সারা ভারত কিষাণ মহাসভার নবম রাজ্য সম্মেলন সফল করে তুলুন
Conference of All India Kisan Mahasabha

সারা ভারত কিষান মহাসভার নবম রাজ্য সম্মেলন আগামী ৩০-৩১ আগস্ট নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর রবীন্দ্র ভবনে অনুষ্ঠিত হবে। শুরুতে ৩০ আগস্ট এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। বিষয় – ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের ৭৫ বছর এবং তার প্রেক্ষিতে বর্তমানে বাংলার কৃষক আন্দোলন। বিভিন্ন বামপন্থী কৃষক সংগঠন, কৃষক আন্দোলনের মঞ্চের নেতৃবৃন্দ এবং কিষাণ মহাসভার সর্বভারতীয় নেতৃত্ব এই আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখবেন। সম্মেলন স্থানের নামকরণ করা হয়েছে কৃষ্ণনগরের খাদ্য আন্দোলনের শহীদ আনন্দ হাইতের নামে। সভাগৃহ ও মঞ্চের নামকরণ হয়েছে যথাক্রমে নদীয়ার বিপ্লবী বামপন্থী নেতা বিমান বিশ্বাস ও সুবিমল সেনগুপ্তের নামে।

কৃষক সম্মেলনের মূল আওয়াজ থাকবে কৃষি-ব্যবস্থাকে দেশী-বিদেশী কর্পোরেটদের স্বার্থে পুনর্গঠিত করার বিরুদ্ধে কৃষকের স্বাধীনতা রক্ষার লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দাবি। ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের চাপে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারে বাধ্য হয়েছে, কিন্তু ওরা কর্পোরেট স্বার্থবাহী কৃষি নীতি লাগু করে চলেছে। আর এ রাজ্যে তৃণমূল সরকার ঘুরপথে সেই একই নীতি গ্রহণ করে চলেছে। রাজ্য সরকার কৃষি থেকে সম্পূর্ণ হাত গুটিয়ে নিয়েছে, কৃষি উৎপাদনে সহায়তা করা বা কৃষি পণ্যের বিপণন প্রভৃতি সমগ্র ক্ষেত্রগুলিকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। সার, বীজ, কীটনাশক প্রভৃতি কৃষি-উপকরণ থেকে শুরু করে কৃষি পণ্যের বাজার এখন নিয়ন্ত্রণ করছে দেশী-বিদেশী কোম্পানিগুলো। সাম্রাজ্যবাদীরা এমনকি কৃষি-উৎপাদনকেও নিয়ন্ত্রণ করছে, কৃষি কাজের অভিমুখ পাল্টে দিচ্ছে। কৃষক আন্দোলনের মঞ্চের পক্ষ থেকে এ রাজ্যে কৃষি-পণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণে আইন তৈরির দাবি জানানো হয়েছিল। এ জন্য একটা খসড়া বিল তৈরি করে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছিল। কারণ আইন ছাড়া ফসলের দাম নির্ধারণে কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠা হতে পারে না। কিন্তু রাজ্য সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি। এ রাজ্যে ধানের পরই প্রধান অর্থকরী ফসল আলু। এছাড়া নানাবিধ সব্জি, যার চাষাবাদ সম্প্রতি বেড়ে চলেছে, রাজ্য সরকার এ সমস্ত ফসলের সরকারি দর নির্ধারণ করে বেচাকেনা করা এবং বাজারে ন্যায্যমূল্যের দোকানের মাধ্যমে বিক্রি করার উদ্যোগ নিতে পারতো। এ জন্য ‘সুফল বাংলা’ নামক একটি সরকারি প্রকল্প চালু করা হয়েছিল। কিন্তু সেটাকে সীমিত করতে করতে প্রায় উঠিয়েই দেওয়া হয়েছে। সংরক্ষণের অভাবে প্রায় ২০/২৫ শতাংশ ফসল নষ্ট হয়ে চলেছে। এ জন্য ব্লকে ব্লকে কিষাণ মান্ডি বা নিয়ন্ত্রিত বাজার তৈরি করা ও হিমঘর স্থাপন করার কথা শোনা গিয়েছিল। কিন্তু তার কোনও সরকারি প্রচেষ্টা নেই। সম্প্রতি এ রাজ্যে কৃষিপণ্যের বিপণনে বেসরকারি কোম্পানিগুলির তৎপরতা বেড়ে চলেছে। যেমন বাঁকুড়া জেলা থেকে চুক্তি চাষের মাধ্যমে উৎপাদিত গাজর বা কুন্দ্রী সব্জি ওরা নিয়ে যাচ্ছে আরব দেশে। অথচ এ কাজ সরকারি উদ্যোগে করা যেতে পারতো।

কৃষকের আয়বৃদ্ধির যে কল্পকথা সরকার প্রচার করে থাকে তার বাস্তবতা নিয়ে পর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে। যা কৃষক সম্মেলনে চর্চা হবে। কৃষি পরিবারগুলির মোট আয়ের কতটা কৃষি থেকে, আর কতটা নানাবিধ পশুপালন থেকে আসছে, কিংবা পরিযায়ী হিসাবে ভিন্ন রাজ্যে বা দেশে কাজ করতে যাওয়া পরিবারের সদস্যদের আয় থেকে আসছে! সাদা চোখে এ বিষয়টা বিবেচনা করলে সহজেই বোঝা যায় কৃষিতে আদৌ লাভ হচ্ছে না। কৃষি কাজে নিয়োজিত অত্যধিক মাত্রায় পারিবারিক শ্রমশক্তির দাম কোনোরকমে উঠছে বলা যেতে পারে।

বর্তমানে পরিবর্তিত কৃষি উৎপাদনের প্রেক্ষিতে কৃষি উপকরণের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় কৃষকের সংকট বিরাট মাত্রায় বেড়ে গেছে। চাষের ধরন ও জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে কৃষিতে খরচ বড় আকারে বেড়ে গেছে। যেমন বৃষ্টিপাতের অভাবে পাট চাষে জল কিনে পাট ভেজাতে হচ্ছে, আগের তুলনায় সারের ব্যাবহার বাড়িয়ে দিতে হয়েছে। অন্যান্য চাষাবাদের ক্ষেত্রেও এই ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু রাজ্য সরকার সমবায়ের মাধ্যমে স্বল্প দামে সার বীজ সরবরাহ করে, বিশেষত গরিব মাঝারি চাষিদের কিছুটা সুরাহা করতে পারতো। কিন্তু এ সমস্ত কিছুই এখন প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পুঁজিবাদী চাষে প্রয়োজনীয় উপাদান পুঁজি। গরিব মধ্য চাষিদের বিনা সুদে বা নামমাত্র সূদে কৃষিঋণ সরবরাহের ব্যবস্থা আগে কিছু মাত্রায় হলেও বর্তমানে সম্পূর্ণ বন্ধ। কৃষি সমবায়গুলির কোনো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নেই, সেগুলি সীমাহীন দুর্নীতির আখরা হয়ে উঠেছে। নিরপেক্ষ তদন্ত হলে এ রাজ্যে কোটি কোটি টাকার সমবায় দুর্নীতি ধরা পড়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা মজুত রয়েছে। সারের চোরাকারবার একেবারে প্রকাশ্যে চলছে। খোলা বাজারে এমআরপি বা ছাপানো দামের থেকে ২০০/২৫০ টাকা বেশি দিয়ে সার কিনতে হচ্ছে। সরকারি মদতেই এসব ঘটে চলেছে। সেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণে তৃণমূল সরকারের আদৌ কোনো পরিকল্পনা নেই। ভূপৃষ্ঠ সেচ – জল উত্তোলন প্রকল্পগুলি অর্ধেকই বন্ধ। বিগত ১০ বছরে সেচের নতুন কোনো প্রকল্প হয়নি। এ বছর সেচের জল সরবরাহ না করার ফলে বেশ কিছু এলাকায় বোরো চাষ মার খেয়েছে। জলাধারগুলি সংস্কারের কোনো ব্যবস্থা নেই। কৃষি ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ মাশুলে ভর্তুকির দাবি দীর্ঘদিন ধরে তুলে ধরা হলেও সরকার তাতে কোনো সাড়া দিচ্ছে না। অথচ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের সরকার কৃষিতে ভর্তুকির ব্যবস্থা করেছে।

কৃষিতে আংশিক ভূমি সংস্কার হলেও ক্ষুদ্র মধ্য চাষিরা তাদের কৃষি কাজের বিকাশে পরবর্তী আর কোনও সরকারি সহায়তা পায়নি, বরং এ ক্ষেত্রে এক উল্টোযাত্রার প্রক্রিয়া চলছে। সম্প্রতি প্রজাস্বত্বের ধরনে একটা বড়ো ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে৷ ভালো পরিমানে কৃষি জমিতে চুক্তিচাষের প্রবণতা বেড়ে চলেছে। কৃষি উৎপাদনে এদের শ্রমশক্তি বিরাট মাত্রায় যুক্ত অথচ এই গরিব চুক্তিচাষিদের স্বার্থ রক্ষায়, তাদের সরকারি প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করার প্রশ্নে সরকারের কোনো ভাবনা নেই। এই প্রশ্নগুলি সম্মেলনে আলোচিত হবে। সম্মেলনে এক প্রস্থ দাবিসনদ তৈরি করা হবে, যেটা হয়ে উঠবে কিষাণ মহাসভার পরিচিতি। গ্রামাঞ্চলে পশুপালন, দুগ্ধ উৎপাদন, ফল ফুল প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের বাগিচা চাষ, মৎস্য উৎপাদন প্রভৃতি নানাবিধ ক্ষেত্রে লক্ষ লক্ষ মেহনতি মানুষ যুক্ত। এদের স্বার্থরক্ষার প্রশ্নগুলিও সম্মেলনে আলোচিত হবে, এদের দাবিগুলিও দাবিসনদে যুক্ত হবে। কর্পোরেটের কব্জা থেকে মুক্ত ক্ষুদ্র কৃষি অর্থনীতির বিকাশের লক্ষ্যে কৃষিনীতি প্রণয়নের দিশায় সম্মেলন এক সার্বিক পরিকল্পনা গ্রহণ করবে।

রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় গ্রামে গ্রামে সদস্য সংগ্রহ অভিযান চলছে৷ বৃষ্টিপাতের অভাব, চাষের মরসুম শুরু হয়ে যাওয়া এসমস্ত কিছু জটিলতার মধ্যেও কর্মীরা গণসংযোগ অভিযান সংগঠিত করছেন। ব্লক স্তরে কিষান মহাসভার কাঠামো তৈরি করে সংগঠক ও কর্মীরা সম্মেলনকে সফল করে তোলার প্রচেষ্টা জারি রেখেছেন।

খণ্ড-29
সংখ্যা-36