেন। আলাপ হলো দেবদুলালবাবুর পুত্র ও তার বন্ধুর সঙ্গে। এরা তথ্য প্রযুক্তির চাকচিক্যের যাপন ত্যাগ করে বসুধার আগামী দিনের সৈনিক হিসেবে গড়ে উঠছে।

পরদিন দুপুরে বেরিয়ে আসার সময় বসুধার ফাণ্ডে কিছু অর্থ দিতে গেলে দেবলবাবুর ভ্রু কুঁচকে গেল। জানতে চাইলেন ধানের দাম দিচ্ছি কিনা? বীজ বিনিময় যোগ্য, বিক্রয়যোগ্য নয়। এই আদর্শে ওনারা বিশ্বাসী। ওনার কাছে বীজ নিয়ে কেউ কেউ বীজের ব্যবসা করছেন বলে অভিযোগ করলেন। এখান থেকে বীজ পাওয়ার নিয়ম হল কোনো দেশী ধানের বীজ এক কেজি জমা দিয়ে আকাঙ্খিত বীজ নেওয়া যাবে। দেশী ধানের বীজ না থাকলে পরের বছর চাষ করে বীজ ফেরত দিতে হবে। দূরত্বের সমস্যা হলে যে যার নিজের এলাকার কোনো আগ্রহী চাষিকে ঐ বীজ দেবেন।

তিনজনের শক্তিতে কোনো রকমে ধান বীজ সংরক্ষণের কাজ চালিয়ে গেলেও পরিবেশ বান্ধব যাপনের অনেক দরকারি গবেষণার কাজ স্থগিত হয়ে আছে জানা গেল। মূলত অর্থবলের অভাবে। প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক সহায়তা না নিলেও ব্যক্তিগত আর্থিক সহায়তা ওখানে নেওয়া হয়। তারজন্য ব্রীহির ওয়েবসাইটে গিয়ে, কিভাবে অর্থ সাহায্য করা যায় দেখে নিতে পারেন। বিনোদন ভ্রমণে আগ্রহী মানুষজনকে ওনারা বসুধায় যেতে উৎসাহিত করেন না। কোন ধরণের মানুষজন ওখানে স্বাগত তা ওঁদের ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে।

- (ফেসবুকে কুণাল কেশরীর দেওয়াল থেকে)

খণ্ড-29
সংখ্যা-20