প্রতিবেদন
গণতন্ত্র, ধর্ম-নিরপেক্ষতা ও নারী-মুক্তির লড়াইকে শক্তিশালী করো — বিলকিস বানোর পাশে দাঁড়াও
Stand by Bilkis Bano

“যে কোনো নারীর ন্যায়বিচারের লড়াই এভাবে কী শেষ হতে পারে? আমি আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আদালতে আস্থা রেখেছিলাম। আমি সিস্টেমের ওপর আস্থা রেখেছিলাম এবং আমি আমার ট্রমা নিয়ে ধীরে ধীরে বাঁচতে শিখছিলাম। এই দোষীদের মুক্তি আমার কাছ থেকে শান্তি কেড়ে নিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে ন্যায়বিচারের প্রতি আমার বিশ্বাস।”

“আমার দুঃখ আর ভেঙে পড়া বিশ্বাস একা আমার জন্য নয়, আমার সাথে সেইসব মেয়ের কথা ভেবেও, যারা ন্যায়ের জন্য কোর্টে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।”

— নিজের ১১ জন ধর্ষকের মুক্তির রায়ের খবরে বিলকিস বানোর মন্তব্য

আজাদির ৭৫তম বার্ষিকীর দেশজোড়া উৎসবের সময় গুজরাট হাইকোর্টের নির্দেশে ২০০২ সালে গুজরাট গণহত্যায় বিলকিস বানোর গণধর্ষন ও বানোর পরিবারের ৭ জনকে হত্যা করার অপরাধে ১১ জন আসামীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মাফ হয়। ২০০৮ সালে স্পেশাল সেন্ট্রাল বুর‍্যো অফ ইনভেস্টিগেশন ‘সিবিআই’এর কোর্টে অভিযুক্ত ১১ জনের দোষ প্রমাণিত হয় ও যাবজ্জীবনের সাজা হয়। পরে ২০১৭ সালে বোম্বে হাইকোর্ট এই রায়কে মান্যতা দেয়। তদন্ত চলাকালীন বিলকিস, তার পরিবার ও সাক্ষীদের প্রাণহানির হুমকির মুখে পড়তে হলেও ন্যায়বিচারের উপর আস্থা রেখে বিলকিস নিজের লড়াই চালিয়ে গেছেন।

বিলকিস বানোর সাথে কী ঘটেছিল?

আজ থেকে বিশ বছর আগের কথা। গুজরাটের দাহোড জেলার রাধিকাপুরের বাসিন্দা বিলকিস বানো তখন ২১-এর তরুণী। ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বকরি-ঈদের সময় রাধিকাপুরে আগুন জ্বলছিল। হিংসার আগুন। চারিদিকে হিংসার আগুনে লুট হচ্ছিল বিলকিসদের ঘর, দুয়ার, নিরাপত্তা। নিবিড় চারকোণের মায়া ছেড়ে, প্রাণ বাঁচাতে ৫ মাসের অন্তসত্ত্বা বিলকিস তার ৩ বছরের মেয়ে সালেহার হাত ধরে, ১৫ জন আত্মীয়ের সাথে গ্রাম ছেড়ে পালাতে শুরু করলেন। ৩ মার্চ ২০০২, এসে পৌঁছালেন চাপ্পারওয়াড গ্রামে। চার্জশীট অনুযায়ী, ২০-৩০ জন ধারালো অস্ত্র (কুঠার, তলোয়ার), লাঠি ইত্যাদি নিয়ে বিলকিস ও তার আত্মীয়দের উপর হামলা করে। এই ২০-৩০ জন হামলাকারীর মধ্যে ১১ জন পরবর্তীতে দোষী প্রমাণিত হয়। এই হামলার ফলে রাধিকাপুর গ্রাম থেকে পালিয়ে আসা ১৭ জন মুসলিম মানুষের মধ্যে বিলকিস, একজন পুরুষ ও একটি বাচ্চা প্রাণে বাঁচেন। ৭ জনের মৃতদেহ পরে উদ্ধার হলেও বাকিদের খোঁজ পাওয়া যায়নি। সিবিআই’এর রিপোর্ট অনুযায়ী, বেশ কিছু মৃতের ধর দেহ থেকে আলাদা করে দেওয়া হয়েছিল, যাতে চিনতে না পারা যায়। বিলকিস, বিলকিসের মা, বোন ও আরো দুই মহিলার উপর চলে নৃশংস ধর্ষণ। যশবন্তবাই নাই, গোবিন্দভাই নাই, নরেশ কুমার মরধিয়া অন্তসত্ত্বা বিলকিসকে ধর্ষণ করে। শৈলেশ ভাট তিন বছরের সালেহাকে পাথরে আছাড় মেরে খুন করে। এই তিনজন ছাড়াও, রাধেশ্যাম শাহ, বিপিন কুমার যোশী, কেশরবাই, প্রদীপ, বাকাবাই ভোহানিয়া, রাজুভাই সোনি, মিতেশ ভাট আর রমেশ চন্দনার সক্রিয় উপস্থিতিতে এই হিংসার তাণ্ডব চলে। এদের প্রত্যেকেই বিজেপি ও অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী দলগুলির সদস্য।

সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীরা কীভাবে ছাড়া পেল?

সম্প্রতি, রাধেশ্যাম শাহের নেতৃত্বে ১১ জন সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীরা ক্ষমার জন্য সুপ্রিম কোর্টের কাছে আবেদন জানায়। এই আবেদনের ভিত্তিতে ১৩ মে ২০২২ সুপ্রিম কোর্ট গুজরাট সরকারকে তাদের ক্ষমার নীতির উপর ভিত্তি করে এই আবেদনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আদেশ দেয় এই যুক্তিতে, যে দোষীরা গুজরাটের অধিবাসী তাই গুজরাট সরকার এই বিষয় সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবে। ক্ষমার আবেদন নিয়ে ভেবে দেখতে গুজরাট সরকার একটি কমিটি তৈরি করে। গোধরা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুজল মায়াত্রার নেতৃত্বে বিজেপি বিধায়ক সিকে রাওলজি, সুমন চৌহান, গোধরা পুরসভার প্রাক্তন উপদেষ্টা ও বিজেপি কর্মী মুরলী মুলচান্দানী এবং বিজেপির মহিলা শাখার সদস্য স্নেহাবেহেন ভাটিয়াকে নিয়ে গড়ে তোলা পাঁচ সদস্যের কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে ১১ জন গণধর্ষণকারী ও খুনীর মুক্তির পক্ষে মতামত দেয়। গুজরাট সরকার ‘সু-সংস্কার’, ‘ভদ্র ব্যবহারের’ জন্য এই অপরাধীদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মকুব করার ঘোষণা করে। ১৫ আগস্ট ২০২২, স্বাধীনতা দিবসের দিন মুক্তি পায় উক্ত ১১ জন। মালা, মিষ্টি নিয়ে তাদের বরণ করে উৎসবে মাতে বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মতন দলগুলি। সেইদিন থেকে বন্দী হয়েছে বিলকিসের স্বাধীনতা। পরিবারকে নিয়ে প্রাণভয়ে পালিয়ে বেরাচ্ছেন বিলকিস। ধর্ষকের আজাদী আর ধর্ষিতার দমন — আজকের ভারতের বাস্তবতা।

গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মীরা, গুজরাট সরকারের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে। প্রত্যুত্তরে, সুপ্রিম কোর্ট গুজরাট সরকারকে নোটিশ জারি করে জনস্বার্থ মামলায় ওঠা প্রশ্নের বিষয় তাদের উত্তর জানতে চায়। নোটিশের উত্তরে গুজরাট সরকার জানায় যে, তারা বিলকিস বানো মামলায় ১১ জন আসামিকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কারণ তারা “১৪ বছরের বেশি কারাগারে সাজা কাটাচ্ছে এবং এই সময় তাদের আচরণ ‘ভালো’ বলে প্রমাণিত হয়েছিল এবং অমিত শাহের নেতৃত্বে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকও এই সিদ্ধান্তে সম্মতি/অনুমোদন জানিয়েছিল।” গুজরাট সরকারের হলফনামা থেকে আরো জানা যায় যে, সিবিআই’এর বিশেষ অপরাধ শাখা, বৃহত্তর বোম্বের সিভিল সেশনস কোর্ট, এই ১১ জন অপরাধীর মুক্তির বিপক্ষে মত দিয়েছিল। গোধরা সাব-জেলের সুপারিনটেন্ডেন্টের চিঠির উত্তরে, সিবিআই আধিকারিক বলেছিলেন যে অপরাধটি “জঘন্য এবং গুরুতর” তাই অপরাধীদের “মুক্তি দেওয়া যাবেনা এবং তাদের প্রতি কোনও প্রকার ছাড় দেওয়া যাবে না”। প্রসঙ্গত, এই ১১ জন অপরাধী কারাবাসে কাটানো ১৪ বছরের মধ্যে নূন্যতম ৯০০ দিক এবং সর্বাধিক ১,৫০০ দিন প্যারোলে জেলের বাইরে মুক্ত জীবন কাটিয়েছে। ২০২০ সালে প্যারোলে কাটানো সময়ের মধ্যে, ১১ জন আসামীর মধ্যে অন্যতম মিতেশ ভাটের বিরুদ্ধে ভারতীয় দন্ডোবিধি ৩৫৪ ধারায় যৌন হেনস্থার অভিযোগ দায়ের হয়। কিন্তু এই তথ্যকে ১১ জন সাজাপ্রাপ্ত গণধর্ষণকারীর মুক্তির সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে গুজরাট সরকার মান্যতা দেয়নি।

সম্প্রতি ধর্ষক ও খুনি গুরমিত রামরহিমকে প্যারোলে মুক্তি দিয়েছে হরিয়ানার সরকার। ২০২২ সালের মধ্যে এই নিয়ে ৩ বার প্যারোলে মুক্তি পেল রামরহিম। মুক্তি পাওয়ার পরেই, উত্তরপ্রদেশে রামরহিমের ডাকা ‘সৎসঙ্গ’ সভায় উপস্থিত হয়েছিল বিজেপির নেতা মন্ত্রীরা। হরিয়ানায় আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের আগে রামরহিমকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া বিজেপির ঘৃণ্য নির্বাচনী প্রচারের অঙ্গ। একইভাবে, গুজরাটে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে ধর্মীয় বিদ্বেষকে ধুয়ো দিয়ে নির্বাচনী ফসল তোলার লক্ষে গুজরাট সরকারের এহেন সিদ্ধান্ত, এমনটা মনে করছেন অনেকেই।

বিজেপির উদ্দ্যেশ্য কী?

শুধুমাত্র নির্বাচন জিতে সরকারি ক্ষমতায় আসা নয়, বিজেপি-আরএসএস’এর লক্ষ্য ভারতের গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্বের স্তম্ভগুলোর কার্যকারিতা নষ্ট করে দেওয়া। বিচারব্যাবস্থা, আইন ও নীতিপ্রণয়ন, সংবাদ ও সামাজিক মাধ্যমের স্বয়ংক্রিয়তাকে দুরমুশ করে, কার্যনির্বাহকদের হাতের মুঠোয় নিয়ে এসে হিন্দুত্ববাদী সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র গড়ে তোলাই এদের সাচ্চা উদ্দেশ্য। বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে রামমন্দির বানানো, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন চাপিয়ে দেওয়া, মানবধিকার কর্মীদের রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের প্রয়োগ করে জেলের মধ্যে পচিয়ে মারার চক্রান্ত থেকে বিলকিস বানোর আসামিদের সাজা মুকুব করা — এসবই ফ্যাসিবাদী হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের বিভিন্ন কর্মসূচি। আজাদীর অমৃতকালে, ফ্যাসিস্ট বিজেপি সরকার একদিকে নারীশক্তির স্তোতবাক্য বলে অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক হিংসার নিকৃষ্টতম প্রদশর্নকারীদের বেকসুর খালাস করে আদপে বার্তা দিতে চায় এক অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যত ভারতের। যে ভারতে মুসলিম নারীর ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষার অস্তিত্ব নেই, যে ভারতে ধর্মের নামে ধর্ষণকে উদযাপন করা যায়, যে ভারতে স্বাধীনতার মানে শুধুই ধনী, ব্রাহ্মণ, পুরুষদের স্বাধীনতা। এহেন, সর্বগ্রাসী ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ভারতের সংবিধান ও গণতন্ত্রের মূল্যবোধকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা বর্তমানে আশু প্রয়োজন। বিলকিস বানোর ন্যায়ের জন্য লড়াই একা বিলকিসের লড়াই নয় — এ লড়াই ভারতের গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের টিকে থাকার লড়াই, ধর্ম-নিরপেক্ষতা বাঁচিয়ে রাখার লড়াই, নারীর স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার লড়াই, নীপিড়িত মানুষের ক্ষমতা দখলের লড়াই, সাম্যবাদের স্বপ্ন ছড়িয়ে দেওয়ার লড়াই — এ লড়াই জিততে হবে।

- সম্প্রীতি

খণ্ড-29
সংখ্যা-41