সম্পাদকীয়
মোদী + আদানি = জাতীয়তাবাদ !
modi-adani

বেশ ক’দিন ধরে আদানি’র সাম্রাজ্য নিয়ে বড় ধরনের বিতর্ক দানা বেঁধে উঠল। কোভিড অতিমারীর সময়ে গোটা দেশ, বিশ্ব যখন বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত, তখন যে ক’টি অতিবৃহৎ সংস্থা দুনিয়া জুড়ে নিজেদের সম্পদ উল্কাগতিতে বাড়িয়েছিল, তাদের অন্যতম হল আদানি এন্টারপ্রাইজ। বিশ্বের এই দ্বিতীয় বৃহত্তম ধনকুবের গৌতম আদানি’র বিরুদ্ধে শেয়ার দরে কারচুপি, আর্থিক প্রতারণার অভিযোগ তুলেছে আমেরিকার লগ্নি সংক্রান্ত গবেষণা সংস্থা হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ।

মোদীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতম বৃত্তের এই শিল্পপতি কেন্দ্রীয় সরকারের বদান্যতায় পেয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক ও বিমা প্রতিষ্ঠানগুলির অঢেল আর্থিক সাহায্য। ৩১ মার্চ ২০২২’র হিসাব দেখাচ্ছে, আদানির সমগ্র ঋণের বহর ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ২.২ লক্ষ কোটি টাকা! এদিকে, এই সংস্থার মোট সম্পদের মূল্য অপেক্ষা ঋণ অনেক অনেক বেশি। এক বিরাট বুদবুদের উপর যেন টিকে রয়েছে আদানি’র আর্থিক সাম্রাজ্য, হঠাৎ ফেটে গেলে তা মারাত্মক আর্থিক বিপর্যয় ডেকে আনবে — ২০০৮’র সাব প্রাইম সংকট তারই ইঙ্গিতবাহী।

রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা সংস্থা এলআইসি গত কয়েক বছরের মধ্যে আদানি’র বিভিন্ন সংস্থায় ৭৪,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে — যার ফলে এলআইসি এখন এই সংস্থায় দ্বিতীয় বৃহত্তম শেয়ার হোল্ডার! আদানি পোর্ট ও এসইজেড, আদানি ট্রান্সমিশন, আদানি গ্রীন এনার্জি ও আদানি টোটাল গ্যাস লিঃ — এই সংস্থাগুলোতে এলআইসি’র রয়েছে যথাক্রমে ৯ শতাংশ, ৩.৭ শতাংশ, ১.৩ শতাংশ এবং ৬ শতাংশ শেয়ার! আর, দেশীয় ব্যাঙ্কগুলো আদানি’র সংস্থায় বিনিয়োগ করেছে ৮০,০০০ কোটি টাকা — যারমধ্যে বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলোর রয়েছে মাত্র ১.৪ শতাংশ ঋণ। আর, ব্যাঙ্কগুলোর কাছে আদানি’র সংস্থাগুলোর সম্মিলিত ঋণের পরিমাণ হল ৩৮ শতাংশ!

হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পরই হুড়মুড়িয়ে আদানি এন্টারপ্রাইজের শেয়ার মূল্যে পতন শুরু হয়। কিন্তু পরিহাস এটাই, ঠিক এই সময়েই এলআইসি ওই সংস্থায় আরো বেশি মূলধনের জোগান অব্যাহত রাখল, যা নিয়ে দেশজুড়ে নতুন আরেকটি বিতর্ক শুরু হয়ে গেল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৫৭ সালে সংসদে ফিরোজ গান্ধী (ইন্দিরা গান্ধীর স্বামী) তদানিন্তন নেহেরু সরকারের অর্থমন্ত্রী কৃষ্ণমাচারির বিরুদ্ধে মারাত্মক আর্থিক কেলেঙ্কারির এক অভিযোগ নিয়ে আসেন। ফিরোজ সংসদে নানা নথি পেশ করে জানান, হরিদাস মুন্দ্রা’র (যিনি ছিলেন কংগ্রেসের ঘনিষ্ঠ কলকাতার এক শিল্পপতি, স্টক মার্কেটের খেলোয়াড়) ছ’ছটা ডুবন্ত সংস্থায় রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা সংস্থা এলআইসি ১,২৬,৮৬,১০০ টাকার শেয়ার কিনেছে সেগুলোকে বাঁচাতে। কার্যত, এলআইসি’র বিনিয়োগ কমিটির পরামর্শ না নিয়েই কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রক চাপ দিয়ে বাধ্যতামূলকভাবেই এই আর্থিক লেনদেন করে। এই অভিযোগের মুখে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হয়। এটা ছিল স্বাধীন ভারতের বৃহত্তম আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা। আজ প্রশ্ন উঠছে, আদানির শেয়ার হুড়মুড় করে নিচে নামতে থাকলেও এলআইসি কার নির্দেশে নতুন করে আবার ওই সংস্থায় ৩০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ করল? ২৪ জানুয়ারি থেকে ৩১ জানুয়ারি — এই একসপ্তাহের মধ্যে আদানি সংস্থাগুলির লগ্নিকারীরা মোট ৫.৫৬ লক্ষ কোটি টাকার শেয়ার সম্পদ হারালেন। এলআইসি’র শেয়ার মূল্য কতটা নামল নিচে? শেয়ার বাজারের এক হিসাব বলছে, এলআইসি খুইয়েছে ৫৫,৭০০ কোটি টাকা মূল্যের শেয়ার সম্পদ।

হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টের পাল্টা আদানি গোষ্ঠী ৪১৩ পাতার এক বিবৃতি দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগগুলো খন্ডন করতে মাঠে নেমেছে। তা পাওয়ার সাথে সাথেই হিন্ডেনবার্গ জবাব দিয়ে বলে, যে ৮৮টি প্রশ্ন তারা তোলেন, তারমধ্যে ৬২টিরই উত্তর এড়িয়ে গেছে আদানিরা। সবচেয়ে আপত্তিকর বিষয় হল, আদানিরা এতো বড় এক আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগের সুস্পষ্ট ও জুতসই প্রত্যুত্তর না দিয়ে এটাকে “ভারতের এবং দেশের স্বাধীনতা, অখন্ডতার উপরে আঘাত, দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর মান, ভারতের বৃদ্ধির উপর আক্রমণ” হিসাবে তা মোকাবিলার চেষ্টা করেছে। শয়তানেরাই দেশপ্রেমকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে — এই প্রবাদ বাক্য আরেকবার প্রতিষ্ঠিত হল!

ফ্যাসিবাদের ভারতীয় সংস্করণের প্রধান চরিত্র লক্ষণ হল ‘জাতীয়তাবাদ’। যে জাতীয়তাবাদ ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ববাদের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত। আর, মোদী-রাষ্ট্র-দেশ-দেশপ্রেম-সার্বভৌমত্ব আজ সব একই বন্ধনীতে একাকার ও সমার্থক হয়ে গেছে। এখন মোদীর সাথে জুড়ে গেল আদানি। চিত্রপটে অক্ষরেখাটি আজ পরিষ্কার — মোদী-আদানি-সরকার-রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর আঁতাত — যা নাকি দেশের আর্থিক বিকাশ ও বৃদ্ধির পথকে প্রশস্ত করছে! তাই, এই হাইব্রিড ‘জাতীয়তাবাদ’কে পুজো করতে হবে। তার বিরুদ্ধে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। তার গায়ে লাগানো যাবে না এক ফোঁটাও চুনকালি! আর এইভাবেই ক্রোনি পুঁজিবাদ মোদী ফ্যাসিবাদের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে যে আর্থিক রাজনৈতিক মতাদর্শগত শাসনতন্ত্র তৈরি করেছে তা ভারতবাসীর কাছে প্রধানতম রাজনৈতিক শত্রু হিসাবে আজ সামনে এসেছে। যাকে উৎখাত না করলে দেশ ও জাতির মুক্তি নেই।

খণ্ড-30
সংখ্যা-3