খবরা-খবর
কলকাতায় আদিবাসী সমাবেশ : জমি ও কাজের অধিকারের দাবিতে
tribal-rally-in-calcutta

সমাজের প্রান্তিক ও অবদমিত আদিবাসী মানুষেরা কলকাতার বুকে সংগঠিত করল এক বিক্ষোভ সমাবেশ। তাঁদের নিজস্ব সংগঠন সারা বাংলা আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চের আহ্বানে গত ৩১ জানুয়ারি ২০২৩ ধর্মতলায় অনুষ্ঠিত এই সমাবেশে রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত আদিবাসীরা অংশগ্রহণ করেন। কর্মসূচিতে মহিলাদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। তাঁদের কয়েকজনের হাতে ছিল প্রতিকী তীর-ধনুক। ধামসার তালে, স্লোগানে এবং গানের মধ্য দিয়ে সমাবেশ এবং শিয়ালদা ও হাওড়া স্টেশন থেকে আগত মিছিল হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত! সমাবেশ থেকে প্রধানত জমি ও কাজের অধিকারের দাবিতে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়। নিপীড়িত শ্রেণী ও পরিচিতি সত্তা মিলেমিশে তুলে ধরে এক সংগ্রামী বার্তা। গণসংগীত পরিবেশন করেন নীতীশ রায়, বাবুনি মজুমদার ও আদিবাসী মহিলারা।

আজ যখন সারা দেশে জল-জঙ্গল-জমি সহ সমগ্র প্রাকৃতিক সম্পদ কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে তখন সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন আদিবাসী সমাজ। এই রাজ্যে বনাঞ্চল থেকে গ্রাম শহর সর্বত্রই জমি মাফিয়া-সিন্ডিকেট চক্রের দাপট, সরকার প্রশাসনের মদতে আদিবাসীদের জমিগ্রাস করার প্রক্রিয়া বেড়ে চলেছে। যৎসামান্য কয়েকটি গালভরা সরকারি প্রকল্পকে সামনে রেখে আদিবাসী উন্নয়নের কথা ব্যাপকভাবে প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু ‘চুইয়ে পড়া’ ঐ ধরনের দু’চার ফোঁটা জল দিয়ে বাস্তবে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে আদিবাসীদের জীবন জীবিকার ন্যায্য অধিকারগুলিকে। এই প্রেক্ষাপটে সীমাহীন বঞ্চনার বিরুদ্ধে আদিবাসীদের এক জাগরণ এ’রাজ্যের বুকেও লক্ষ করা যাচ্ছে। এরসাথে সাযুজ্য রেখে এই সমাবেশ কর্মসূচি খুবই গুরুত্বপুর্ণ হয়ে ওঠে।

দক্ষিণবঙ্গের বাঁকুড়া, দুই মেদিনীপুর, পুরুলিয়া প্রভৃতি জেলায় বনাঞ্চলে বসবাসকারী বহু সংখ্যক আদিবাসীরা আজও তাঁদের দখলিকৃত বনাঞ্চলের জমির পাট্টা পায়নি। উত্তরবঙ্গেও দেখা যাবে একই চিত্র। সারা রাজ্যেই বহু সংখ্যক আদিবাসীরা কাগজে কলমে পাট্টা পেলেও খাস জমির দখল পায়নি। এছাড়া পাট্টায় জমির চরিত্র বনাঞ্চল থাকার কারণে তারা সরকারি প্রকল্পের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। চাষাবাদ করেও আজ তাঁরা কৃষকের মর্যাদা পাচ্ছেন না। বীরভূম, বর্ধমান, হুগলি, নদীয়া প্রভৃতি জেলায় আদিবাসীদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। বিশেষ করে বর্গা রেকর্ড থাকা সত্ত্বেও আদিবাসীদের জমি থেকে উচ্ছেদ করার নানাবিধ চক্রান্ত চলছে। দেউচা-পাঁচামীতে আদানি কোম্পানিকে ডেকে এনে আদিবাসীদের ভিটে-মাটি কেড়ে নেওয়ার অপচেষ্টা চলছে। বিভিন্ন জেলায় আদিবাসীদের জমি অ-আদিবাসীদের নামে রেকর্ডকরে দেওয়া হচ্ছে। সমাবেশে আগত আদিবাসীরা এই ধরনের ক্ষোভ বিক্ষোভের কথা তুলে ধরেন।

১০০ দিনের কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে আদিবাসীরা কাজের সন্ধানে দূরদূরান্তে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। একবছর হয়ে গেল তারা কাজ করেও বকেয়া মজুরি পাননি। কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের কাজিয়ার ফলে বঞ্চিত হচ্ছেন আদিবাসী কৃষি মজুররা।

এছাড়া আদিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতির বিভিন্ন দাবিগুলো উঠে আসে। যথা আদিবাসীদের চিরায়ত নাচের দলগুলির প্রাপ্য শিল্পী ভাতার দাবি। এছাড়া অলচিকি হরফে প্রয়োজনীয় পুস্তক না থাকা, আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত শূন্যপদে আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ থাকা প্রভৃতি কারণে আদিবাসীদের শিক্ষা বিকাশের সরকারি ঘোষণা সম্পূর্ণ ফাঁকা প্রতিশ্রুতি বলে প্রতিপন্ন হচ্ছে। আদিবাসী হোস্টেলগুলো সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এসবের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখেন — মেদিনীপুর বস্তি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির নেতা তপন মুখার্জী, আদিবাসী সংগঠনের রাজ্য নেত্রী ময়না কিসকু, নদীয়ার আদিবাসী নেতা সন্যাসী ওঁরাও, বাঁকুড়ার মেটালা অঞ্চলের উপপ্রধান কবিতা মান্ডি, উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার আদিবাসী নেতা রামু সরেন, আয়ারলার বাবলু ব্যানার্জি, আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চের সভাপতি পাগান মুর্মু, সম্পাদক সুধীর মুর্মু, আয়ারলার রাজ্য সম্পাদক সজল অধিকারী, এআইকেএম’এর কার্তিক পাল।

সমগ্র সভা পরিচালনা করেন বাঁকুড়ার আদিবাসী নেতা রামনিবাস বাস্কে।

সমাবেশের প্রাক্কালে রাজ্য আদিবাসী উন্নয়ন দপ্তরে দশ দফা দাবি সম্মলিত স্মারকলিপি জমা দেওয়া হয়। সুধীর মুর্মুর নেতৃত্বে ৫ জনের এক প্রতিনিধি দলের সাথে দপ্তরের সচিব সাক্ষাৎ করে দাবিগুলি শোনেন এবং সেগুলি বিবেচনার আশ্বাস দেন।

খণ্ড-30
সংখ্যা-3