প্রতিবেদন
মোচ্ছব অফুরন্ত অথচ ভাঁড়ে মা ভবানী
clown is Maa Bhabani

মহা আড়ম্বরে এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মাধ্যমে দুর্গাপুজোর প্রায় এক মাস আগে বাংলায় ঢাকের বাদ্যি বেজে গেল। চোখধাঁধানো এই জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে কত খরচ হয়েছে তার কোনও হিসেব নেই। ঠিক একদিন আগে মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু জানিয়ে দিয়েছেন যে রাজ্যের ভাঁড়ার শূন্য, অথচ ঐ মঞ্চ থেকেই ক্লাব-কমিটি প্রতি পুজোর অনুদান একলাফে ৫০০০০ থেকে ৬০০০০ টাকা করে দিয়েছেন, বিদ্যুতে ছাড় বাড়িয়ে দিয়েছেন ৫০ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশ। বাঙালির সেরা উৎসব পুজোয় লোকে আনন্দে থাকুক, মনকে খুশি রাখুক, উন্মুক্ত রাখুক এটা কে না চায়, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কৃত্তিম এই আলোর নিচেই তো অন্ধকার। মিড-ডে-মিলের জন্য টাকা নেই, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলির জন্য টাকা নেই, দীনদরিদ্র মানুষ কয়েক মাসে ধরে একশো দিনের কাজের টাকা পাননি, সরকারি কর্মীরা দীর্ঘ দিন ধরে মহার্ঘ ভাতা থেকে বঞ্চিত, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, কর্মীরা পেনশন পাচ্ছেন না, রোদ-ঝড়-জল, পুলিশ প্রশাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে চাকরিপ্রার্থীরা বহু মাস ধরে আন্দোলনরত। তবুও মোচ্ছব চলছে, তিনি আশ্বস্ত করেছেন কুছ পরোয়া নেহি, মা দুর্গা ভাঁড়ার পূর্ণ করে দেবেন!

প্রকারান্তরে আমাদের এক বিভ্রমের মধ্যে, বালিতে মুখ গুঁজে দিন গুজরান করতে বলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে উপরোক্ত সমস্ত সমস্যাগুলিই কেন্দ্রীয় সরকারের সৃষ্টি, রাজ্য সরকারের এখানে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকা ছাড়া কোনও উপায় নেই। সবাই জানেন গত কেন্দ্রীয় বাজেটে আইসিডিএস, মিড-ডে-মিল, একশো দিনের কাজ ইত্যাদি সামাজিক প্রকল্পের বরাদ্দ অর্থ কেন্দ্রের বিজেপি সরকার কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এটা বলাই কি যথেষ্ট? রাজ্য সরকারের কি কিছুই করণীয় নেই? পুজোর অনুদান বাড়ানো যেতে পারে, কিন্তু শিশুদের সুষম খাদ্য দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায় না? প্রায় আড়াই বছর আগে মিড-ডে-মিলের জন্য বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। এরপরে আকাশছোঁয়া মুল্যবৃদ্ধি হলেও, রান্নার গ্যাসের দাম চড়চড় করে বাড়লেও বরাদ্দ বাড়ানো হয়নি। প্রাথমিক স্তরের বাচ্চাদের জন্য বরাদ্দ দিনপ্রতি ৪.৯৭টাকা, অথচ একটা ডিমের দামই ৬ টাকা। এর ফলে বাংলার স্কুলগুলিতে যেখানে আগে সপ্তাহে দুদিন ডিম দেওয়া হোত, এখন দেওয়া হয় একদিন। খাদ্যে তরকারি বলতে আলু, কদাচিৎ সোয়াবিন। প্রোটিনের পরিমাণ ২০ গ্রাম থেকে কমে ১০ গ্রাম হয়ে গেছে। রাজ্যের বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি করলেই সরকারের একগুঁয়ে মন্তব্য, কেন্দ্র না বাড়ালে আমরা বাড়াবো না। শিক্ষকরা নিজেদের গ্যাঁট থেকে খরচ করে বাচ্চাদের খাইয়ে যাচ্ছেন, নাহলে বহু স্কুলে এই প্রকল্প বন্ধই হয়ে যেত।

অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলির অবস্থা তো আরও খারাপ। কেন্দ্রীয় সরকার এদের নির্দয়ভাবে বঞ্চিত করছে। এদের আর্থিক বরাদ্দ শেষবার বাড়ানো হয়েছে অক্টোবর, ২০১৭তে। গত কয়েক বছর ধরে এঁরা ধারাবাহিক ভাবে কাজের স্থায়ীকরণ, মাসিক ভাতা বৃদ্ধি, শিশু ও মহিলাদের খাদ্যের জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধির জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছেন। কয়েক বছর ধরে এঁদের ভাতার কোনও বৃদ্ধি হয়নি। পশ্চিমবাংলায় একজন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী পান ৮২৫০ টাকা, তাঁর সহযোগী পান ৬৩০০ টাকা। এই সামান্য টাকা সত্ত্বেও এমনও বহু দৃষ্টান্ত আছে যেখানে কর্মীরা মহাজনের থেকে ধার নিয়ে কেন্দ্র চালু রেখেছেন, কিংবা গয়না বন্ধক রেখে পরিষেবা দিয়েছেন। বোঝাই যায় এইসব কেন্দ্রগুলিকে এখন চালু রাখাই একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে এক অন্তঃসত্ত্বা মহিলার জন্য বরাদ্দ দিনপ্রতি মাত্র ৯.৫০টাকা, ছয় মাস থেকে ছয় বছরের বাচ্চার জন্য বরাদ্দ সাকুল্যে ৮ টাকা! এতে কী হয়? কিন্তু তৃণমূল সরকারের এক গৎ, কেন্দ্র বরাদ্দ না বাড়ালে আমাদের কিছু করার নেই! পরিস্রুত পানীয় জলের অভাবে সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে। গাঁও কানেকশনের একটি তথ্য অনুযায়ী বাংলায় মাত্র ৫.৭৯ শতাংশ অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে পরিস্রুত জল সরবরাহ হয় যা অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় অত্যন্ত শোচনীয়। এর ফলে দূরদূরান্ত থেকে মহিলাদের জল বহন করে আনতে হয়। এই জল অনেক ক্ষেত্রেই অপরিষ্কার, অস্বাস্থ্যকর যা খাদ্যের গুণমানকে নষ্ট করে।

একশো দিনের কাজের প্রকল্পটি একটা গোলকধাঁধার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই খাতে কেন্দ্রের থেকে রাজ্যের কয়েক হাজার কোটি টাকা বকেয়া পাওনা আছে; কেন্দ্র এই টাকা দিতে নারাজ কারণ তাদের মতে এই প্রকল্পের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি; মাঝখান থেকে লক্ষাধিক দিনমজুর কয়েক মাসের পাওনা থেকে বঞ্চিত। কেন্দ্র এই প্রকল্পকে দুর্নীতিমুক্ত করবার জন্য নতুন নিদান দিয়েছেঃ প্রতিটি পঞ্চায়েতে হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ খুলতে হবে, যাতে স্থানীয় সাংসদ, বিধায়ক, প্রধান, সরকারি অফিসার সদস্য হবেন; নিরপেক্ষ সংস্থাকে দিয়ে নিয়মিত অডিট করাতে হবে, উচ্চপদস্থ অফিসারদের দশটি কাজের জায়গায় পরিদর্শনে যেতে হবে ইত্যাদি। আজব সরকারি নির্দেশ! গ্রামবাংলায় বহু জায়গায় নেট কানেকশন নেই, অথবা দুর্বল বা অনিয়মিত, সেখানে সর্বত্র হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ খুলতে বলা ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে ঘাস খাওয়ার শামিল! এছাড়া সর্ষের মধ্যেই তো ভূত! পঞ্চায়েত, রাজনৈতিক নেতা এবং আমলারাই এই প্রকল্পের দুর্নীতির মুলে, যার ফলে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রকল্পটিকে দুর্নীতিমুক্ত করার কোনও উদ্যোগ এখন অবধি রাজ্য সরকারের তরফ থেকে দেখা যায়নি।

২০২১ সালে বিপুল জনাদেশ নিয়ে তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল। আশা করা গিয়েছিল  মোচ্ছবের পরিবর্তে তারা বুনিয়াদি প্রকল্পগুলি আরও শক্তিশালী করার ওপর জোর দেবেন। কিন্তু তারা সস্তায় বাজিমাত করতে চান। তারা চমক দেখাতে পছন্দ করেন। জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের চেয়ে টাকাপয়সা ছড়িয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার করতেই তারা বেশি আগ্রহী।

– সোমনাথ গুহ

খণ্ড-29
সংখ্যা-35