প্রতিবেদন
‘অনাহারের’ বিরুদ্ধে যুদ্ধে রাষ্ট্রের দায় নেই?
war against starvation

এই বাংলায় ১৯৪৩ সালে ৩০ লক্ষ মানুষের অনাহারে মৃত্যু হয়েছিল। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকের নিষ্ঠুর ক্রূরতা, নির্মম অবহেলা আর বর্ণবিদ্বেষের কারণে সৃষ্ট সেই ‘দুর্ভিক্ষের’ জন্য কোনও ফসলহানি দায়ী ছিল না। সেই মৃত্যু প্রসঙ্গে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন, “I hate Indians. Beastly people with a beastly religion. The famine was their own fault for breeding like rabbits.” না খেতে পেয়ে মরা মানুষদের সম্পর্কেবোধ হয় সাদা, কালো, বাদামি সব শাসকদেরই এই অভিমত। ভাষাটা শুধু আলাদা। নিজেদের অপরাধ ঝেড়ে ফেলার মোক্ষম যুক্তি!

‘দুর্ভিক্ষ’-আধুনিক অর্থনীতির বা সমাজতত্ত্বের পরিভাষায় ‘খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা’র অবস্থা। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের কালজয়ী গবেষণা দেখিয়ে দিয়েছে — মানুষের চাহিদা পূরণের মতো যথেষ্ট খাদ্যশস্য মজুদ থাকা সত্ত্বেও দুর্ভিক্ষ হয় যদি মানুষের সেই খাদ্যের কাছে পৌঁছানোর ক্ষমতা না থাকে। অর্থাৎ সেই খাদ্য সংগ্রহের মতো সংস্থান বা আয় না থাকে। খাদ্য বন্টনে বৈষম্য ও অসাম্য থেকেও দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হতে পারে।

কেউ স্বপ্ন দ্যাখেন – কীভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ সমৃদ্ধ ভূখণ্ডকে নিজের দখলে আনবেন। কেউ – কীভাবে ধনকুবেরের তালিকায় এক নম্বরে আসবেন। কেউ আবার ভাবেন কীভাবে বন জঙ্গল ঝর্ণা নদী বন্যজীবন খনিজসমৃদ্ধ বনাঞ্চলকে কর্পোরেটদের ভোগের থালায় তুলে দেবেন। আর পৃথিবীর ‘দুর্ভাগা’ সাড়ে ৩৪ কোটি মানুষ এই মুহূর্তে শুধু একমুঠো ‘ভাত’ চায়, আর কিচ্ছু না। না পেয়ে প্রতি ৪ সেকেন্ডে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে তাদের মধ্যে একজন করে মানুষ। প্রতিদিন ২০,০০০ মানুষ মরছে অনাহারে। ‘বিশিষ্ট’ মানুষদের মহার্ঘ স্বপ্ন পূরণের বলি তারা। যদিও এটা গণতন্ত্রের যুগ। যদিও রাষ্ট্রসঙ্ঘ স্বপ্ন দেখেছিল ২০৩০ সালের মধ্যে ‘ক্ষুধামুক্ত’ পৃথিবীর!

কোভিড ১৯-এর প্রভাবে গোটা পৃথিবীর জনজীবন, অর্থনীতি, উৎপাদন ব্যবস্থা চরম বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সেই ধাক্কা সামলাতে মানুষ যখন নাজেহাল, তার মধ্যেই শুরু হয়ে গেল রাশিয়ার ইউক্রেন-হামলা। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো ঘন ঘন হানা দিচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে : যুদ্ধ-সংঘর্ষের জন্য তীব্র খাদ্য সংকটে রয়েছে ২৪টি দেশের ১৩ কোটি ৯০ লক্ষ মানুষ; জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ৮টি দেশের ২ কোটি মানুষ চরম খাদ্য সংকটে আছেন; অর্থনৈতিক সংকটের দরুণ ২১ টি দেশের ৩ কোটি মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীন।

ইউক্রেন ও রাশিয়া পৃথিবীর খাদ্য চাহিদার ১০ ভাগের ১ ভাগ পূরণ করে। এর মধ্যে ৩০% গম, ৬০% সূর্যমুখী তেল, ১৩% ভুট্টা রয়েছে। এছাড়া রাশিয়া পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক সার উৎপাদন ও রপ্তানিকারী দেশ। যুদ্ধের শুরুতেই রাশিয়া কৃষ্ণসাগরে ইউক্রেনের বন্দরগুলি অবরোধ করে রেখেছে। ফলে ওডেসায় বড় গুদামগুলিতে রফতানিযোগ্য ৫০ লক্ষ টন গম মজুত থাকা সত্ত্বেও ইউক্রেন রপ্তানি করতে পারছে না। বহুদিন ধরেই ‘অনাহার’কে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আসছে যুদ্ধবাজরা। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

অন্যদিকে রাশিয়ার ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার ওপর পশ্চিমী নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া থেকে খাদ্যশস্য, সার ইত্যাদির রপ্তানি বন্ধ আছে। যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনে ২০২২-এর চাষ- মরশুমে ২০- ৩০% কৃষিজমি অনাবাদী থেকে যাবে। তাছাড়া ইউক্রেনের গম উৎপাদন রপ্তানির উদ্দেশ্যে; সেই রপ্তানি বন্ধ থাকায় চাষেও অনীহা দেখা দেবে। রাশিয়া ও ইউক্রেন ছাড়াও আরও ২৩টি দেশ যুদ্ধ শুরুর পর থেকে খাদ্যশস্যের রপ্তানির ওপর কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে।

এদিকে বিশ্বের ২৬টি দেশ তাদের খাদ্যশস্যের প্রয়োজনের ৫০%-এর জন্যে নির্ভর করে রাশিয়া ও ইউক্রেনের ওপর। যেমন ইয়েমেন ৯০% আমদানি- নির্ভর। ইরাক ইউক্রেন যুদ্ধে তেল বেচে লাভবান হলেও ৫২ লাখ টন চাহিদার অর্ধেকেরও কম তার নিজস্ব খাদ্য শস্য উৎপাদন। খরা ও জলের অভাবে সেখানকার ক্ষুদ্র চাষিদের জীবিকাও বিপন্ন হয়েছ। বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। বন্যায় বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় চাষের ক্ষতি হয়েছে। গমের আমদানি কমে যাওয়ায় সংকট দেখা দিতে পারে। ভয়াবহ বন্যায় পাকিস্তানে ক্ষতির পরিমাণ ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি জলের তলায়। পাঁচ লক্ষ মানুষ গৃহহীন। মারা গেছেন সরকারি হিসেবেই প্রায় দেড় হাজার মানুষ। মূল্যস্তর ৩০%-এর বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। আবহাওয়ার প্রতিকূলতায়, বিশেষ করে যুদ্ধে খাদ্যশস্যের সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় নাইজেরিয়া, সুদান, মালির মতো আফ্রিকান দেশগুলোর খাদ্য পরিস্থিতি ভয়াবহ। চাদ ইতিমধ্যেই সরকারিভাবে খাদ্যসঙ্কটের কথা ঘোষণা করেছে। যুদ্ধ-সংঘর্ষে বিধ্বস্ত দেশগুলোতে, যেমন ইয়েমেন, আফগানিস্তান, ভেনেজুয়েলা, দক্ষিণ সুদান, সিরিয়ায় কোভিডএর আগে থেকেই খাদ্য সামগ্রী দুর্মূল্য হয়ে উঠেছিল।

রাষ্ট্রসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএও জানিয়েছে ‘২১মে-২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশ্বে খাদ্য মূল্য ৫৫% বেড়েছে। জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে অন্তত ৪৫%। এই ভয়ঙ্কর মূল্য বৃদ্ধির চাপে বিধ্বস্ত যুদ্ধ সংঘর্ষতে থাকা এশিয়া আফ্রিকা দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর মানুষ আজ খাদ্য নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে। একবেলা খেয়ে আরেক বেলা খাবার জুটবে কিনা অনিশ্চিত এমন মানুষের সংখ্যা এখন ১৬০ কোটি (দি ইকোনমিস্ট)।

অক্সফ্যামের গত বছর জুলাইয়ের রিপোর্ট ‘দি হাঙ্গার ভাইরাস মাল্টিপ্লাইস’-এ সক্ষোভে বলা হয়েছিল, করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও বিশ্বে সামরিক ব্যয় পাঁচ হাজার কোটি ডলার বেড়েছে। যেটা ক্ষুধা নিরসনে, রাষ্ট্রসঙ্ঘের ব্যয়ের বহুগুণ বেশি।

আমাদের দেশ অন্যকে গম রপ্তানি করে (আপাতত ইউক্রেন — হামলার জন্যে বন্ধ) কিন্তু তবুও ভারত বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১০১তম অবস্থানে রয়েছে (২০২১-এ ১১৬টি দেশের মধ্যে) — প্রতিবেশী নেপাল বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে এখানে অনাহারের হার বেশি। মোদী ক্ষমতায় আসার সময় অর্থাৎ ২০১৪-তে অনাহার তালিকায় ভারতের অবস্থান ছিল ৫৫তম। দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষের অনাহারে দিন কাটে যখন সরকারি গুদামে টন টন খাদ্যশস্য নষ্ট হয়ে যায়। কারণ, সরকারের নির্মম ঔদাসীন্য। এই দেশ অর্থনৈতিক বৈষম্যে পৃথিবীতে শীর্ষে এবং তা বেড়েই চলেছে। এ দেশে ক্রমশ মজুরি কমছে, প্রতিদিন বহু মানুষ কাজ হারাচ্ছে, বলা বাহুল্য ক্রয়ক্ষমতাও হারাচ্ছে। এই বৈষম্য নিরসনে, এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের উদ্যোগ নেই। ২০০০ সাল থেকেই অনাহার মোকাবিলায় ভারতের অবনতি ঘটছে। ২০০০ সালে এ বিষয়ে ভারতের প্রাপ্ত নম্বর ছিল — ৩৮•৮; ২০১২-তে- ২৮•৮; আর ২০২১- এ ২৭•৫; বিশ্বের যে ৪৭টি দেশ অতিমারীর সময়ে অনাহারে থাকা মানুষের অন্নসংস্থানে ব্যর্থ হয়েছে, তার মধ্যে ভারতও ছিল।

জাতিসংঘের সাধারণ বৈঠকে বিশ্বের ৭৫টি দেশের ২৩৮টি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এক খোলা চিঠিতে ‘দুর্ভিক্ষ’ পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদেরই অন্যতম ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’ এক মর্মান্তিক তথা দিয়ে জানিয়েছে, বিশ্বে প্রতিদিন ১৬০০ শিশু অনাহারে মারা যায়। যুদ্ধ বিধ্বস্ত এলাকায় পাঁচ বছরের কম বয়সী ৪৫ লক্ষ শিশু পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। ৫ লক্ষ ৯০ হাজার শিশু ইতিমধ্যেই মারা গেছে।

‘এ পৃথিবীকে এ শিশুর বাসযোগ্য’ করার পরিবর্তে কর্পোরেট পুঁজির লালসার কাছে সব কিছু বিকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। নদী মাটি জল বায়ু ক্ষুধার অন্ন, বিবেক মনুষ্যত্ব – সব কিছু ! যারা শিরদাঁড়া সোজা রেখে নিজের জন্য, আগামী প্রজন্মের জন্য লড়েছেন, লড়ে চলেছেন তাদের একজোট হয়ে বলার সময় এসেছে – আজ একটাই যুদ্ধ ! আর সেটা ‘ক্ষুধার’ বিরুদ্ধে !

- জয়ন্তী দাশগুপ্ত

খণ্ড-29
সংখ্যা-38