প্রতিবেদন
এনআইএ’র হাতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দিচ্ছে কেন্দ্র
absolute power to NIA

২৭ অক্টোবর ২০২২ সালে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সমস্ত রাজ্যসরকারগুলিকে নিয়ে দেশের নিরাপত্তা বিষয়ক একটি মিটিং ডাকেন। ব্যাপারটা যতটা সাধারণ এক আমলাতান্ত্রিক পদক্ষেপ বলে মনে হচ্ছে বিষয়টা ঠিক ততটা সহজ সরল নয়। কেন্দ্রে চলছে একটি ফ্যাসিস্ট সরকার। তার উদ্দেশ্যগুলি সম্পুর্ণ অন্যরকম। কারণ এদের সাথে সঙ্ঘ পরিবার সরাসরি যুক্ত ও তাদের পরামর্শেই চলে কেন্দ্রের এই ফ্যাসিস্ট সরকার।

২০২৪তে বিজেপি জয়যুক্ত হলে সাইবার ক্রাইম, চোরাচালান, নারী পাচার, মাদক পাচার ইত্যাদি অপরাধের তদন্তভার রাজ্যের এক্তিয়ার থেকে এনআইএ’র কাছে চলে যাবে। প্রতিটি রাজ্যে কার্যালয় খুলবে এনআইএ। এমনটাই এই মিটিং’এ জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। প্রয়োজনে নতুন আইন এনে এই পদ্ধতি নির্ধারণ করা হবে। শুধু তাই নয় মোদী সরকার এও বলেছে যে “দেশে যেভাবে এক রেশন কার্ড, এক বিদ্যুতের গ্রিড রয়েছে, তেমনই একটি পুলিশ উর্দি দেওয়া হোক সব রাজ্যের পুলিশকে। সব রাজ্যের জন্য এক ধরনের উর্দির কথা ভাবতে পারে রাজ্যগুলি।” এইভাবে পোষাককে সামনে রেখে আগামী দিনে গোটা দেশের জন্য একটা কেন্দ্রীভূত পুলিশ বাহিনী গঠনের বিষয়টি বেশ আঁটঘাট বেঁধে ভাসিয়ে দিলেন মোদী। এটা অনেকটা হিটলারের গেস্টাপো বাহিনীর আদলে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে একটা বাহিনী গঠনের মতো শুনতে লাগছে।

নিজের যুক্তির পক্ষে শান দিতে মোদী আরও এগিয়ে গিয়ে বলেছেন যে ইতিমধ্যেই সারা দেশের জন্য এক রেশন কার্ড তৈরি হয়েছে। দেশবাসীর জন্য তৈরি হয়েছে একই ধাঁচের স্বাস্থ্য কার্ড। পাশাপাশি গোটা দেশে এক ভাষা, একই সঙ্গে বিধানসভা-লোকসভা নির্বাচন চালুর প্রশ্নে তদ্বির চালিয়ে যাচ্ছে বিজেপি নেতৃত্ব।

ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর আঘাত হানতে চাইছে ফ্যাসিস্ট বিজেপি। রাজ্য সরকারগুলির কার্যকলাপে হস্তক্ষেপ করতে চাইছে ফ্যাসিস্ট বিজেপি। সংবিধান অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব রাজ্যের হাতে থাকলেও সন্ত্রাস, মাদক, দেশবিরোধী কার্যকলাপ, সাইবার অপরাধের মতো ঘটনায় কেন্দ্র যে রাজ্যের অধিকারের বাইরে গিয়ে প্রয়োজনে হস্তক্ষেপ করবে, তা অমিত শাহ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলেই ফেলেন। ২০২৪’র মধ্যে সবকটি রাজ্যে এনআইএ’র দপ্তর খোলা হবে বলে জানিয়েছেন অমিত শাহ। এইভাবে ভারতের গণতন্ত্রের কাঠামোটাই বদলে দিতে চাইছে ফ্যাসিস্ট বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবার। এনআইএ রাজ্যের সব ব্যাপারে নিয়ন্ত্রণ করবে। দেখা গেল, লক্ষ্মীপুজোর দিন কলকাতায় হওয়া মোমিনপুরের গোষ্ঠী সংঘর্ষ, বেশ কিছুদিন আগে তামিলনাড়ুর কোয়েম্বত্তুরে হওয়া গাড়ি বিস্ফোরণের তদন্তের ভার নিয়েছে এনআইএ। এগুলোই প্রমাণ করে রাজ্যে যে কোনো স্পর্শকাতর ঘটনাই এখন এনআইএ বা সিবিআই’র হাতে তুলে দেওয়ার প্রবণতা শুরু হয়েছে।

অবশ্য বিজেপি সরকার এটা অনেক দিন থেকেই করছে। কতগুলি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে যেমন,

১) জিগনেশ মেবানীর গ্রেফতারি। জিগনেস আসামে মোদী বিরোধী কথা বলেন এবং তাকে আসামের পুলিশ গুজরাতে গিয়ে গ্রেফতার করে। গুজরাত সরকার বা গুজরাত পুলিশের কাছে কোনরকম অনুমতির নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না।

২) পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী দিশা রবিকে কৃষক আন্দোলনের সময় দিল্লী পুলিশ ব্যাঙ্গালুরুতে গিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করেছিল। স্থানীয় পুলিশ, প্রশাসন থানার কোনো অনুমতি নেয়নি। এমনকি দিশা রবির মা, কন্যার গ্রেপ্তার সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না।

এছাড়াও আমরা দেখেছি তিস্তাকে গুজরাট পুলিশ মুম্বাই থেকে গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করে। তিস্তা প্রতিবাদ করেন এবং তাদের বাধ্য করেন স্থানীয় সন্তাক্রুজ থানা থেকে ওয়ারেন্ট বার করতে। তিস্তা শিতলবাদের মত আইনজীবীর যদি এই অবস্থা হয় তাহলে সাধারণ মানুষ কতটা অসহায় বোধ করবে সেটা বোঝাই যায়।

আমরা এও দেখছি ইডি এবং সিবিআই’কে যথেচ্ছ ব্যবহার করা হচ্ছে বিশেষ করে বিরোধী দলগুলোর উপর। অর্থাৎ যেখানে বিজেপি সোজা পথে সরকার গড়তে পারবে না সেখানেই তারা বিরোধী দলগুলোর উপর সিবিআই এবং ইডি’কে লেলিয়ে দিচ্ছে।

আমরা এও লক্ষ্য করে দেখেছি যে এনআইএ কিভাবে যখন তখন যেকোন রাজ্যে ঢুকে পড়ছে এবং সেখানকার সংখ্যালঘু এবং আদিবাসী মানুষদের গ্রেফতার করছে, হয়রানি করছে এবং সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দিচ্ছে।

ভারতে মুসলমান পীড়ন, দলিত নিপীড়ন, নারী নির্যাতনকারীদের মুক্তি পাওয়াটা এখন এক নিয়মে দাঁড়িয়েছে। রাম-রহিমের মতো দাগি আসামী পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে যে শুধু প্যারোলে ছাড়া পাচ্ছে তাই নয়, ওই কুখ্যাত অপরাধীকে দেওয়া হচ্ছে জেড প্লাস নিরাপত্তার বলয়! আর, এবার মোদী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের উপস্থিতিতে ‘চিন্তন শিবির’ সম্মেলনে কোনো রাখঢাক না করে খোলাখুলি বলেছেন “বন্দুক ধরে যে, সে যেমন মাওবাদী তেমনি যিনি লেখনীর মাধ্যমে মাওবাদকে উৎসাহ দেন, তিনিও মাওবাদী। দু’জনেই দেশের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক। তাই এঁদের চিহ্নিত করে ছেঁটে ফেলতে হবে।” আগেও আমরা দেখেছি সরকার বিরোধী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করতে, কখনো ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’, ‘শহুরে নকশাল’ নাম দিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আর অধিকার আন্দোলনের কর্মী, বুদ্ধিজীবী আর সাংবাদিকদের জেলে ঢুকিয়েছে, বিচারব্যবস্থাকে নিজের পকেটে পুরে বছরের পর বছর দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের জামিন না দিয়ে আটকে রেখেছে। এদিকে বিলকিস বানোর ধর্ষক ও খুনিদের জেল থেকে মুক্তি দিতে খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক সবুজ সংকেত দেয়। সরকার বিরোধিতাই এখন রাষ্ট্রদ্রোহিতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একেবারে অতি সহজে বিরোধীদের জেলে ঢোকাতেই এই আইন। দেশকে শিক্ষিত প্রতিস্পর্ধী প্রতিবাদী ব্যক্তিমুক্ত করা ফ্যাসিবাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। তারমধ্যে এবার যুক্ত করতে হবে মুক্তবুদ্ধি মানুষদের আর মানুষ যাদের কথা শোনে তাদের নামগুলো। তাই দরকার এনআইএ ।

যে কোনো প্রতিবাদী, রাজনৈতিক বিরোধী এবং নিপীড়িত জাতিসত্তা এবং জনগোষ্ঠীগুলোকে মাথা তুলতে না দেওয়ার জন্যেই এই পরিকল্পনা।

সম্প্রতি সাইবাবার পুনর্বন্দীকরণে ‘বিচারক’ যেই বিপজ্জনক মস্তিষ্কেরই অমোঘ উক্তিটি করেছিলেন, আন্তোনিও গ্রামশ্চি’কে জেলে পোরার সময়ে সেই সময়কার ‘বিচারক’ বলেছিলো “আগামী কুড়ি বছর এই আওয়াজকে বাইরে বেরোতে দেওয়া যাবে না, দেশের নিরাপত্তার কারণে”। আর আজ, মোদীও সেই লেখনী সেই মস্তিষ্ককেই দেশের নিরাপত্তার পক্ষে সবচেয়ে বড় বিপদ বলে দাগিয়ে তাঁদের ‘ছেঁটে’ ফেলার ডাক দিলেন, যে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সমস্ত রাজ্যগুলোর মুখ্যসচিব, ডিজিপি, গোয়েন্দা বাহিনীর শীর্ষকর্তা, আধা সামরিক বাহিনীর ডিজিরাও। অর্থাৎ দেশে দেশে ফ্যাসিবাদ এবং স্তাবক বিচারকরা একই ভাষায় কথা বলে, একই সুরে গান গায়।

পুরো দেশজুড়ে কেন্দ্রীয় শাসন চালানোর চেষ্টা হচ্ছে। রাজ্য সরকারগুলির ক্ষমতা দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে। সংকুচিত করা হচ্ছে দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো। দেশকে শক্তিশালী করার বাহানায়, কেন্দ্রীয় শাসন সমস্ত ক্ষমতাকেই কুক্ষিগত করে নিরঙ্কুশ ফ্যাসিবাদী শাসনতন্ত্র কায়েম করার দিকে এগোলো আরও এক ধাপ।

আজকে এই ভয়ঙ্কর সময়ে বামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে পথে নামতে হবে (তাদের নিজেদের মধ্যে বিতর্কগুলো রেখেই) এবং সাথে সাথে বিজেপি-বিরোধী শক্তিগুলোর সাথে যতটা সম্ভব হাঁটতে হবে।

- অর্ণব মুখার্জি

খণ্ড-29
সংখ্যা-42