ঘৃণাকে প্রত্যাখ্যান করুন! ভয়কে প্রতিরোধ করুন! স্বাধীনতার আত্মপ্রতিষ্ঠা করুন!
Reject Hate

বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারতের পিছিয়ে পড়ার ধারা অব্যাহত রয়েছে। ২০২০ সালে ১০৭টা দেশের মধ্যে ৯৪তম স্থান থেকে ২০২১ সালে ভারতের স্থান সাত ধাপ নেমে ১১৬টা দেশের মধ্যে হয়েছিল ১০১ এবং সর্বশেষ ২০২২’র সূচকে আরও ছ’ধাপ নেমে ১২১টা দেশের মধ্যে ভারত রয়েছে ১০৭তম স্থানে। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত আফগানিস্তান ছাড়া অন্য সব পড়শি দেশই তালিকায় ভারতের চেয়ে বেশ কিছুটা এগিয়ে রয়েছে। বিশ্বে সর্বোচ্চ জনসংখ্যার দেশ হিসাবে চীন এখনও ভারতের চেয়ে সামান্য এগিয়ে রয়েছে এবং বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে চীন অনেক এগিয়ে রয়েছে সেরা ১৭টা দেশের মধ্যে। অন্যভাবে বললে, চীনে ক্ষুধার প্রকোপ যথেষ্ট কম বলে গণ্য হলেও ভারতে তা যথেষ্ট গুরুতর বলেই বিবেচিত হচ্ছে। ভারতে শিশুদের ওয়েস্টিং হার (উচ্চতার তুলনায় ওজন কম হওয়া) — যা পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের তীব্র অপুষ্টিকে দেখায় — বিশ্বে সবচেয়ে বেশি।

মোদী সরকার ক্ষুধার মোকাবিলা করছে সর্বসাধারণের থেকে এর চর্চাকে নির্বাসিত করে এবং বিশ্ব ক্ষুধা সূচককে পশ্চিমের এক ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করে। এক দশক আগে সঙ্ঘবাহিনী এবং মূল ধারার মিডিয়া মূল্যবৃদ্ধি এবং টাকার দাম কমা নিয়ে প্রচুর রোষ বর্ষণ করত। পেট্রল, রান্নার গ্যাস এবং জনসাধারণের আহার্য প্রতিটি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এখন আকাশ ছুঁয়েছে আর ডলারের সাপেক্ষে টাকার দাম প্রতিদিনই কমছে, এবং ডলার প্রতি টাকার বিনিময় মূল্য ১০০ হতে আর সামান্যই বাকি রয়েছে। দশ বছর আগে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী টাকার বিনিময় মূল্যের পতনকে দুর্বল সরকার এবং অর্থনৈতিক বে-বন্দোবস্তর চরম লক্ষণ বলে মন্তব্য করতেন। আর আজ ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মোদী টাকার মূল্যের বিরামহীন পতন নিয়ে কানে তালা ধরানো মৌনতা অবলম্বন করেছেন আর অর্থমন্ত্রী এটাকে ব্যাখ্যা করছেন ডলারের শক্তি বৃদ্ধি হিসাবে! উদ্বেগজনক ক্ষুধা, পণ্যের তীব্র মূল্যস্ফীতি, টাকার মূল্যের ক্রমান্বয়ী ক্ষয় বা কর্মসংস্থান লোপ পাওয়ার বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়ানোর পরিবর্তে মোদী তাঁর শ্রোতৃমণ্ডলীর কাছে ‘ব্যবসা করার সহসাধ্যতা’র রূপকথা নিয়ে ফুলঝুরি ছোটাচ্ছেন। ঐ সূচকটাকে বিশ্বব্যাঙ্ক ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে পরিত্যাগ করেছে, কারণ, ঐ সূচকের অবস্থান নির্ণয়ে কিভাবে কারচুপি ঘটানো হয়েছে, এক নিরপেক্ষ অডিট তাকে উন্মোচিত করে দিয়েছিল।

সঙ্ঘবাহিনী খুব ভালো করেই জানে যে, মিথ্যা ছড়িয়ে এবং ঘৃণা চাউর করার মধ্যে দিয়েই তারা নির্বাচন জিততে পারে। হিমাচল প্রদেশ ও গুজরাটের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের আগে আমরা তাই ঘৃণা প্রচারের ওপর নতুন করে জোর পড়তে দেখছি। উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিজেপিকে আমরা তার কর্ণাটক পরীক্ষাগারে হিজাব নিষিদ্ধকরণের পরীক্ষানিরীক্ষাকে পূর্ণাঙ্গ করে তুলতে দেখেছিলাম। হিজাব নিষিদ্ধকরণ বিষয়টার ফয়সালা এখনও সুপ্রিম কোর্টে গড়িয়ে চললেও দিল্লী এবং জাতীয় রাজধানী অঞ্চলের সঙ্ঘবাহিনীর নেতারা আরও একবার ঘৃণা উগরে চলেছেন, তাঁরা মুসলিমদের বয়কট করা থেকে সরাসরি গণহত্যা পর্যন্ত বিস্তৃত নির্যাতনের বিধান দিয়ে চলেছেন। আর, যে গুজরাটে মেরুকরণ শুরু হয়েছিল ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকী দিবসে, সেখানে নবরাত্রি উৎসব ও তার সাথে চলা গর্বা উৎসবে মেরুকরণকে তীব্র করে তোলা হল বেছে-বেছে মুসলিমদের উৎসব থেকে বাদ দেওয়া এবং সর্বসমক্ষে তাদের অবমাননা ঘটানো ও প্রহারের মধ্যে দিয়ে। এখন এটা সরকারিভাবেই নথিবদ্ধ যে, ১৫ আগস্ট বিলকিস বানো মামলায় সাজাপ্রাপ্ত ধর্ষক ও খুনীদের মুক্তিতে অনুমোদন দিয়েছিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক, এবং তা করা হয়েছিল সিবিআই ও বিশেষ বিচারকের পরামর্শকে অগ্ৰাহ্য করে এবং ঐ মন্ত্রকেরই ঘোষণা করা মার্জনা নীতির বিপরীতে গিয়ে যে নীতি ধর্ষণ ও খুনের মতো ঘৃণ্য অপরাধে সাজাপ্রাপ্তদের মুক্তিকে বাতিল করে দিয়েছিল।

সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও ঘৃণার অভিযানকে তীব্রতর করে তুলেছে প্রবল শত্রুতা বোধ ও প্রতিশোধের রাষ্ট্রীয় মতবাদ। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের উল্লেখযোগ্য মন্তব্য ছিল এই যে, নাগরিক সমাজই হল একেবারে হালফিলের যুদ্ধের সীমানা। প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং মিডিয়া বা সামাজিক মাধ্যম, বিচারবিভাগ, এনজিও-সমূহ বা রাজনৈতিক দলগুলোর মতো প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতার ধারণাকে জাতীয় ঐক্য ও নিরাপত্তার প্রতি সম্ভাবনাময় বিপদ বলে অভিহিত করে রাষ্ট্রের এই মতবাদকে এক নতুন স্তরে নিয়ে গেছেন। রাষ্ট্রের এই শত্রুতার মতবাদ প্রশাসনকে চালিত করছে সরকার বিরোধী মত পোষণকারী নাগরিকদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার মামলা দায়ের করে তাদের উপর দানবীয় আইন চাপিয়ে বছরের পর জেলে আটক রাখতে, আর সর্বোচ্চ আদালত ৯০ শতাংশ শারীরিক অক্ষমতার হুইল চেয়ার বাহিত অধ্যাপকের মুক্তিকে এই যুক্তিতে বাতিল করছে যে, সন্ত্রাসবাদ বা মাওবাদে অভিযুক্তদের ক্ষেত্রে মগজই হল সর্বাপেক্ষা বিপজ্জনক অঙ্গ। ঘৃণার পেশাদার প্রচারকরা যখন অবাধে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে, তখন ঘৃণার বিরুদ্ধাচারণ করা উমর খলিদের মতো সমাজ আন্দোলনের কর্মীর জামিনের আবেদন এই বলে খারিজ করা হচ্ছে যে তার “কোনো যোগ্যতা নেই”।

ঘৃণা, মিথ্যাচার ও ভয়ের এই সার্বিক আবহে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান কী আদৌ সম্ভব? আমাদের মনে হচ্ছে যে, আমরা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা ভাবি সেটা নির্বাচন কমিশন আর চায় না। বাস্তব পরিস্থিতিতে ভোটার তালিকাকে প্রণালীবদ্ধভাবে আধার কার্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করা হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন যদিও আমাদের বলে চলেছে যে, এই সংযুক্তিকরণ একেবারেই স্বেচ্ছাপ্রণোদিত বিষয় এবং আধারের বিশদ তথ্য না দিলে কোনো বর্তমান বা প্রত্যাশী ভোটারকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। বিজেপি এখন গুজরাট ও হিমাচল প্রদেশে নির্বাচনের আগে প্রকল্প চালু ও কর ছাড়ের কথা ঘোষণা করে চলেছে, আর নির্বাচন কমিশন আদর্শ নির্বাচন বিধিকে সংশোধন করে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইস্তাহারকে অর্থনৈতিক সাধ্যতা যাচাইয়ের অধীন করার প্রস্তাব করছে। নির্বাচন কমিশন এইভাবে নিজেকে রাজনৈতিক সেন্সারশিপের ক্ষমতার অধিকারী করে তুলতে চাইছে যা বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রে রাজনৈতিক স্বাধীনতার স্পিরিটেরই বিপর্যয় ঘটাবে।

এছাড়াও, নির্বাচন কমিশন গুজরাটে স্বতন্ত্র ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এবং শিল্পগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে চুক্তিতে স্বাক্ষর করছে যার ফলে ঐ সমস্ত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও শিল্প গোষ্ঠীসমূহ তাদের অধীনস্থ শ্রমিকদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে নজরদারী চালাতে এবং যে শ্রমিকরা ভোট দেবে না তাদের নাম প্রকাশ করে অপদস্থ করতে পারবে! ভয় ও দাক্ষিণ্য মুক্ত অবাধ নির্বাচনের বদলে আমরা এমন একটা ব্যবস্থার উন্মোচন ঘটতে দেখছি যাতে আধার-ভোটার তালিকা সংযুক্তিকরণ এবং নির্বাচনে অংশগ্ৰহণ বিষয়ে কর্পোরেট নজরদারীর মাধ্যমে ভোটারদের হুমকি ও কড়া নজরের অধীন করে তোলা হবে। উল্লেখ নিষ্প্রোয়জন যে, ‘অংশগ্ৰহণে নজরদারী’ থেকে ভোটারের পছন্দকে প্রভাবিত ও নির্দেশিত করা এবং ফলকে নির্ধারিত করার মধ্যে দূরত্ব সামান্যই। রাষ্ট্র এইভাবে যখন সংসদীয় গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণ প্রহসনে পরিণত করার হুমকি দিচ্ছে, তখন নাগরিকদেরই সজাগ থেকে নির্বাচনী ক্ষেত্রকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে এবং জনগণের ইস্যু, সংগ্ৰাম ও অধিকারগুলোকে তুলে ধরে তাকে প্রাণবন্ত করে তুলে ঐ ফ্যাসিস্ত চক্রান্তকে ব্যর্থ করে দিতে হবে।

(এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৮ অক্টোবর ২০২২)

খণ্ড-29
সংখ্যা-41