প্রতিবেদন
নাজি জমানার ভয়াবহ দিনকাল ও গুন্টার গ্রাসের টিন ড্রাম
The horrors of the Nazi era

(ফ্যাসিবাদ, নাজিবাদের ভয়াবহ দিনকালের কথা উঠে এসেছে তাঁর কালজয়ী সৃষ্টি টিন ড্রাম উপন্যাসে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের আজকের ভারতবর্ষের লড়াইকে মাথায় রেখে আমরা এই উপন্যাসকে ফিরে পড়তে চেয়েছি। - সম্পাদকমণ্ডলী)

গুন্টার গ্রাস সাহিত্যিক। পাশাপাশি তিনি ইতিহাসের এক অন্যতম আলোড়ন তোলা পর্বের অসামান্য ভাষ্যকার।

গুন্টার গ্রাসের ‘টিন ড্রাম’ উপন্যাসটি ইতিহাসের সবচেয়ে আলোড়ন তোলা পর্বগুলির একটি — দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে রচিত। কিন্তু বাইরের বড় বড় ঘটনা এর মূল বিষয়বস্তু নয়। সেই সব বড় ঘটনার অভিঘাতে কীভাবে জীবন, সমাজ, পরিবার, শহর বদলে যাচ্ছে তার অন্তরঙ্গ ভাষ্য তুলে ধরে ‘টিন ড্রাম’। ডানজিগ এমন এক শহর যেখানে কাশুভিয়ানরা ছিল, ছিল পোলরা এবং জার্মানরা। সেই বহুত্ববাদী সাংস্কৃতিক সামাজিক বিন্যাসটা নাজি জমানায় কীভাবে ছাড়খার হয়ে গেল এই উপন্যাস তার এক মর্মান্তিক ছবি রয়েছে। ইহুদী নির্যাতন ও হত্যা তথা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের ভয়াবহতা পোল্যান্ড ও ডানজিগের এই পর্বের ইতিহাসের এক ভয়াবহ বাস্তবতা। কিন্তু সেই ভয়াবহতাকে দু’একটি অধ্যায়ে দু’একটি প্রেক্ষিতে কেবল আভাসিত করা হয়েছে৷ মার্কুসের দোকান ভাঙচুর ও তার আত্মহত্যা এরকম একটি দৃশ্যপট তৈরি করেছে৷ আর একটি উল্লেখ রয়েছে ডানজিগ থেকে যখন মারিয়া চলে যাচ্ছে অস্কার আর কুর্টকে নিয়ে। বলা হয়েছে, যে ট্রেনে তারা যাচ্ছে একদা সেই ট্রেনেই কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে লোক পাঠানো হত।

একদিকে সাম্রাজ্যবাদ ও অন্যদিকে ফ্যাসিবাদ-নাজিবাদ এবং এই দুই যুদ্ধমান শিবিরেরই সাধারণ শত্রু সোভিয়েত সমাজতন্ত্র বিশ শতকের প্রথমার্ধ জুড়ে পরস্পরের যে মহড়া নিয়েছে, তার সবচেয়ে মারাত্মক ও ধ্বংসাত্মক পরিণতি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। প্রায় আট কোটি লোক এই যুদ্ধে মারা যায়। আহত, পরিবার স্বজন হারানো, নানাভাবে বিধ্বস্ত মানুষের সংখ্যা ছিল অগণিত।

হিটলারের নাজি জার্মানি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে বড় কারণ এবং যুদ্ধে সববৃহৎ ক্ষয়ক্ষতি যাদের হয়েছিল জার্মানি ছিল তার অন্যতম। ১৯৩৩এ হিটলারের ক্ষমতা দখলের পর থেকেই জার্মানির ভেতরে নাজি-বিরোধী, ইহুদী, অশক্ত, ভিন্ন যৌনতার মানুষজনের ওপর মারাত্মক আঘাত নেমে আসে। পোল্যান্ড সহ নানা দেশের ইহুদীরা জার্মান আগ্রাসনের পর মারা যায় দলে দলে। সব মিলিয়ে সংখ্যাটা ছিল কম করেও অর্ধকোটির কাছাকাছি। জার্মানি যুদ্ধ শেষ হবার পরেই দ্বিধাবিভক্ত হল। পূর্ব জার্মানি এল সোভিয়েত প্রভাবে আর পশ্চিম জার্মানির ওপর আধিপত্য থাকল ব্রিটেন, ফ্রান্স ও আমেরিকার। ক্রমশ দুই জার্মানিতেই শুরু হল পুনর্গঠন। আবার ঠান্ডা যুদ্ধের আবহ পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানিকে পরস্পরের থেকে সরিয়ে রাখল অনেকটা দূরে। বার্লিনের দেওয়াল হয়ে উঠল ঠান্ডা যুদ্ধের অন্যতম প্রতীক। এই জটিলতা পেরোতে পেরোতেই জার্মানি ক্রমশ ফিরে তাকাল তার ভয়াবহ নাজি অতীতের দিকে। সাহিত্যে এর শুরুটা হল যুদ্ধোত্তর কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জার্মান উপন্যাস গুন্টার গ্রাসের ‘টিন ড্রাম’ দিয়ে।

১৯৫৯ সালে বইটি প্রকাশের পর তা নিয়ে নানা বিরূপ সমালোচনা কোথাও কোথাও হল বটে, কিন্তু অচিরেই সেটি পেয়ে গেল ধ্রুপদী সাহিত্যের মর্যাদা। শুধু জার্মানিতে নয়, এর ইংরাজি অনুবাদ ইউরোপ আমেরিকা সহ সারা বিশ্বেই নজর কাড়ল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এর ইংরাজি অনুবাদ বিক্রি হল চার লক্ষেরও বেশি এবং নিউ ইয়র্কটাইমস পত্রিকার বেস্ট সেলার লিস্টে এটি টানা তিন সপ্তাহ এক নম্বরে থাকল।

জার্মানি, পোল্যান্ড ও সংলগ্ন ইউরোপের বিশ শতকী ইতিহাস ‘টিন ড্রাম’এ বারবার এসেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নায়কের মা আগনেস বড় হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কাহিনীর নায়ক অস্কার। আগনেস আর ইয়ানের প্রেমের প্রথম দিনগুলোয় ইয়ানের যুদ্ধে যাবার আশঙ্কা, যুদ্ধ শেষে আগনেস আর মাৎসেরাটের দাম্পত্যর দিনগুলোয় মন্দার ছায়াপাত আর তার বিরুদ্ধে লড়াই’এর ছবি রয়েছে।

১৯৩৩ সালে জার্মানিতে হিটলার ক্ষমতায় এলেন। পোল্যান্ড ও ডানজিগও বদলাতে শুরু করল। বড় বড় সমাবেশ ও মশাল মিছিল হতে থাকল নাজিদের। মাৎসেরাট পরিবর্তন বুঝে নিয়ে ১৯৩৪এ নাজি পার্টিতে যোগ দিল।

tin drum of Gunter Grass

এই অংশ থেকেই টিন ড্রাম সমকালীন রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে প্রবলভাবে প্রবেশ করে। চরিত্র ও পরিবারের ভেতরের বদলগুলো দেখাতে শুরু করে। ক্রমশ মাৎসেরাট নাজি পার্টির উর্দিতে নিজেকে সজ্জিত করতে শুরু করল। একে একে কিনতে লাগল বিভিন্ন অংশ। প্রথমে সে কিনেছিল পার্টির ক্যাপটুপিটা। তারপর খাঁকি শার্ট, তারপর উঁচু বুট জুতো। এইভাবে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মাৎসেরাট এসে গেল পুরোদস্তুর নাজি উর্দিতে। প্রতি রবিবার এই পোষাকে সজ্জিত হয়ে মাৎসেরাট নাজিদের শক্তি প্রদর্শনমূলক ড্রিল প্যারেডে অংশ নিত। মঞ্চ বেঁধে যে বড় বড় সমাবেশ হত নাজিদের, তার শুরুর দিনগুলোর কথা এখানে এসেছে বিস্তারিত অনুপুঙ্খে।

অস্কার তার ড্রাম নিয়ে এইসব নাজি সমাবেশে হাজির হত, সেখানে বাজাত এবং ক্রমশ তার বাজনা জনপ্রিয়তাও পেতে শুরু করে। তখন তার বয়েস বছর এগারো। বছর পাঁচেক, উনিশশো আটত্রিশ পর্যন্ত সে এইভাবে ডানজিগের নাজি সমাবেশগুলোতে নিয়মিত ড্রাম বাজিয়ে যেত।

অস্কারের জীবনের ভাঙচুর দিয়ে টিন ড্রাম উপন্যাসের প্রথম পর্বের সমাপ্তি। আর দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় ডানজিগের পোলিশ ডাকঘরের ওপর নেমে আসা ভয়াবহ আক্রমণের কথা দিয়ে। দ্বিতীয় পর্বের দ্বিতীয় অধ্যায়ে ডানজিগের পোলিশ ডাকঘরের ওপর শুরু হল নাজি আক্রমণের অনুপুঙ্খ বর্ণনা রয়েছে। অস্কার তখন সেখানে গেছিল তার ড্রাম ঠিক করাতে। আর ডাকঘরের আধিকারিক হিসেবে সেখানে উপস্থিত ছিল ইয়ান ব্রনস্কি ও তার সহকর্মীরা। ইয়ান হয়ত ছিল পোলিশ আন্ডারগ্রাউন্ড রেজিস্ট্যান্স গ্রুপের এক সক্রিয় সদস্য, তবে গোপন বলেই অস্কারের তা জানার কথা নয়। কিন্তু পাঠক আখ্যান থেকে এরকম অনুমান করতে পারেন। বোমা বর্ষণে ইয়ান আহত ও রক্তাক্ত হয়, গুরুতর আহত কোবিয়েলাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। কনরাডকে পাওয়া যায় মৃত অবস্থায়। যুদ্ধ নেমে এসেছে বুঝতে পেরে তখন ইয়ানরা অপেক্ষা করতে থাকে ফরাসি আর ব্রিটিশদের সাহায্যের জন্য। অস্কার এই ঘটনার পরেই প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হয় ও তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে অনেকদিন থাকতে হয় তাকে। হাসপাতালে শুয়ে সে শুনতে পায় বোমা বিস্ফোরণের শব্দ। একদিন হঠাৎ খেয়াল করে সে তার ড্রামটার কথা অনেকদিন ভাবেনি। এই প্রথম অস্কার উপলব্ধি করে যে টিনের ড্রামের বাইরেও একটা অন্য বড় জগৎ রয়েছে। এই পর্বেই ইয়ান সহ যারা ডানজিগের পোলিশ ডাকঘরটা রক্ষা করার চেষ্টা করেছিল, তাদের গুলি করে হত্যা করে নাজিরা। ক্রমশ রিক্ত ও নিঃসঙ্গ হতে থাকে অস্কার।

ডানজিগ ও গোটা বিশ্বে যখন বড় বড় ঘটনা ঘটছে তখনো টিন ড্রাম উপন্যাসে তার ন্যারেটিভ প্যাটার্নকে পরিবর্তন করেননি গুন্টার গ্রাস। নাজি জার্মানির আক্রমণে বিধ্বস্ত হওয়ার উচ্চকিত বর্ণনা দেননি। অস্কারের রোজকার জীবনযাপনের কথা বলতে বলতেই সেসবের আভাস দিয়ে গেছেন।

টিন ড্রাম উপন্যাসের তৃতীয় পর্বে মারিয়া ও অস্কারকে বিপ্রতীপে স্থাপণ করেন গুন্টার গ্রাস। মারিয়া যেখানে পশ্চিম জার্মানির পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায় মিশে যেতে পারে ও নব্য বুর্জোয়া গোষ্ঠীতে ঢুকে পড়তে সক্ষম হয়, সেখানে থিতু হতে হতেও শেষপর্যন্ত এক গভীর মনস্তাপের মধ্যে বন্দী হয়ে যায় অস্কার। এক বেদনাবোধ ও আত্মধিক্কার থেকেই সে নিজেকে হত্যাকারী ভাবতে থাকে। বলতে থাকে তার বাবা, মা, কাকা, বান্ধবী — সবার হত্যাকারী সে। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকায় আঠাশ বছর বয়সে এসে তার ঠাঁই হয় এক মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রে। সেখানেই দু’বছর ধরে সে লেখে তার আত্মকথা। তার তিরিশ বছরের জন্মদিনে এসে সেই আত্মকথা ও টিন ড্রাম উপন্যাসের সমাপ্তি।

গুন্টার গ্রাস দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও নাজি জার্মানির দিনকাল সংশ্লিষ্ট উপন্যাস রচনার যে ধারাটি জার্মান সাহিত্যে শুরু করলেন, তা ধরে পরে আরো অনেকে লিখলেন বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ জুড়ে। ইউরেক বেকার, হাইনরিখ ব্যোল, বিলার্ড উম, হালবৎসেন, উভে ইয়নসন, উইবার ইয়াকব, পেটার ভাইস, ক্রিস্টা ভলভ প্রমুখের কথা এই প্রসঙ্গে মনে করা যায়।

– সৌভিক ঘোষাল

খণ্ড-29
সংখ্যা-41