সেন্ট জেভিয়ার্স ইউনিভার্সিটির পিতৃতান্ত্রিক আস্ফালন : নারীর পোশাক নিয়ে কেন এই অশ্লীল উদ্বেগ?
St. Jevier's University

২০২১ সালের নভেম্বর মাসে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ কর্তৃপক্ষ সহকারী অধ্যাপক পদে কর্মরত এক শিক্ষিকাকে তার কাজ থেকে বরখাস্ত করে কোনোরকম নোটিশ ছাড়াই। বেআইনি বরখাস্ত হওয়ার বিরুদ্ধে শিক্ষিকা যাদবপুর থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। কিছুদিনের মধ্যে কলেজ কর্তৃপক্ষকে আইনি নোটিশ পাঠান। জবাব হিসাবে জেভিয়ার্স কর্তৃপক্ষ ৯৯ কোটি টাকার মানহানির মামলা করে শিক্ষিকার বিরুদ্ধে। শিক্ষিকা ইন্সটাগ্রাম নামক একটি সামাজিক মাধ্যমে নিজের কয়েকটি ছবি দিয়েছিলেন। ছবিতে তিনি সাঁতারুর স্যুট ও হটপ্যান্ট পরে ছিলেন। এই ছবি ইন্সটাগ্রামে দেখে এক পড়ুয়ার অভিভাবক জেভিয়ার্স কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানান এই মর্মে যে, অধ্যাপিকার স্বল্পবাস ছবি দেখা অভিভাবক হিসাবে তার কাছে লজ্জার বিষয় এবং একজন পড়ুয়ার কাছে নিজের শিক্ষিকাকে স্বল্প পোশাকে দেখা অশ্লীল ও অনুচিত। বরখাস্ত হওয়া শিক্ষিকা সম্প্রতি একটি সংবাদপত্রের সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তার ব্যক্তিগত ইন্সটাগ্রাম হ্যান্ডেলের ছবি ডাউনলোড করে কাগজে প্রিন্ট করিয়ে শিক্ষিকাকে ডাকা হয় জেভিয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর ফিলিক্স রাজের অফিসে। প্রিন্ট করা ছবিগুলি শিক্ষিকাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করা হয়, এই ছবিগুলি তার কিনা। শিক্ষিকা সম্মতিসূচক উত্তর দেওয়ার সাথে সাথে তাকে বরখাস্তের নিদান জানানো হয়। বলা হয় অধ্যাপিকার ছবি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচরণবিধি ও পোশাকবিধির অনুকূল নয়। শ্লীলতার কথা তোলা অভিভাবক ও হর্তাকর্তাদের কাছে প্রশ্ন হল, শ্লীল আর অশ্লীল বিচার করার তাঁরা কে? কার স্বার্থে কে আচরণ আর পোশাক বিধি নির্ধারণের ক্ষমতাধর? একজন নারীর ব্যক্তিগত পরিসরে ঢুকে তার ছবি চাউড় করে চরিত্র হনন করা কী অসমীচীন নয়? কর্মক্ষেত্রের বাইরে ব্যক্তি-জীবনে একজন নারীর পোশাক নির্বাচনের উপর ভিত্তি করে তার কাজ কেড়ে নেওয়া কী অনুচিত নয়? শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের উপাচার্য ও রেজিস্ট্রার পদে বসে থাকা পুরুষদের ক্ষমতার সিঁড়িতে অনেক নীচের অবস্থানে থাকা সহকর্মী নারীর ব্যক্তি-জীবনের পোশাক নিয়ে জ্ঞান দেওয়া কী অশ্লীল নয়?

শরীর ও যৌনতার স্বাতন্ত্র‍্যে বিশ্বাসী মেয়েরা সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান (যেমন, পরিবার, কর্মক্ষেত্র, রাষ্ট্র)-এর কাছে ভয়ের কারণ। শঙ্কা এই কারণে যে, মেয়েরা নিজের শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে তারা সমাজের মাতব্বর পুরুষদের সুবিধার্থে বানানো পিতৃতান্ত্রিক নিয়মনীতির ভিত নাড়িয়ে দিতেও সক্ষম। মেয়েরা যদি নিজের শরীরকে লজ্জ্বার উৎস মনে না করে, কাল সে সন্তান জন্ম দেওয়ার থেকে বেশি গুরুত্ব দেবে নিজের পেশাকে, নিজের জীবনসঙ্গী বাছতে চাইবে নিজের শর্তে, তথাকথিত সম্ভ্রমের বদলে বাছবে স্বাধীনতা, রক্ষাকর্তার বদলে পুরুষকে দেখতে চাইবে সহ-নাগরিকের চোখে। এক্ষেত্রে কলকাতার বিশিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেন্ট জেভিয়ার্সের ক্ষমতার আস্ফালন মেয়েটির কর্মসংস্থান কেড়ে নেওয়াতে সীমিত থাকেনি। কাজ হারানো মেয়েটি আইনি পথে নিজের উপর হওয়া অন্যায়ের বিচার চাইলে সেন্ট জেভিয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ৯৯ কোটি টাকার মানহানির মামলা করেছে মেয়েটির বিরুদ্ধে। সোজা কথায়, ‘ঘর’এর (অর্থাৎ যেকোনো সামাজিক প্রতিষ্ঠানের) মধ্যে হিংসা চলবে কিন্তু ‘ঘর’এর কথা বাইরে গেলে সম্মানহানির ভয়ে দাঁত নখ বের করে আক্রমণ চলবে প্রতিবাদী স্বরের বিরুদ্ধে।

একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে একজন নারীর ব্যক্তিগত পরিসর ও পোশাকের স্বাধীনতার উপর এহেন নীতি-পুলিশীর নির্দশন হজম করতে কঠিন লাগলেও এটাই বাস্তব। আমাদের আশেপাশে, কর্মস্থলে, পরিবারে, রাস্তায়, পার্কে, স্কুল ও কলেজে মেয়েদের পোশাক-বিধি জারি করা থুরি শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণের উদাহরণ থরে থরে সাজানো। মেয়েদের শরীর কতটুকু ঢাকা যাবে আর কতটুকু যাবে না তার সীমারেখা তৈরির দায়িত্ব নিয়ে রেখেছেন সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাতব্বরেরা। অথচ, নারীর শরীরকে উপভোগ্য আর নিয়ন্ত্রণযোগ্য বস্তু ভাবার মানসিকতাকে বদলানোর প্রচেষ্টা বিরল। যার শরীর তার ইচ্ছা ও স্বাতন্ত্রকে মান্যতা দেওয়ার বদলে নিয়ন্ত্রণই দস্তুর। নিয়ন্ত্রণই সহজ। তাই হিজাব হোক বা জিন্স-প্যান্ট, মেয়েদের নিজেদের বেছে নেওয়া পরিধানের উপর হস্তক্ষেপ করার বিষয় রাষ্ট্র থেকে শিক্ষাক্ষেত্র, কর্মক্ষেত্র, পরিবার কেউ পিছিয়ে নেই। যে প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা যত বেশি তার আস্ফালনের মাত্রা তদুপরি ভয়ানক।

সেন্ট জেভিয়ার্সের পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতার আস্ফালনকে সামনে থেকে প্রতিহত করছেন বরখাস্ত হওয়া শিক্ষিকা। তার পাশে দাঁড়িয়ে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন, পথে নেমেছেন সেন্ট জেভিয়ার্সের প্রাক্তন পড়ুয়া থেকে শুরু করে অন্যান্য পড়ুয়া, শিক্ষক সমাজ, রাজনৈতিক কর্মী ও সাধারণ মানুষ। আগামীতে এই লড়াইকে সংঘবদ্ধ করতে ও পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতার আস্ফালনকে সমূলে উপড়ে ফেলতে ঐক্যবদ্ধ ও সচেতন প্রয়াস প্রয়োজন ‘ঘরে’ ও ‘বাইরে’।

- সম্প্রীতি মুখার্জী

খণ্ড-29
সংখ্যা-36