মোদী-আদানির যুগলবন্দি : ক্ষমতা এবং সম্পদের অভূতপূর্ব মাত্রায় কেন্দ্রীভবন
Modi-Adani

নরেন্দ্র মোদীর ৭২তম জন্ম বার্ষিকীর আগের দিন ১৬ সেপ্টেম্বর তাঁর ঘনিষ্ঠতম পুঁজিপতি বন্ধুগৌতম আদানি ফোর্বস-এর রিয়েল টাইম বিলিয়োনেয়ার তালিকা অনুসারে পৃথিবীর দ্বিতীয় ধনীতম ব্যক্তি হিসাবে আবির্ভূত হন।তবে, সেটা ছিল স্বল্প সময়ের জন্য এবং কিছু সময় পরই অবশ্য তাঁকে তৃতীয় স্থানে চলে যেতে হয়। তাঁর সম্পদের নীট মূল্য হল ১৫২.২ বিলিয়ন ডলার, আর বিশ্বে তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন ফরাসি ব্যবসায়ী ধনপতি বার্নার্ড আরনল্ট এবং মার্কিন উদ্যোগপতি এবং ই-কমার্স সংস্থা অ্যামাজন-এর প্রতিষ্ঠাতা জেফ বোজেস। তবে, তালিকার সবচেয়ে ওপরে রয়েছেন আমেরিকার উদ্যোগপতি এবং বিদ্যুৎ চালিত মোটরগাড়ি টেলসার সিইও এলন মাস্ক, যাঁর সম্পদের নীট মূল্য ২৭৩.২ বিলিয়ন ডলার। আদানি এখন এশিয়ার ধনীতম ব্যক্তি এবং ভারতে তিনি মুকেশ আম্বানিকে অনেক পিছনে দ্বিতীয় স্থানে ঠেলে দিয়েছেন, এবং দুজনের সম্পদের ব্যবধান ৫০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।

১৯৮৮ সালে পণ্য কেনাবেচার সংস্থা থেকে শুরু করে আদানি গোষ্ঠী আজ পরিণত হয়েছে ভারতে পরিকাঠামোর বৃহত্তম কংলোমারেটে, যাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ রয়েছে বন্দর, সেজ, রাস্তা নির্মাণ ও বিমান বন্দর থেকে বিদ্যুৎ, গ্যাস, কৃষি বাণিজ্য, গুদাম ব্যবসা পর্যন্ত বিস্তৃত ক্ষেত্রে এবং কিসে নয়। আদানির এই অভাবনীয় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির তুলনা একমাত্র চলতে পারে নরেন্দ্র মোদীর রাজনৈতিক শ্রীবৃদ্ধির বাড়বাড়ন্তের সঙ্গে এবং দুটোই ঘটেছে একই সময়কাল ধরে এবং ক্রমেই বেড়েচলা ঘনিষ্ঠতর সহযোগিতার মধ্যে দিয়ে। মোদী গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হন ২০০১- এর ভূমিকম্পর পর এবং আদানি ভূমিকম্পের পর গুজরাটের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় সম্পদ ও আয়ের উৎসগুলোকে কব্জা করার মধ্যে দিয়ে বড় হতে শুরু করেন। ২০০২-এর গুজরাট গণহত্যার পর সিআইআই নেতৃবৃন্দ যখন মোদীর সমালোচনা করেন, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গ্ৰেট ব্রিটেনে ঢোকা তাঁর নিষিদ্ধ হয়, আদানি সে সময় ২০০৩-এর ভাইব্রান্ট গুজরাট সম্মেলনে বিপুল মাত্রায় বিনিয়োগ করেন এবং ঐ সম্মেলনে কর্পোরেট সংস্থাগুলো মোদীর পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঘটায় এবং ‘ভারতের সিইও রূপে’ তাঁর মহিমাকীর্তন করে। এটাই আদানির এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ রূপে বর্ণিত হয়েছে এবং তিনি গুজরাট সরকারের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণে এবং একচেটিয়াভাবে সুবিধা পেতে শুরু করেন। মুন্দ্রা বন্দরকে কেন্দ্র করে আদানি সাম্রাজ্যের বিপুল বিস্তার ঘটতে থাকে, যেটা এখন ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্যিক বন্দর।

মোদী ২০১৪-র নির্বাচনী প্রচারে আদানির একগুচ্ছ জেট বিমান ও হেলিকপ্টার ব্যবহার করেন এবং নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আদানির জেট বিমানে চেপে আহমেদাবাদ থেকে তাঁর দিল্লী পৌঁছানোটা সারা দুনিয়াকেই জানিয়ে দিল যে, ভারতে স্যাঙাতি পুঁজিবাদ এক সম্পূর্ণ নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। তারপর থেকে আদানির আগ্ৰাসি সম্প্রসারণে অর্থজোগাতে ব্যাঙ্কগুলো টাকা ঢালতে থেকেছে আর সরকার কী ভারতে কী বিদেশে আদানির সম্প্রসারণে মদত জোগাতে সম্ভাব্য সবকিছুই করেছে। আদানি এখন ভারতের ব্যাঙ্কগুলো থেকে লোন নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার খনি থেকে কয়লা তোলেন এবং সেই কয়লা আবার ভারতে নিয়ে এসে বিক্রি করেন। আমরা এখন জানি আদানি গোষ্ঠী কীভাবে শ্রীলঙ্কায় বায়ু চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের বরাত পেয়েছিল। মোদী যুগ শুরু হওয়ার আগে ২০১৪ সালের ৩০ মার্চ আদানির সম্পদের পরিমাণ ছিল ৪.৫ বিলিয়ন ডলার, যা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে২০২০র জানুয়ারিতে হয় ১১ বিলিয়ন ডলার এবং অতিমারি পর্বে লাফ দিয়ে বেড়ে ২০২১-এর জানুয়ারিতে গিয়ে দাঁড়ায় ৭৬.৭ বিলিয়ন ডলারে, এবং ২০২২-এর সেপ্টেম্বরে তার সম্পদের পরিমাণ এখন হল ১৫০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।

আট বছরে সম্পদের এই ত্রিশ গুণ বৃদ্ধি স্যাঙাতি পুঁজিবাদের একেবারে চক্ষুলজ্জাহীন প্রয়োগের ফসল যেখানে রাষ্ট্র লোকচক্ষুর মাথা খেয়ে সরকারি সম্পদ ও আয়ের উৎসগুলোকে আদানি গোষ্ঠীর হাতে তুলে দিচ্ছে। এর ফলে তারা পরিকাঠামোর মূল ক্ষেত্রগুলোতে বিশাল আকারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর বজ্রদৃঢ় কব্জা হাসিল করতে পারছে, আর সেটা সম্ভব হচ্ছে ভারতের বন্দর, বিমান বন্দর এবং রাস্তা ও রেল সংযোগ ক্রমেই বেশি করে তাদের নিয়ন্ত্রণে আসার ফলে। সংঘ-বিজেপি শিবির আদানিকে বড় মাপের সম্পদ স্রষ্টা এবং কর্মসংস্থানের জনক হিসাবে তুলে ধরে এই বিষয়টাকে ঝেড়ে ফেলতে চাইবে, এবং এইভাবে আদানির সম্প্রসারণের বৃত্তান্তকে মোদীর নেতৃত্বাধীনে ভারতের বৃদ্ধির আখ্যান রূপেই চালাতে চাইবে। কিন্তু ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির ক্রমহ্রাসমানতা থেকে বেকারি, দারিদ্র, ক্ষুধা ও অপুষ্টির ভয়াবহ বৃদ্ধি –এই প্রতিটি সূচকই ঐ প্রচারটাকে একটা নির্ভেজাল মিথ্যা এবং ভারতের জনগণের প্রতি চরম অপমান রূপেই উন্মোচিত করে দেয়।

কর্পোরেটদের বৃদ্ধি এসেছে বিপুল সামাজিক ও পরিবেশগত মূল্যের বিনিময়ে। এখন আমরা তাই আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পৃথিবীর নানা স্থানেই আদানি ঠেকাও প্রতিবাদকে বেড়ে উঠতে দেখছি – যে প্রতিবাদগুলো চালিত হচ্ছে তার লুটতরাজের প্রকল্পগুলোর বিরুদ্ধে, দেশীয় জনগণের জমি জবরদখলের বিরুদ্ধে, নিজেকে পুনর্নবীকরণ যোগ্য শক্তি এবং দেশীয় জনগণের শিল্প ও সংস্কৃতির মদতদাতা হিসাবে তুলে ধরে নিজের চালানো লুন্ঠনকে ধামাচাপা দেওয়ার ভণ্ডামিভরা প্রচেষ্টাগুলোর বিরুদ্ধে। ক্রমে এটা আরই সুস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে, আদানির বিস্ময়কর বৃদ্ধি হল ঋণের মাধ্যমে অর্থ জোগানো একট বুদবুদ এবং সেই বুদবুদটা যখন ফাটবে তখন তা ভারতে সৃষ্টি করতেই পারে একটা বিপুল আকারের আর্থিক সংকট যেটা হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আর্থিক ক্ষেত্রের দৈত্যাকার সংস্থাগুলোর পতন সৃষ্ট সংকটের মতো। আদানি গোষ্ঠীর সম্পদের নীট মূল্যের পিছনে মূলত রয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঋণ চালিত আগ্ৰাসি অধিগ্ৰহণ এবং গোষ্ঠীর কোম্পানিগুলোর শেয়ার মূল্যের বৃদ্ধি যার সঙ্গে গোষ্ঠীর রাজস্ব আয়ের তেমন সরাসরি সম্পর্কনেই। উদাহরণস্বরূপ, অ্যামাজন ও আদানি গোষ্ঠীর মধ্যে তুলনা দেখাচ্ছে যে দুই গোষ্ঠীরই সম্পদের নীট মূল্য যেখানে ১৫০ বিলিয়ন ডলারের আশেপাশে, দুয়ের মধ্যে রাজস্বের ব্যবধান সেখানে দুস্তর, যথাক্রমে ৪৮৬ বিলিয়ন ডলার এবং ২৯.২ বিলিয়ন ডলার।

আজ মোদী সরকার ক্ষমতার লাগামহীন কেন্দ্রীকরণের প্রতিনিধিত্ব করছে, আর আদানি গোষ্ঠী হল সম্পদের অভূতপূর্ব মাত্রার কেন্দ্রীভবনের প্রতিরূপ। স্যাঙাতি পুঁজিবাদকে জনপ্রিয় ভাষায় আদানি-আম্বানি কোম্পানি রাজ বলে বর্ণনা করা হয় এবং তা যথাযথ ভাবে সংক্ষেপে মোদী সরকারের প্রকৃত চরিত্রকে অতি ধনীদের, অতি-ধনীদের দ্বারা, অতি-ধনীদের জন্য সরকার রূপে তুলে ধরে। গণতন্ত্রকে বাঁচতে হলে ভারতের জনগণকে মোদী সরকারকে ক্ষমতা থেকে অপসারিত করতে হবে এবং ভারতের অর্থনীতি ও রাষ্ট্র কাঠামোর ওপর কর্পোরেটদের এই ক্রমবর্ধমান নাগপাশকে চূর্ণ করতে হবে।

(এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২২)

খণ্ড-29
সংখ্যা-38