অতিথি কলম
মাহশা আমিনি : যে আগুন ছড়িয়ে গেল
The fire that spread

১৯২৯ সালের ২৮ জুন কলকাতার রোকেয়া সাখাওয়াত স্কুলে একটি চিঠি এলো। এক অভিভাবক স্কুল কর্তৃপক্ষকে নালিশ জানিয়ে লেখেন, স্কুলবাস তাঁর গলির ভেতর যায় না বলে তাঁর মেয়েকে বোরখা পরে ‘চাকরানীর’ সঙ্গে হেঁটে বাড়ি আসতে হয়। গতকাল এক ব্যক্তির চায়ের পাত্রের সঙ্গে ধাক্কা লেগে তাঁর মেয়ে হীরার কাপড় নষ্ট হয়েছে। ঘটনার তদন্তের পর রোকেয়া লিখলেন – ‘অনুসন্ধানে জানিলাম হীরার বোরখায় চক্ষু নাই। … অন্য মেয়েরা বলিল, তাহারা গাড়ি হইতে দেখে মামা (চাকরানী) প্রায় হীরাকে কোলের নিকট লইয়া হাঁটাইয়া লইয়া যায়। বোরখায় চক্ষু না থাকায় হীরা ঠিকমতো হাঁটিতে পারে না – সেদিন একটা বিড়ালের গায়ে পড়িয়া গিয়াছিল – কখনও হোঁচট খায়। গতকল্য হীরাই সে চায়ের পাত্রবাহী লোকের গায়ে ধাক্কা দিয়া তাহার চা ফেলিয়া দিয়াছে। দেখুন দেখি, হীরার বয়স ৯ বৎসর — এতটুকু বালিকাকে “অন্ধ বোরখা” পরিয়া পথ চলিতে হইবে! ইহা না করিলে অবরোধের সম্মান রক্ষা হয় না!’ (রোকেয়া : ‘অবরোধবাসিনী’ তের)। স্কুলের ‘মোটর’ বাসে মেয়েদের যাতায়াত করা নিয়েও রোকেয়া হুমকি চিঠি পান। সমাজের পর্দা রক্ষার চাপে প্রায় ‘Moving Black Hole (চলন্ত অন্ধকূপ)’ স্কুলবাসে ছাত্রীদের নিয়ে আসা হতো। এতে বাচ্চারা অসুস্থ হতে শুরু করলো, ভয়ে জ্ঞান হারালো। তাই বাসের দুপাশের দুটো ‘খড়খড়ি’ নামিয়ে তার ওপর পর্দা দেওয়া হলো। এরফলে অপরাধী সাব্যস্ত হলো স্কুল কর্তৃপক্ষ। কারণ পর্দা বাতাসে উড়ে গাড়িকে বেপর্দা করেছে। এরকম বেপর্দা গাড়িতে মেয়েদের যাতায়াত করালে উর্দু দৈনিকে স্কুলের নামে কুৎসা রটনা করে মেয়েদের স্কুলে আসা বন্ধ করার কথা জানিয়ে কড়া চিঠি পাঠান মৌলবাদী সমাজরক্ষকগণ। অবরোধ-বন্দিনীদের আগুন-সেঁকা জীবনের জ্বালাযন্ত্রণাকে নিজ বক্ষে ধারণ করে ‘অবরোধবাসিনী’-র  সাতচল্লিশ নাম্বার পর্বে রোকেয়া লেখেন — “কেন আসিলাম হায়! এ পোড়া সংসারে, কেন জন্ম লভিলাম পর্দ্দা-নসীন ঘরে!” মৌলবাদীদের তর্জন-গর্জনে রোকেয়ার লড়াই কিন্তু থেমে যায়নি। নানাপথে বিস্তার পেয়েছে। সাহসী কণ্ঠে তিনি ঘোষণা করেছেন — ‘ভগিনী তোমরা দেখিতেছ এই ধর্মশাস্ত্রগুলি পুরুষ রচিত বিধি ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে। মুনিদের বিধানে যে কথা শুনিতে পাও, কোনও স্ত্রী মুনির বিধানে হয়ত তাহার বিপরীত নিয়ম দেখিতে পাইতে। ধর্মগ্রন্থ সমূহ ঈশ্বর প্রেরিত বা ঈশ্বরাদিষ্ট নহে। ...ধর্মের দোহাই দিয়া পুরুষ রমণীর উপর প্রভুত্ব করিতেছেন।’ (রোকেয়া : ‘অলঙ্কার না Badge of Slavery’)। ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ইরানের পুলিশি হেফাজতে বাইশ বছরের তরুণী মাহশা আমিনির মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। মাহশা আমিনির বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ঠিকমতো হিজাব পরেননি। তাঁর চুল দেখা যাচ্ছিল। ইসলামি পোশাক নিয়ম মেনে পরছে কি না তা দেখার দায়িত্বে থাকা নীতি-পুলিশরা তাই মাহশাকে ধরে নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে মেরে দেয় বলেই ইরানের জনগণের দাবি। রোকেয়ার সময়কে (১৮৮০-১৯৩২) অনেকটা পার করে এসেও একই বাস্তবতায় আগুন জ্বলে বুকে। দেশ ভিন্ন। কিন্তু গাজোয়ারি কর্তৃত্ব, অন্ধ জবরদস্তি অভিন্ন। আমার দেশের মেয়েরাও কি এখন আরও বেশি করে ‘My choice’ বলে পুরুষের তৈরি দৃষ্টিভঙ্গিতে ঢুকে যাচ্ছে না? মাহশা আমিনির মৃত্যু ইরানবাসীদের ক্ষোভের আগুনকে স্ফুলিঙ্গের মতো কাঁটাতারের বেড়া ছাড়িয়ে, ছড়িয়ে দেয় পৃথিবীর নানাপ্রান্তে। আমি আন্দোলিত হয়েও অসহায়। মহিলা কলেজের ক্লাসরুমে কয়েকটি দলে বিভক্ত ছাত্রীদের নিচুস্বরের কথায় কাজ দিয়েছি। হিজাব পরা ছাত্রী জানালো সে বন্ধুদের সব কথা শুনতে পাচ্ছে না। তার জন্যই বন্ধুরা ঘরের দরজা আটকে দিয়ে হিজাবের কানের কাছের অংশটুকু একটু আলগা করে নিতে বলল। সে অনড়। কথা শুনতে না পাওয়ার জন্য যদি ক্লাসের কাজে যুক্ত না হতে হয় সেটা মেনে নেবে কিন্তু হিজাব একটুও কান থেকে সরাবে না। আমাদের নিশ্চয় মনে আছে কর্ণাটকের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হিজাব বিতর্ক? তারমধ্যে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র রয়েছে সেটা সত্য। তবু পরীক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেখানে। তারা পরীক্ষা দিতে গিয়ে শুনল হিজাব পরে ঢুকতে পারবে না। সেই মুহূর্তে জানিয়ে দিল, পরীক্ষা ছাড়তে হয় ছাড়ব কিন্তু হিজাব ছাড়ব না। অন্ধ অহংকারে পিতৃতান্ত্রিক ভাবনায় লালিত মেয়েরা নিজের ক্ষতি কি বোঝে না? নিজের মাথা, চুল, চোখ, মুখ হাত, পা কোন যুক্তিতে অতিরিক্ত ঢাকনায় মুড়িয়ে রাখতে হবে? তবে সচেতন মেয়েরা বুঝতে পারছেন বস্ত্রখণ্ডে মুড়ে দিয়ে তাঁদের শরীরকে অসম্মান করা পুরুষদের অভিসন্ধি, তাঁরা প্রতিবাদে-প্রতিরোধে উত্তাল হয়ে উঠেছেন।

fire that spread

‘নারী, জীবন ও স্বাধীনতা’ বিপ্লবী শ্লোগানে উত্তাল মাহশা আমিনির দেশ। রাস্তায় নেমে চুল কেটে, চুলের পতাকা উড়িয়ে, হিজাব পুড়িয়ে প্রতিবাদ করছেন ইরানের মহিলারা। ইরান থেকে আফগানিস্তান একই শ্লোগান। ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখ তালিবানদের ভয়ংকর রূপকে উপেক্ষা করে কিছু মহিলা ইরানের দূতাবাসের সামনে দাঁড়িয়ে এই শ্লোগান দেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশে গুলি চালিয়ে তালিবানরা এই সমাবেশকে ছত্রভঙ্গ করে। তালিবানি শাসনের আফগানিস্তানে আগুন জ্বালাতে চাওয়া মহিলাদের কুর্নিশ। ১৬ সেপ্টেম্বরের পর থেকে চলা বিক্ষোভে ইরানে এ পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৮৩ (সূত্র : প্রথম আলো ডেস্ক, বাংলাদেশ, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২)। বিক্ষোভকারীদের দাঙ্গাবাজ তকমা দিয়েছে সে দেশের প্রশাসন। তাঁদের অবাধে গ্রেপ্তার করা চলছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আন্দোলনের গতিবেগ। ইরানের বহু শহরের রাজপথে আগুন জ্বালিয়েছেন তাঁরা। সরকার ইন্টারনেট পরিসেবা বন্ধ করে বিক্ষুব্ধ মানুষের খবর চাপা দিতে চাইলেও তা দ্বিগুণ তেজে দেশের সীমানা দ্রুত অতিক্রম করছে। পিতৃতন্ত্রের চাপে, মৌলবাদের নির্যাতনে দমবন্ধ অবস্থায় হাঁপিয়ে পড়া মহিলারা বন্দুকের নলকে তাচ্ছিল্য করে আজ প্রাণ বাজি রাখছেন। প্রশাসনের অত্যাচার, চোখের সামনে লুটিয়ে পড়া সহযোদ্ধা, লড়াইকে আরও চাঙ্গা রাখছে। আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার বার্তা ইরানের বর্ডার ছেড়ে ঢুকে পড়েছে বহু দেশে। অপরদিকে বহুসংখ্যক মহিলা আপাদমস্তক নিজেকে মুড়ে বোরখা-হিজাবের পক্ষ নিয়ে মিছিল করছেন। মৌলবাদের চাপে বা পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টি-লালনে তাঁরা রাস্তায় নেমেছেন হিজাব বিরোধীদের আন্দোলনকে নস্যাৎ করে ধর্মীয় সুরের বাতাস বইয়ে দেবেন বলে। পিতৃতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে, পিতৃতান্ত্রিক ভাবনার মহিলাদের সংখ্যা অনেক বেশি হতে পারে, প্রশাসনের দমন-পীড়নে আন্দোলনের আগুন চাপা পড়তেও পারে কিন্তু ছাইচাপা আগুন বারবার জ্বলে উঠবে। পুঁজিবাদের মদতপুষ্ট মৌলবাদের বাড়-বাড়ন্ত রুখতে, নারী শরীর নিয়ে কুৎসিত ভাবনা পদদলিত করতে আজ পুড়ছে বোরখা, পুড়ছে হিজাব, উড়ছে চুল। এই আগুন একেবারে নিভে যাওয়ার নয়। ওই শোনা যায় ইরানে বিপ্লবী পদযাত্রার পদধ্বনি। আমার দেশে, আমার বাংলার বোরখা-হিজাব পরিহিত প্রিয় নারীদের কানে কি সেই ধ্বনি পৌঁছাচ্ছে না?

আফ্রোজা খাতুন
(ঋণস্বীকার : দোঁহা ওয়েবপোর্টালে প্রকাশিত)

খণ্ড-29
সংখ্যা-41