সম্পাদকীয়
মালবাজারে নরমেধ যজ্ঞ — দায় কার?
Narmedh Yajna in Malbazar

গোটা রাজ্যকে অবর্ণনীয় বিষাদে আচ্ছন্ন করে মালবাজারের দশমীর সন্ধ্যা কেড়ে নিল তরতাজা আট আটটা প্রাণ! আহত হলেন আরও অনেকে। বাংলার পুজো ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার পর আহ্লাদে আটখানা নবান্নের রাজনৈতিক প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিরা যেন মর্তের বহু নির্মম বাস্তব থেকে নিজেদের অনেক দূরে সরিয়ে গগনবিহারী হয়েছিলেন। আর, তারই চুইয়ে পড়া রেশ স্থানীয় প্রশাসনকেও যেন গিলে খেল! আজ দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে জেলা প্রশাসনের একাধিক গাফিলতি না থাকলে বোধহয় ঠেকানো যেত অতগুলো সহনাগরিকের মূল্যবান জীবন।

প্রকৃতি কি এতো বড় বিপদের কোনও আগাম পূর্বাভাস দেয়নি? মহালয়ার ঠিক আগের দিনই মাল নদীতে এসেছিল হড়পা বান যা ভাসিয়ে নিয়ে যায় অস্থায়ী বাঁধ, বাঁধ তৈরির কাজে পাথর তোলার জন্য নদীখাতে নামানো একটি ট্রাক। অবাক লাগে ফের সেখানেই বাঁধ তৈরি করা হল? কেন প্রশাসন অনুমতি দিল নদীর মাঝের চরে কাতারে কাতারে দর্শনার্থী এবং প্রতিমাবাহী পেল্লায় লরিগুলোকে যেতে? মালবাজারে তো নবমীর দিনেও বৃষ্টি হয়, এমনকি পাহাড়ে নিয়মিত বৃষ্টির পূর্বাভাস ছিল। নবমীর বৃষ্টিতে জল বেড়ে যাওয়ায় পুরকর্মীদের দিনভর ঘাট তৈরির কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। তা সত্ত্বেও স্থানীয় প্রশাসন নিশ্চিন্তির চাদরে মুড়ে দিন কাটান। কোনও ধরনের সুরক্ষার ব্যবস্থা নেয়নি। সংবাদে প্রকাশ, মাত্র আটজন সিভিক ভলেন্টিয়ারের হাতে দড়ি দিয়ে নাকি পুরো ব্যাপারটা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছিল স্থানীয় প্রশাসন। আর এই মর্মান্তিক ট্রাজেডিকে যেন আকস্মিক দুর্বিপাক হিসাবে দায় ঝেড়ে ফেলতে প্রশাসনের কোনও কোনও মহল থেকে বলা হচ্ছে, “মাল নদীতে যে দুর্ঘটনা ঘটেছে, গত কুড়ি বছরের রেকর্ড এমন ঘটনা ঘটেনি”।

এই দুর্ঘটনার নেপথ্যে উঠে আসছে প্রকৃতিকে নির্মম ও বেপরোয়াভাবে ধ্বংস করার কারণসমূহ। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের প্রাক্তন প্রধান সুবীর সরকার জানিয়েছেন হড়পা-প্রবণ এই নদীর আরও বিপদ বাড়িয়েছে অবৈধ ও অপরিকল্পিত নদীখনন বালি-পাথর তোলা, নির্বিচারে বসতি স্থাপন। ফলে, হড়পা বানে নদীস্রোতের গতিপথ আচমকা বদলে যায়। অন্য কোনও গতিপথ ধরে জল চলে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়।

এদিকে প্রশাসনের অভ্যন্তরে চুপিসারে গৈরিক মতাদর্শ কী নির্লজ্জভাবে বাসা বেঁধে উঠছে, কলকাতার একটা পুজো তা বে-আব্রু করে দিল। হিন্দু মহাসভা কর্তৃক আয়োজিত রুবি পার্কের এই পুজোটিতে, পুলিশই জানিয়েছে, প্রয়োজনীয় অনুমোদন ছিল না। আর, সবকিছুকে ছাপিয়ে গেল এই অনুমোদনহীন, বেআইনি পুজোতে মহিষাসুরের বদলে এমন একটা মূর্তিবসানো হয়েছিল, যার সাথে গান্ধীজির প্রকট সাদৃশ্য ছিল। রাজ্যের প্রায় সমস্ত বামপন্থী দল সহ অন্যন্য দল, সুস্থবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকবৃন্দ এর তীব্র বিরোধিতা করেন। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনই এগিয়ে এলো হিন্দু মহাসভার আয়োজকদের পরিত্রাণ করতে। অসুরের মাথায় মুখে চুল দাড়ি গোঁফ দিয়ে গান্ধীজির চশমাটা খুলে ফেলতে, ও যে সাংবাদিক এনিয়ে টুইট করেছিলেন তাঁকে তা মুছে ফেলার পরামর্শ দেওয়া হল। এই অপরাধসম অন্যায় প্রশয় পেল, আর বলাই বাহুল্য, পুলিশই জানিয়েছে, তারা যা করেছেন তা উপরের নির্দেশ অনুযায়ী। বিন্দুমাত্র অনুতাপহীন আয়োজকরা উল্টে ঘোষণা করেন যে গান্ধীকে তাঁরা শ্রদ্ধার পাত্র মনে করেন না, আর ওই ঘটনা পুরোপুরি কাকতালীয়, তাই তাঁরা একেবারেই দুঃখিত বা লজ্জিত নন।

বিদ্বেষের কারবারিদের এইভাবে ছাড় দিয়ে যে ঘৃণার চারাগাছকে সযত্নে লালন করা হল, তা অচিরেই বিষবৃক্ষ হয়ে ডালপালা বিস্তার লাভ করবে। আর, রাষ্ট্রক্ষমতাই এরজন্য পুরোপুরি দায়ী থাকবে।

কোথাও প্রশাসন নির্লিপ্ত, কোথাও অতি সক্রিয় হয়ে গেরুয়াবাহিনীকে মদত — আজ বাংলায় প্রশাসনিক ব্যবস্থায় বিরাট ঘুণ ধরেছে।

রাজ্যের বামপন্থী গণতান্ত্রিক নাগরিকদেরই হাতে তুলে নিতে হবে নব নির্মাণের কর্মকান্ড।

খণ্ড-29
সংখ্যা-39