খবরা-খবর
বিশ্বব্যাপী বাড়ছে আধুনিক দাসত্ব
Modern slavery

আধুনিক দাসত্বের বৈশ্বিক অনুমান আধুনিক দাসত্বের মাত্রা এবং গভীরতার একটি চিত্র প্রদান করে। ২০১৭ সালের অনুমান অনুযায়ী আধুনিক দাসপ্রথা ন্যায়বিচার ও উন্নয়ন বিরোধী। বিশ্বব্যাপী ৬৮টি দেশে জোরপূর্বক শ্রম ও ৭৫টি দেশে জোরপূর্বক বিবাহের ওপর একটা জরিপ করা হয়, তাতে ২০২১ সালে আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা, ওয়াক ফ্রি এবং ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশনের মতে আধুনিক দাসত্বের পরিস্থিতিতে প্রায় ৫ কোটি মানুষকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছে বা তাদের বাধ্য করা হয়েছে জোরপূর্বকভাবে বিবাহ করতে। অর্থাৎ সেই সংখ্যা অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি ১৫০ জনের মধ্যে একজন এর শিকার। টার্গেট ৮.৭ হল জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপিং গোলস্ বা ‘এসডিজি’র লক্ষ্যমাত্রা পূরণের একটি বেসলাইন, যা সাধারণত নারী ও মেয়েদের ওপর সহিংসতা দুর করার বিষয়ে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও যা জোরপূর্বক শ্রম, আধুনিক দাসত্ব, এবং মানব পাচার, সেইসাথে শিশু শ্রম বন্ধ করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আহ্বান জানায়।

২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রায় ২.৪৯ কোটি মানুষ জোরপূর্বক শ্রমের আওতায় ছিল। অর্থাৎ তাদেরকে হুমকি বা জবরদস্তিতে কোনো গোপন কারখানায় বা খামারে কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। ১.৫৪ কোটি মানুষ জোরপূর্বক বিবাহের শিকার। অর্থাৎ তারা তাদের যৌন স্বয়ত্তশাসন হারিয়েছিল। আধুনিক এই দাসপ্রথা বা দাসত্বের এই ব্যবস্থায় মহিলা বা মেয়েরাও পিছিয়ে নেই। এরমধ্যে প্রায় ৭১ শতংশ বা ২.৮৭ কোটি হলো মহিলা। এই মহিলা বা নারীদের প্রায় ৯৯ শতংশই বাণিজ্যিক যৌন সংস্থার শিকার। আর বাকি খাতেও মহিলা এবং মেয়েদের কাজ করানো হয়। এছাড়াও এই আধুনিক দাসত্বের শিকার চারজনের মধ্যে একজন শিশু। গত পাঁচ বছরে, প্রায় ৮.৯ কোটি মানুষ আধুনিক দাসত্বের কোনো না কোনো রূপের অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন। সারা বিশ্ব জুড়েই এই আধুনিক দাসপ্রথা চলে এসেছে, এবং যা জাতিগত, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় রেখাজুড়ে বিভক্ত। যার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি দেখা যায় আফ্রিকায়, তারপর এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জোরপূর্বক শ্রমের ওপর যে পরীক্ষা নেওয়া হয় তাতে দেখা যায়, বাধ্যতামূলক শ্রমের শিকার প্রায় ২৪.৯ কোটি মানুষ। তারমধ্যে আবার ১.৬ কোটি ব্যক্তিগত অর্থনীতিতে, ৪৮ লক্ষ যৌন শোষণে এবং প্রায় ৪১ লক্ষ মানুষ রাষ্ট্রীয় কতৃপক্ষের দ্বারা চাপিয়ে দেওয়া বাধ্যতামূলক শ্রমশক্তির শিকার। এছাড়াও জোরপূর্বক শ্রমের বেশিরভাগ ঘটনা (৮৬ শতংশ) বেসরকারি খাতে পাওয়া যায়। পুরুষদের চেয়ে মহিলারা বেশি এই জোরপূর্বক বা বাধ্যতামূলক শ্রমের শিকার হন। প্রাপ্তবয়স্কদের এই সব শ্রমের মধ্যে ছিল, গৃহকর্মী, নির্মাণ শ্রমিক, ম্যানুফ্যাকচারিং এবং কৃষি ও মাছ ধরা। অন্যদিকে জোরপূর্বক বাণিজ্যিক যৌন শোষণের পাঁচজনের মধ্যে প্রায় চারজনই নারী বা মেয়ে। বাধ্যতামূলক শ্রমের আটজনের মধ্যে প্রায় একজন শিশু (৩৩ লক্ষ)। এরমধ্যে অর্ধেকের বেশি ব্যবসায়িক যৌন শোষণের শিকার।

২০২১ সালের গণনা অনুযায়ী প্রায় ২ কোটি মানুষ জোরপূর্বক বিবাহে আবদ্ধ। এটি ২০১৬ সালের বৈশ্বিক অনুমান থেকে ৬৬ লক্ষ বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও পুরুষ এবং ছেলেরাও জোরপূর্বক বিয়ের শিকার হতে পারে, তবে মহিলা এবং মেয়েরাই বেশিরভাগ (৮৮ শতংশ) এর শিকার। যারমধ্যে এক তৃতীয়াংশেরও বেশি (৩৭ শতংশ) মেয়েদের বিয়ের সময় বয়স ১৮ বছরের থেকেও কম ছিল। আবার এই রকম বিবাহে বিশেষ করে ১৬ বছর বা তার কম বয়সী শিশুরা জড়িত, কারণ একটি শিশু আইনত বিয়েতে সম্মতি দিতে পারে না। তাই বাল্যবিবাহও জোরপূর্বক বিয়ের অন্তর্ভুক্ত। জোরপূর্বক বিবাহ দীর্ঘস্থায়ী পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব এবং অনুশীলনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত এবং এটি অত্যন্ত প্রসঙ্গ নির্দিষ্ট। বেশিরভাগ (প্রায় ৮৫ শতংশ) বিয়েই পারিবারিক চাপ দ্বারা চালিত। এবং জনসংখ্যার ওপর ভিত্তি করে দেখা যায়, এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এই প্রকার বিয়ের সংখ্যা বেশি।

অ-অভিবাসী শ্রমিকদের তুলনায় অভিবাসী শ্রমিকদের জোরপূর্বক শ্রমে নিযুক্ত হওয়ার সংখ্যা প্রায় তিন গুণ বেশি। ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন বা ‘আইওএম’র মহাপরিচালক আন্তোনিও ভিতোরিনো বলেছেন, “অভিবাসীদের জোরপূর্বক শ্রম এবং ব্যক্তিদের পাচারের ঝুঁকি হ্রাস করা প্রভৃতি নির্ভর করে অভিবাসীদের মানবাধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতাকে সম্মান, সুরক্ষা আইনের ওপর। বিশ্বজুড়ে অভিবাসন সংক্রান্ত এই কম্প্যাক্ট এবং এইসব প্রবণতাগুলিকে পাল্টাতে সমগ্র সমাজকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।”

বৈশ্বিক অনুমান অনুসারে, জোরপূর্বক শ্রম এবং জোরপূর্বক বিবাহ এখনও প্রত্যাহার করা হয়নি তবে ২০৩০ সালের মধ্যে আধুনিক দাসত্ব এবং মানব পাচারের অবসান ঘটাতে একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ হবে। আইএলও’র প্রতিবেদনে বেশ কয়েকটি প্রস্তাবিত পদক্ষেপের প্রস্তাব করা হয়েছে যা একসাথে এবং দ্রুত নেওয়া হলে আধুনিক দাসত্বের অবসানের দিকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হবে। সাধারণত, দারিদ্র, আকস্মিক চাকরি হারানো, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অর্থনৈতিক সংকট ইত্যাদি সমস্যাগুলিও মানুষকে আধুনিক দাসত্বের দিকে ঠেলে। আইএলও অনুমান করে যে, কিছু অগ্রগতি হলেও, ৫০ লক্ষেরও বেশি মানুষের পর্যাপ্ত সামাজিক সুরক্ষা নেই। ক্যাশ ট্রান্সফার স্কিম, সরকারি কর্মসংস্থান কর্মসূচি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, মাতৃত্ব সুরক্ষা, অক্ষমতার সুবিধা, বেকারত্ব সুরক্ষা, এবং বৃদ্ধ বয়সে আয় সুরক্ষা সবই একটি সুপরিকল্পিত সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে প্রাসঙ্গিক যা বাধ্যতামূলক শ্রমের দিকে পরিচালিত করতে বাধা দিতে পারে। এবং জোর করে বিয়ের ঝুঁকিও কমায়। এছাড়াও সকলের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বৈশ্বিক অনুমানগুলি আধুনিক দাসত্বের দ্বারা কীভাবে প্রভাবিত হয় তার পরিপ্রেক্ষিতে নারী এবং পুরুষের মধ্যে সমর্থক পার্থক্য নির্দেশ করে। বিশেষ করে, মহিলা এবং মেয়েরা বেসরকারী অর্থনীতিতে (গৃহস্থালির কাজ এবং বাণিজ্যিক যৌন শোষণ সহ) এবং জোরপূর্বক বিয়ে এবং জোরপূর্বক শ্রমের শিকার হয়। আইএলও’র প্রতিবেদনের পদক্ষেপগুলির মধ্যে রয়েছে — আইনি সুরক্ষার উন্নতি এবং প্রয়োগ এবং শ্রম পরিদর্শন, রাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত বাধ্যতামূলক শ্রমের অবসান, জোরপূর্বক শ্রম এবং মানুষ পাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য শক্তিশালী পদক্ষেপ, সকলের সামাজিক সুরক্ষা প্রসারিত করা, বিয়ের বয়স কমপক্ষে ১৮ বছরে উন্নীত করা। অন্যান্য পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে অভিবাসী কর্মীদের পাচার এবং জোরপূর্বক শ্রমের বর্ধিত ঝুঁকি এড়াতে ন্যায্য ও নৈতিক নিয়োগের প্রচার, এবং নারী, মেয়ে এবং দুর্বল ব্যক্তিদের জন্য বৃহত্তর সমর্থন।

- অবন্তী

খণ্ড-29
সংখ্যা-38