আফগানিস্তানে নারী শিক্ষায় তালিবানি নিষেধাজ্ঞা


শাসক যদি হয় তালিবান, তবে নারীর অধিকারের বিপর্যয় অবশ্যই হবে এক অবিসংবাদী বাস্তবতা। সংশোধিত বা যুক্তির বলে নিয়ন্ত্রিত তালিবান আর সোনার পাথরবাটি একই ব্যাপার। এর আগের ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত তালিবান জমানা নারী দমনকে যেমন তাদের মার্কামারা বৈশিষ্ট্য করে তুলেছিল, সেই স্বরূপকেই পুনরুজ্জীবিত করে তুলে নারীদের স্বাধীনতায়, তাদের অধিকারে, তাদের চলাফেরায় লাগাম পরাতে আবার তারা উঠেপড়ে লেগেছে। সম্প্রতি তালিবান সরকারের উচ্চশিক্ষা মন্ত্রক এক নির্দেশিকা জারি করে জানিয়েছে যে, আফগান নারীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা বন্ধ। অর্থাৎ, তালিবান সরকারের বোধ এই যে, উচ্চশিক্ষা নারীদের পক্ষে এক অনাবশ্যক বিষয়। গত ২০ ডিসেম্বর ২০২২ তালিবান সরকারের উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী নেদা মহম্মদ নাদিমের স্বাক্ষর করা এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হল, “পুনরায় বিজ্ঞপ্তি না দেওয়া পর্যন্ত নারীদের শিক্ষা মুলতুবি রাখার উল্লিখিত নির্দেশটি রূপায়ণের জন্য সকলকে জানানো হচ্ছে”। অথচ, তিনমাস আগেই অসংখ্য মেয়ে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বসেছিল, যারমধ্যে ধরা পড়েছিল শিক্ষায় আরো এগিয়ে যাওয়ার সংকেত। আফগান মেয়েদের পড়াশোনায় এই আগ্রহ, সামাজিক স্তরে উত্তরণের স্বপ্নকে সফল করতে শিক্ষাকে ভিত্তি করার এই উদ্যমই বোধকরি তালিবানি শাসকদের বিচলিত করে থাকবে। আর তাই পোশাক বিধি না মেনে মেয়েদের শিক্ষায়তনে যাওয়ার যুক্তি দেখিয়ে জারি হল এই নিষেধাজ্ঞা, যদিও তা যে একটা ওজর মাত্র তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার নয়। তালিবানি জমানায় পছন্দের পোশাক পরার স্বাধীনতা মেয়েরা আগের তালিবানি জমানাতেও ভোগ করত না, আর তালিবান শাসকরা প্রশস্ত চিত্ত হয়ে তাদের দ্বিতীয় জমানাতেও মেয়েদের সে অধিকার দেয়নি। মেয়েদের কখনই পুরুষদের সমান হতে না দেওয়া, দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে রাখার দুরভিসন্ধি থেকেই তাদের উচ্চশিক্ষার ওপর এই তালিবানি কোপ।

একটু পিছন ফিরে তাকালে দেখা যাবে আফগান সমাজে মেয়েরা যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করত, কর্মক্ষেত্রের বিভিন্ন স্তরে তাদের প্রভূত সক্রিয়তা ছিল, সমাজের এগিয়ে চলায় তাদের অবদান কম ছিল না। তালিবানরা ১৯৯৬ সালে প্রথম দফায় ক্ষমতায় বসার আগে কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ৬০ শতাংশই ছিলেন মহিলা। সমগ্ৰ স্কুল শিক্ষকদের ৭০ শতাংশও মহিলা বলে দেখা গিয়েছিল, সরকারি চাকুরেদের এক বড় অংশ, ৫০ শতাংশও ছিলেন মহিলা, আর ডাক্তারদের মধ্যেও মহিলারা ছিলেন ৪০ শতাংশের। বিদ্যালয়ে ২০০০ সালে পড়তে যাওয়া মেয়েদের সংখ্যা যেখানে ছিল এক লক্ষর আশেপাশে, সেই সংখ্যাই দেড় বছর পূর্বে, তালিবান ২০২১’র আগস্টে দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় বসার আগে গিয়ে দাঁড়ায় ৩৫ লক্ষে। কিন্তু তালিবান ক্ষমতায় বসার পরই শিক্ষাকে আফগান নারীদের কাছে এক বাহুল্যের বিষয় করে তোলে। ২০২১’র সেপ্টেম্বরে স্কুল খুলে সেগুলোতে শুধু ছেলেদেরই যেতে দেওয়া হয়, মেয়েদের যাওয়া অনাবশ্যক বলে বিচার্য হয়। মেয়েদের জন্য ধার্য হয় প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা, তার ওপরের স্তরের শিক্ষা এবং তারসাথে কর্মক্ষেত্রকেও মেয়েদের অগ্রাধিকারে স্থান দেওয়া হয় না। শিক্ষার যেটুকু ব্যবস্থা মেয়েদের জন্য ছিল, তাতে বরাদ্দ হতো আলাদা শ্রেণীকক্ষ এবং নারী শিক্ষিকা ও বৃদ্ধ শিক্ষকরাই তাদের পড়াতে পারতেন।

শিক্ষাক্ষেত্রে এই নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী ও অসরকারি সংস্থাতে নারীদের কাজ করাও নিষিদ্ধ হয়েছে। আফগানিস্তানে অনেক এনজিও মূলত নারী কর্মীদের ওপর ভর করে তাদের কাজ চালাত। কিন্তু নারী কর্মীরা কাজে যেতে না পারায় এনজিও’গুলো যে পরিষেবা দিত তা প্রদান করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। সম্প্রতি তিনটে বিদেশী এনজিও তাদের কাজ বন্ধ করে দিয়ে এক যৌথ বিবৃতিতে জানিয়েছে, “আমরা আমাদের মহিলা কর্মী ছাড়া শিশু, নারী ও পুরুষদের কাছে সক্রিয়ভাবে পৌঁছতে পারছি না, আফগানিস্তানে যাদের সাহায্য অতীব প্রয়োজন”। প্রসঙ্গত, তালিবান জমানায় অর্থনৈতিক সংকট তীব্র আকার নিয়েছে, কর্মসংস্থান বলতে তেমন কিছু নেই, আর এরই সাথে রমরমিয়ে চলে মাদক ব্যবসা। আফগান জনগণের এক বড় অংশকেই তাই নির্ভর করতে হয় বিভিন্ন বিদেশী সংস্থার মানবিক সহায়তার ওপর। নারীদের কাজে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে এনজিও’দের কাজে তালা ঝুলিয়ে দেওয়াটা যে আদতে আফগান জনগণের ক্ষতিই ডেকে আনছে তা নিয়ে তালিবান শাসকদের বিন্দুমাত্র ব্যাকুলতা নেই।

শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্র থেকে নির্বাসনের সাথে আরও অনেক বিধিনিষেধের নিগড়ে আফগান নারীদের বাঁধা হয়েছে। তারা একা বাইরে বেরোতে পারবে না, বাইরে যেতে গেলে পুরুষ অভিভাবক বা সঙ্গীর সাথে যেতে হবে। বাইরে বেরোতে হলে আপাদমস্তক ঢাকা দিয়ে বেরোতে হবে। উঁচু হিলের জুতো পরা যাবে না, জানলায় পরদা লাগাতে হবে যাতে মেয়েদের মুখ না দেখা যায়। প্রকাশ্যে জোরে কথা বলা বা মতামত প্রকাশ করা মেয়েদের পক্ষে বাঞ্ছনীয় নয়। খবরের কাগজ, বই, পত্রিকায় এবং এমনকি ঘরেও মেয়েদের ছবি প্রকাশ করা বা টাঙানো চলবে না। রেডিও, টিভি, প্রকাশ্য সমাবেশে তাদের দেখতে পাওয়া বা তাদের কণ্ঠ অন্যের কর্ণগোচর হওয়াটাও অনভিপ্রেত। সাইকেল, মোটর সাইকেল চাপাও তাদের জন্য নিষিদ্ধ। স্বাধীনতা ও অধিকার হীনতার আফগান নারীদের এই অস্তিত্ব আসলে ইসলামের রক্ষণশীল, সংস্কার বিমুখ তালিবানি ব্যাখ্যার অনুসারী।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বোঝাপড়ার পরিণতিতে তালিবান ২০২১’র আগস্টে দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় বসার সময় কিছুটা উদারবাদী হওয়ার, প্রশাসনে সংযম দেখানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। বলেছিল, নারী ও সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষিত হবে, মানবাধিকার মর্যাদা পাবে। কিন্তু সে সময় তালিবানদের প্রতিশ্রুতিতে আফগান জনগণের এক বড় অংশই ভরসা রাখতে পারেননি‌। আমাদের মনে পড়ে যায় আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার কী হিড়িকই না সেসময় পড়েছিল। বাসে-ট্রেনে গাদাগাদি করে যাওয়ার মতো বিমানের ডানা থেকে মানুষের ঝুলে পড়ার দৃশ্যও সারা দুনিয়াকে বিচলিত করেছিল, বিস্মৃত হওয়ার নয় সেই ঝুলন্ত অবস্থা থেকে পড়ে গিয়ে অন্তত একজন ডাক্তার ও একজন ফুটবলারের মৃত্যুর কথা। নারীদের শিক্ষায় সংকোচনের থাবা, কর্মক্ষেত্রকে তাদের জন্য নিষিদ্ধ করে তোলাটা সুস্পষ্টরূপে দেখিয়ে দিল যে, তালিবানদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি সম্পূর্ণরূপেই ছিল অন্তঃসারশূন্য।

নারীর শিক্ষার ওপর তালিবান শাসকের চাপানো এই বঞ্চনাকে, নারীর স্বাধিকারের সার্বিক দমনকে আফগান নারীরা কিন্তু মুখ বুজে মেনে নেননি। রাজধানী কাবুলে রাস্তায় নেমে মেয়েরা প্রতিবাদ জানিয়েছেন, উচ্চশিক্ষার অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। বহু মহিলা ২২ ডিসেম্বর ২০২২ প্রতিবাদ জানাতে জানাতে কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাওয়ার সময় পুলিশ তাদের ওপর আক্রমণ চালায় ও গ্রেপ্তার করে। শিক্ষা থেকে নারীদের নির্বাসিত করার বিরুদ্ধে পুরুষ ছাত্ররাও প্রতিবাদে নামে এবং শিক্ষার অধিকার, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অধিকার নারীদের ফিরিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত তারা পরীক্ষায় বসতে অস্বীকার করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত নারীদের প্রতি সংহতি জানাতে কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক লাইভ টিভি অনুষ্ঠানে তাঁর সমস্ত ডিপ্লোমা একে একে ছিঁড়ে ফেলে বলেন, “আজ থেকে এই ডিপ্লোমাগুলোর কোনো প্রয়োজন আমার নেই, কেননা, এই দেশে শিক্ষার আর কোনো স্থান নেই। আমার মা-বোনেরা পড়ার সুযোগ না পেলে আমার কাছে এই শিক্ষা গ্রহণযোগ্য নয়।” আপাত আধুনিক বহিরাবরণের আড়ালে তালিবানদের মনোজগতে বয়ে চলা চরম প্রতিক্রিয়াশীল ভাবধারার উন্মোচন ঘটিয়ে জনৈক অধ্যাপিকা বলেছেন, “স্মার্টফোন, সমাজ মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট ও নামিদামি গাড়ি-সহ ওদের একটা পাল্টে যাওয়া গোষ্ঠী বলে মনে হতে পারে, তবে, ওরা কিন্তু সেই একই তালিবান যারা আমার শিক্ষায় বঞ্চনা ঘটিয়েছিল আর এখন আমার ছাত্রীদের ভবিষ্যত ধ্বংস করছে।” এইভাবে তালিবান-বিরোধী বিভিন্ন বিক্ষিপ্ত প্রতিবাদ আফগানিস্তানে দেখা যাচ্ছে। এই সমস্ত প্রতিবাদ ইরানে নীতি পুলিশের হাতে মাহসা আমিনির হত্যা থেকে জন্ম নেওয়া স্বৈরাচারী শাসক বিরোধী দীর্ঘস্থায়ী গণআন্দোলনের মতো প্রতিরোধে পরিণত হয়নি ঠিকই, তবে এই প্রতিবাদ-বিক্ষোভগুলোর মধ্যে অবশ্যই রয়েছে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের সংকেত। ইসলামের নাম নিয়ে যে আতঙ্কবাদী ও পৈশাচিক শক্তিগুলো এখন আফগানিস্তানের ক্ষমতায়, বন্দুক ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় যারা কথা বলতে পারে না, তাদের বিরুদ্ধে সর্বস্ব পণ করে আফগান নারী-পুরুষদের পথে নামা অবশ্যই আশা জাগায়। সারা দুনিয়াতেই তালিবানি চিন্তাধারার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-সমালোচনা জারি আছে, আর আমরাও এই মুহূর্তে আফগান নারীদের আন্দোলনের পাশে দাঁড়াচ্ছি, পূর্ণ সংহতি জ্ঞাপন করছি।

– জয়দীপ মিত্র

খণ্ড-30
সংখ্যা-1