জাতীয় শিক্ষানীতি ও প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা
Pre-Primary Education

জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে প্রথম তিন বছরের শিক্ষা বা তিন থেকে ছয় বছর পর্যন্ত শিক্ষা হবে অঙ্গনওয়ারিগুলিতে। বর্তমান অঙ্গনওয়ারি কর্মীরা এই শিক্ষাদানের কাজ করবেন। অঙ্গনওয়ারির কর্মীরা এরজন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ পাবেন। প্রশিক্ষণে উত্তীর্ণ হলেই তারা শিক্ষক হিসাবে কাজ করবেন। পরবর্তী দু’বছরের ভিস্তিস্থাপক স্তরে অর্থাৎ ছয় থেকে আট বছরের শিশুদের ক্ষেত্রেও এরাই শিক্ষকতা করবেন অর্থাৎ পুরো পাঁচ বছর এরা শিশুদের শিক্ষার দেখভাল করবেন। এদের বলা হবে আর্লি চাইল্ডহুড কেয়ার অ্যান্ড এডুকেশন বা ‘ইসিসিই’ শিক্ষক।

ভারতবর্ষে প্রতিবছর মোটামুটি আড়াই কোটি শিশু জন্মায়। খুব কমপক্ষে যদি দু’কোটি শিশুও প্রতিবছর বেঁচে থাকে, তাহলেও পাঁচ বছরে অন্তত দশ কোটি শিশুকে ইসিসিই শিক্ষকরা শিক্ষা দেবেন। এই ধরনের উচ্চমানের শিক্ষা দিতে হলে ছাত্র শিক্ষকের অনুপাত রাখতে হবে ৩০:১ (ধারা ২.৩)। এই হিসাব অনুযায়ী ত্রিশ লক্ষের ওপর ইসিসিই-প্রশক্ষিত শিক্ষক লাগবেই। জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে নতুন শিক্ষানীতির সবকটা দিকই ২০৩০ সালের মধ্যে রূপায়ণ করতে হবে। যদি ধরা যায় যে শিক্ষানীতি সামনে আসার পর থেকে দশ বছর সময় হাতে আছে, তাহলেও প্রতিবছর তিন লক্ষ শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কোথায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, তার ব্যয়ভার কে বহন করবে?

সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে অঙ্গনওয়ারির বর্তমান শিক্ষকদের মধ্যে যারা ১০+২ পাশ করে এসেছে, তাদের ৬ মাসের একটা অনলাইন কোর্স পড়িয়ে নিলেই তারা উচ্চমানের শিক্ষক হয়ে উঠবে (ধারা ১.৭)। আর যারা পাশ করা নয়, তাদের জন্য লাগবে একবছরের অনলাইন কোর্স। এই কোর্সগুলি তারা স্মার্টফোনের সাহায্যে তাদের বর্তমান কাজ করার সাথে সাথে পড়ে নিতে পারবে। শুধু তাদের পরীক্ষা নেবে একটি কেন্দ্রীয় টিম। শিশুশিক্ষায় উপযুক্ত শিক্ষক তৈরি করার প্রণালী নিয়ে যখন সারা পৃথিবী তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে, তখন কী সুন্দর সহজ সমাধান আমরা দিয়ে দিলাম। বলা হয়েছে এই ধরনের উচ্চমানের ইসিসিই ক্যাডার তৈরির দায়িত্ব রাজ্য সরকারের (ধারা ১.৭)। সামান্য হিসাব করলেই বোঝা যাবে যে উচ্চমানের ইসিসিই ক্যাডার তৈরির জন্য আর্থিক সঙ্গতি কোনও রাজ্য সরকারের নেই। ফলে শিক্ষক তৈরি হবে না, রাইট টু এডুকেশনও কার্যকরী হবে না।

কিছুদিনের মধ্যেই টের পাওয়া যাবে যে ১০+২ যারা পাশ করেছে তাদের ছয় মাসের অনলাইন কোর্স পড়িয়ে বা যারা কিছুই পাশ করেনি তাদের এক বছরের কোর্স পড়িয়ে কোনও উচ্চমান কেন নিম্নমানের শিক্ষকও তৈরি করা সম্ভব নয়। একমাত্র সুশিক্ষিত ব্যক্তিদের অন্তত দু’বছরের কোনও কোর্স পড়িয়ে হয়তো উচ্চমানের শিক্ষক সৃষ্টি তৈরি করা সম্ভব হতে পারে। এত শিক্ষক শিক্ষণ একমাত্র সম্ভবপর যদি প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান টাকার বিনিময়ে আগ্রহীদের একটা কোর্স পড়িয়ে দেয়। যদি দু’এক লাখ টাকা কোর্সফি হয়, তাতেও অসংখ্য শিক্ষার্থী ছুটে আসবে। এমনিতেই এখন স্কুলের একটা কাজ পাবার জন্য কয়েক লাখ টাকা তোলা দেওয়ার নিয়ম চালু আছে। এখানে তো পাশ করলেই চাকরি। সারা ভারতে লক্ষ লক্ষ ইসিসিই-ক্যাডারের প্রয়োজন হবে। এই ব্যবসায়ে লাভ অচিন্তনীয়।

অনেক ব্যবসায়ী ইতিমধ্যেই ইসিসিই’র সার্টিফিকেট, ডিপ্লোমা ইত্যাদি দেবার প্রতিষ্ঠান খুলে ফেলেছেন। না এটা আমার কল্পনাপ্রসূত কথা নয়। এই মুহূর্তে ইন্টারনেট খুলে ‘ecce training institutes in india’ বলে সার্চ করলেই অন্তত ২৪টি বিজ্ঞাপন পাওয়া যাচ্ছে, যেখান থেকে এই শিক্ষা দেওয়া হবে। তালিকায় আছে আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়। আশ্চর্য হবার কিছু নেই, কারণ তাদের উপাচার্য অনুরাগ বেহার ‘খসড়া এনইপি’ তৈরির কমিটিতে ছিলেন। এরা অবশ্য দেড় লাখ টাকা নেবে পড়ানোর জন্য। এছাড়া আছে মুম্বাই মন্তেসরি টিচার ট্রেইনিং ইন্সটিটিউট/ইসিসিই (এক্রেডিটেড বাই ইউএসএ), মিরাটের এপিএস কলেজ (এরা নেবে এক লাখ একাত্তর হাজার টাকা), জলন্ধরের এলপিইউ নেবে এক লাখ আঠারো হাজার টাকা। কলকাতার এপি টিচার ট্রেইনিং ইন্সটিটিউট (কোলাবরেশন উইথ লামার ইউনিভার্সিটি, ইউএসএ) এবং মুম্বাইয়ের বিদ্যানিধি এডুকেশন ট্রাস্ট — এই দুই জায়গায় কিন্তু সরাসরি দেখা করা যাবেনা। প্রথমে চ্যাট করে দরাদরি ঠিক হয়ে গেলে তবে দেখা করতে পারবে। যেসব কলেজ শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত ঘরে স্মার্টবোর্ডে পড়াবে, তাদের ফি নাকি দশ লাখ অবধি উঠতে পারে। অতএব বুনিয়াদি শিক্ষার ভিত্তিস্থাপনের স্তরেই একটা বড় রকম ব্যবসার ভিত্তি স্থাপিত হয়ে গেছে।

- কমলেশ ভৌমিক
(লেখাটি লেখকের জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ সম্পর্কিত একটি বড় লেখা থেকে গৃহীত ও সম্পাদিত)

খণ্ড-29
সংখ্যা-38