সম্পাদকীয়
নোটবন্দীর পরিহাস, অর্থনীতির রাহুগ্রাস
the collapse of the economy

২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী আচমকাই নোটবন্দী ঘোষণা করে ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোটগুলোকে বাতিল করে দিলেন। তারপর অতিক্রান্ত হল ছ’ছটা বছর। সন্ত্রাসবাদ, অর্থনীতিতে কালো টাকার রমরমাকে রোধ করতে এবং শেষ বিচারে দুর্নীতি ঠেকাতে ওই বিধ্বংসী টোটকা সমগ্র দেশবাসীকে চরম বিপদে ফেলে, দেশের অর্থনীতির উপরই বিরাট আঘাত হেনেছিল। দেশের অর্থনীতির উপর নগদ টাকা প্রচলনের নির্ভরতা কমিয়ে ক্রমে ক্রমে ডিজিটাল লেনদেনের দিকেই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটা ছিল সরকারের আরেকটা ঘোষিত লক্ষ্য।

পরিহাস এটাই, রিজার্ভব্যাঙ্কের প্রকাশিত তথ্য জানাচ্ছে, এবছর ২১ অক্টোবর পর্যন্ত দেশবাসীর কাছে নগদ টাকার জোগান নোটবন্দীর ছ’বছর পর ৭১.৮৪ শতাংশ হারে বেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৩০.৮৮ লক্ষ কোটি টাকায়! সহজ কথায়, অর্থনীতিতে নগদ টাকা জোগানের পরিমাণ ব্যাপকহারে কমিয়ে অনলাইন বা ডিজিটাল মাধ্যমের দিকে এগিয়ে যাওয়ার যে অন্যতম ঘোষিত লক্ষ্য ছিল নোটবন্দীর, তা পুরোপুরি মুখ থুবড়ে পরেছে শীর্ষব্যাঙ্কের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী। নোটবন্দীর ঠিক আগে, ৪ নভেম্বর ২০১৬-তে, রিজার্ভব্যাঙ্ক জানায়, বাজারে নগদ টাকার পরিমাণ ছিল ১৭.৭ লক্ষ কোটি টাকা, যা এখন এক লাফে বেড়েছে ৩০.৮৮ লক্ষ কোটি টাকায়। নোটবন্দী শুরুর সময়ে তার লক্ষ্য উদ্দেশ্য নিয়ে দেশবাসীকে যা শোনানো হয়, পরবর্তীতে দ্রুতই বদলে যেতে থাকে গোল পোস্ট। লেনদেনে নগদের জোগান ব্যাপক মাত্রায় কমিয়ে ডিজিটাল মাধ্যমে লেনদেনের উপর জোর দেওয়া হতে থাকে। কিন্তু, আজ এটা স্পষ্ট, ওই লক্ষ্য পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।

প্রখ্যাত অর্থশাস্ত্রী জঁ দ্রেজ বলেছিলেন, ছুটন্ত এক গাড়ির টায়ারে গুলি করে থামিয়ে দেওয়ার সামিল ছিল নোটবন্দী। ভারতের সচল অর্থনীতিকে আচমকাই থামিয়ে দিয়ে বিরাট সর্বনাশ ডেকে আনল মোদীর নোটবন্দী। আর তারপর থেকে ভারতীয় অর্থনীতি চলে গেল রাহুগ্রাসের কবলে।

২০১৬-১৭-তে ভারতের বৃদ্ধির হার ছিল ৮.৩ শতাংশ। তারপর ক্রমাগত তা নিচে গড়াতে শুরু করে — পরের বছরগুলোতে যথাক্রমে ৬.৯ শতাংশ, ৬.৬ শতাংশ, ৪.৮ শতাংশ এবং -৬.৬ শতাংশ হারে এসে দাঁড়ায়। এইভাবে নিচুতে অর্থনীতির ধারাবাহিকভাবে নেমে যাওয়া স্বাধীনতার পরবর্তীকালে আগে কখনও দেখা যায়নি। এরই পাশাপাশি ভারতের বেকারত্বের হার এখন রীতিমতো উদ্বেগজনক। সম্প্রতি আইএলও’র সংগৃহীত তথ্যের উপর দাঁড়িয়ে বিশ্বব্যাঙ্ক ভারতীয় তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের যে ছবি হাজির করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে যে ভারত ঢুকে পরেছে অস্থিরতায় ভোগা পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোর সারিতে। আমাদের দেশে ১৫ থেকে ২৪ বছরের তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার ২৮.৩। যেখানে ইরান-মিশর-সিরিয়ার হার হল যথাক্রমে ২৭.২, ২৪.৩ এবং ২৬.২ শতাংশ। এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় তা আরো অনেক বেশি খারাপ। বেশিরভাগ এশিয়ার দেশ যেমন ইন্দোনেশিয়া মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশে এই হার যথাক্রমে ১৬, ১৫.৬ এবং ১৪.৭ শতাংশ।

দেশের অর্থনীতি বিরাজমান সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশ নিরপেক্ষভাবে যে বিকাশ লাভ করতে পারে না তা আজ এক প্রতিষ্ঠিত সত্য। গণতান্ত্রিক পরিমন্ডল সংকুচিত হলে, দেশের অভ্যন্তরে নানান প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হলে, চাপা সন্ত্রাস, ভয়ভীতি ও পারস্পরিক অবিশ্বাস, ঘৃণা ও বিভাজনের রাজনীতি প্রাধান্য বিস্তার করলে আর্থিক বিকাশ গতিরুদ্ধ হয়।

আমাদের দেশ আজ এমনই এক পরিবেশের মধ্য দিয়ে চলেছে। চরম লজ্জার বিষয় হল, ভারতীয় তরুণদের বেকারত্বের হাল আজ ইরান, যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া’র থেকেও খারাপ। নোটবন্দী থেকে শুরু হয়েছিল এই অধঃপাতের অভিমুখে অর্থনীতির যাত্রা। তারপর জিএসটি, কোভিড মরার উপর খাঁড়ার ঘা এনে সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিল। ঘুরে দাঁড়ানোর সংকল্প না নিয়ে মোদী জমানা এই সর্বনাশা অবস্থাকেই গৌরবান্বিত করছে, ক্রমাগত ভারতীয় টাকার অবমূল্যায়নকে উপেক্ষা করে বলছে, “টাকার দাম কমছে না, আসলে ডলার শক্তিশালী হচ্ছে”।

ভারতের আজ চরম দুর্দিন। বিপর্যয় ও সর্বনাশের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি।

খণ্ড-29
সংখ্যা-43