পিতৃতন্ত্রের শেকল ছিঁড়েও ছেঁড়ে না – শ্রমশক্তিতে ভারতীয় মহিলাদের অংশগ্রহণ ক্রমশ কমে যাওয়াটা এক অদ্ভুত ব্যাপার
The shackles

(এআইসিসিটিইউ’র অনলাইন মাসিক পত্রিকা ওয়ার্কার্স রেজিস্ট্যানস্’এর অক্টোবর ২০২২ সংখ্যায় এই লেখাটি প্রকাশিত হয়। লেখক সুচেতা দে। লেখাটির গুরুত্ব বুঝে তার বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করা হল — সম্পাদকমন্ডলী দেশব্রতী)

ভারতে জনপরিসরে মহিলাদের অংশগ্রহণে একটা ভারী অদ্ভুত প্যাটার্ন ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। সুরক্ষিত চাকরিতে ভারতীয় মহিলাদের অংশগ্রহণ ও নিয়োগ ক্রমশ কমছে। যদিও বিগত কয়েক দশক ধরে মহিলারা নিজেদের জন্য একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে সামাজিক পুঁজি অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন, প্রতিটি স্তরে পিতৃতান্ত্রিক দাসত্ববন্ধনকে প্রতিস্পর্ধাভরে উপেক্ষা করে। সাধারণত সামাজিক পুঁজি একজন মানুষের আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ইতিবাচক অবদান রাখে; কিন্তু ভারতে মহিলাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা হয়েছে ঠিক উল্টো।

সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠায় যারা ব্রতী তাদের জন্য বিষয়টি বিশেষ উদ্বেগের। ঐ সমাজ মেয়েদের, জীবনের বিভিন্ন রণভূমিতে এগিয়ে যেতে কখন বাধা দেয় না।

সম্প্রতি প্রকাশিত অক্সফ্যামের রিপোর্টেশ্রমের বাজারে বৈষম্য, বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীগুলোর ওপর অতিমারীর প্রভাব, কৃষি ঋণ বাজারে জাতি-বৈষম্য এবং রোগী-পরিচর্যায় পার্থক্যের বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা রয়েছো। এই সমীক্ষায় বৈষম্যের বিভিন্ন ধরণকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে; আর সেজন্য ২০০৪-০৫ থেকে ২০১৯-২০’র এক বিস্তৃত সময় জুড়ে ভারত সরকার প্রচারিত এনএসএস এবং পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে সহ বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য পরিসংখ্যানের সাহায্য নেওয়া হয়েছে। বর্তমান নিবন্ধে, এই সমীক্ষায় তুলে ধরা বৈষম্যের বহুমুখী প্রকাশের মধ্য থেকে শ্রম বাজারে জাতি, ধর্ম এবং লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের দিকটায় আমরা নজর দেব। গ্রাম-শহরে কর্মসংস্থান ও মজুরি বিষয়ে থাকবে আমাদের বিশেষ আলোকসম্পাত।

আসুন, প্রথমে দেখে নেওয়া যাক শহরাঞ্চলে নিয়মিত কাজে নিয়োগের ব্যাপারটা। সমীক্ষায় প্রকাশ, ২০১৯-২০তে তফসিলি জাতি ও উপজাতি সম্প্রদায়ের কর্মক্ষম জনসংখ্যার ৩৭.৫ শতাংশ নিয়মিত অথবা বেতনভিত্তিক কর্মসংস্থানে নিয়োজিত ছিলেন। এই সময়ে ঐ দুই সম্প্রদায়ের বাইরের কর্মক্ষম জনসংখ্যার ৪১.৩ শতাংশ ঐ ধরণের কাজে নিযুক্ত ছিলেন। অর্থাৎ নিয়মিত বা বেতনভিত্তিক কাজে তফসিলি ও উপজাতি সম্প্রদায় ও তার বাইরের কর্মক্ষম জনসংখ্যার নিযুক্তির শতকরা হারে ফারাক ছিল ৩.৮ শতাংশ। ঐ সময়ের পরিসংখ্যান আবার দেখিয়ে দেয় এক্ষেত্রে মুসলিম ও অ-মুসলিম কর্মক্ষম জনসংখ্যার নিযুক্তির মধ্যে পার্থক্য ছিল ৭.৮ শতাংশ — নিয়মিত কাজে অ-মুসলিম জনসংখ্যার নিযুক্তির হার ছিল বেশি।

এই পর্যায়ে ঐ কাজে পুরুষ ও মহিলার নিযুক্তির হারের ফারাকটা সবচেয়ে চোখে পড়ার মত। ২০১৯-২০-তে নিয়মিত বা বেতনভিত্তিক কাজে পুরুষ ও মহিলার নিযুক্তির হারে ফারাক ছিল ৪১ শতাংশ!

ইন্ডিয়া ডিসক্রিমিনেশন রিপোর্ট : ২০২২’র সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ

অক্সফ্যাম সমীক্ষায় কর্মসংস্থান তথা মজুরির এই পার্থক্যের কারণ বোঝা যাবে। বোঝা যাবে অর্জিত মানসিক সম্পদ (এনডাওমেন্ট)-এর ফারাকের পটভূমি এবং বৈষম্য থেকে। জাতি এবং ধর্মীয় গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে, মানসিক সম্পদের ফারাক কর্মসংস্থানের পার্থক্যের কারণকে স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয়। বৈষম্য কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বিশাল লিঙ্গ বৈষম্যের কারণ স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয়।

সমীক্ষা থেকে যা বোঝা গেছে, যদি অর্জিত মানসিক সম্পদকে সামাজিক মূলধনের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়, তাহলে সমীক্ষাবলছে — মহিলাদের অর্জিত সামাজিক মূলধন তাদের বেতনভিত্তিক কাজে নিযুক্তিকে খুব সামান্যই প্রভাবিত করতে পারে। অক্সফ্যামের সমীক্ষা আরও জানাচ্ছে যে বেতনভিত্তিক কাজে লিঙ্গবৈষম্য জাতি ও ধর্মীয় গোষ্ঠীভেদে তেমন কিছুই পাল্টায় না। গ্রামাঞ্চলে নিয়মিত কাজে নিযুক্তির স্তরে তফসিলি-উপজাতি এবং মহিলাদের প্রতি বঞ্চনা শহরাঞ্চলের থেকে বেশি। গ্রামাঞ্চলে যেমন, মহিলাদের অর্জিত সামাজিক মূলধনের তাৎপর্য খুবই কম তাদের নিয়মিত কাজে নিযুক্তির ক্ষেত্রে। তাছাড়া গ্রামাঞ্চলে সাধারণত পরিবারের কর্তা পুরুষটির শিক্ষার মান মহিলাটির থেকে বেশি হওয়ায় পুরুষটির তুলনায় মহিলাটির নিয়মিত কাজে নিযুক্তির সুযোগটাও কম। এখান থেকে স্পষ্ট যে আজকের ভারতবর্ষেও মহিলাদের নিয়মিত কাজে যোগদানের ক্ষেত্রে পিতৃতান্ত্রিক রীতি নীতি ও সংস্কার কতটা অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।

যদিও নিয়মিত কাজ ও স্বনিযুক্তির একটা সামগ্রিক বিশ্লেষণ থেকে সমীক্ষায় আবারও গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়েছে যে পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের অর্জিত সামাজিক মূলধনের তাৎপর্য তাদের আয়ের ক্ষেত্রে খুবই সামান্য, তবে তফসিলি জাতি ও উপজাতি এবং মুসলিম জনসংখ্যার ক্ষেত্রে তাদের অর্জিত সামাজিক মূলধনের প্রভাব তাদের আয়ের উপর অপেক্ষাকৃত বেশি।

শ্রমশক্তিতে মহিলাদের অংশগ্রহণ কমে যাওয়া : বিরল এবং স্ববিরোধী এক কাণ্ড

মর্যাদাপূর্ণ জীবন পেতে হলে চাই সামাজিক গতিশীলতা। আর সেটা পেতে হলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল শিক্ষিত হওয়া এবং উপযুক্ত কর্মসংস্থান খুঁজে নেওয়া। লিঙ্গের প্রশ্নে বিষয়টা দেখতে গেলে, ২০০০’র দশকের গোড়া থেকে ভারতে যে প্রবণতাগুলো দেখা গেছে, তা শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং সামাজিক গতিশীলতা নিয়ে অদ্ভুত প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার (লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন রেট ‘এলএফপিআর’) একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ সূচক কারণ এটি বলে দেয় কর্মক্ষম বয়সের জনসংখ্যার মধ্যে থেকে ঠিক কতজন চাকরি খুঁজছেন। মহিলাদের কর্মীবাহিনীতে অংশ নেওয়ার ইচ্ছা সমাজ পরিবর্তনের এক গুরুত্বপূর্ণদ্যোতক (মার্কার), যেহেতু তারা ঐতিহাসিক ভাবেই ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি থাকেন। ভারতে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ২০০০’র দশকের গোড়া থেকে মহিলাদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার ক্রমশ কমছে। আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংঘের ২০১৪’র এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে — ১৯৯৯-২০০০-এ মহিলাদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার ছিল ৩৪.১ শতাংশ; সেটাই কমে ২৭.২ শতাংশ হয়েছে ২০১১-১২-তে। এই দুর্ভাগ্যজনক প্রবণতা কিন্তু ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলো, যেমন বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে দেখা যাচ্ছে না, বরং সেখানে এই হার ক্রমবর্ধমান। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ভারতীয় মহিলারা ২০০৪-০৫ থেকে ২০১৭-১৮’র মধ্যে শিক্ষার স্তরে লিঙ্গবৈষম্য অনেকটাই কমিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন; কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল, এই একই সময়ে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হারের ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য ক্রমশ বেড়েছে!

ঘরের চার দেওয়ালের গণ্ডি পেরিয়ে, উপার্জন করে স্বনির্ভর হওয়া — নৈব নৈব চ

উপরি-উল্লিখিত প্রবণতাগুলো থেকে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণবিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠছে; এমন গুরুত্বপূর্ণ যা বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম মহিলারা লড়েছেন সম্মিলিত এবং একক লড়াই, শিক্ষার আঙিনায় পৌঁছাতে যার দুয়ার তাদের জন্য রুদ্ধ ছিল পিতৃতান্ত্রিক সমাজ-রীতির দোহাই দিয়ে। বহু বছরের সংগ্রামের পর যখন ভারতীয় নারীরা চূড়ান্ত ভাবে শিক্ষাসহ কিছু সামাজিক পুঁজি অর্জনে লিঙ্গবৈষম্যকে দূরে ঠেলতে সক্ষম হলেন, তখনও রইলেন সেই শৃঙ্খলিতই!

শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হারে প্রায় একই রকম লিঙ্গবৈষম্য রয়েছে সমস্ত জাতি ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে। আর এটা দুরপনেয় যদিও মহিলারা যথেষ্ট পরিমাণে সামাজিক পুঁজি অর্জন করতে পেরেছেন। কাজের লিঙ্গভিত্তিক বিভাজনের পিতৃতান্ত্রিক প্রথা এত শক্তিশালী, নারীকে ঘরে বেঁধে রাখার সামাজিক আচার অনুষ্ঠান এত কঠোর যে, যেসব মহিলা কিছু বস্তুগত অর্জনে সক্ষম হয়েছেন তাদেরও সেই বাধা ভেঙে বেরিয়ে আসতে সংগ্রাম করতে হচ্ছে।

শিক্ষার সমস্ত স্তরে ও শাখায় মহিলাদের আরও বেশি অংশগ্রহণের জন্য যেমন লড়াই চালিয়ে যেতে হবে, তেমনই সমাজ পরিবর্তনের চালিকাশক্তিগুলিকে এই সত্য মানতে হবে যে সংগ্রামকে কর্মস্থল পর্যন্ত বিস্তৃত করতে হবে।

গণতান্ত্রিক শক্তিগুলিকে সেই নিশ্চয়তা দিতে হবে যে, মর্যাদাপূর্ণ কাজ পাওয়ার সমস্ত যোগ্যতা ও দক্ষতার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও মেয়েদের কাজে যেতে বাধা দিয়ে ঘরে আটকে রাখা চলবে না।

আমাদের, সরকারকে এই সত্যটা স্বীকার করতে এবং মহিলাদের ঘরের চার দেওয়ালের বাধা ভেঙে কর্মীবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য প্রোৎসাহন দিতে বাধ্য করতে হবে। আগামী কালের ভারত কেবলমাত্র তখনই গড়ে উঠতে পারে যখন নারীকে গার্হস্থ্য গণ্ডির মধ্যে একলা বন্দি রাখার বহু যুগের জীর্ণ প্রাচীন প্রথা-আচার-অনুষ্ঠান-সংস্কারকে আমরা উপড়ে ফেলতে পারব!

- অনুবাদক, জয়ন্তী দাশগুপ্ত

খণ্ড-29
সংখ্যা-43