বেসরকারি শিক্ষার আবাহনে রাষ্ট্রীয় শিক্ষার বিসর্জন
bandonment-of-state-education

গভীর সংকটের বার্তা বহন করে নিয়ে এল এবারের মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদ। ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরুর দিনই পর্ষদ সভাপতি রামানুজ গঙ্গোপাধ্যায় একটি প্রেস মিটিং’এ জানালেন এ’বছর মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে চার লক্ষ! প্রতিবছরই মাধ্যমিকের তুলনায় উচ্চমাধ্যমিকে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কম থাকে। এবার হল উলটপুরাণ। মাধ্যমিকে কম, পরীক্ষার্থী বেশি উচ্চমাধ্যমিকে। প্রথিতযশা, বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদরা বারবার সতর্ক করে বলেছিলেন যে, অতিমারী-জনিত সমস্যাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি হবে শিক্ষার সংকট। এক বছরের মধ্যে চার লক্ষ পরীক্ষার্থী খুইয়ে পশ্চিমবঙ্গ সেই ঘোর তিমিরকালের সঙ্কেত দিল। অতিমারীর সময়ে অনলাইন শিক্ষা যে অধিকাংশ শিশুর কাছে পৌঁছায়নি তার ভূরিভূরি প্রমাণ মেলা সত্ত্বেও কোনও বিকল্প ব্যবস্থা হয়নি। শিশুদের লাগাতার স্কুল-বিচ্ছিন্নতার পরিণাম নিয়ে শিক্ষক সংগঠনগুলোর পাশাপাশি সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু ক্ষমতার কেন্দ্রে চারপাশে সেই সুপরামর্শ ঠোক্কর খেতে খেতে মাঠিতেই আছড়ে পড়ে। অবশেষে, শিক্ষামন্ত্রীর আশ্বাসবাণী রাজ্যবাসী শুনলেন — এ’বছর মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধান করবেন বিশেষজ্ঞরা।

শিক্ষা বঞ্চনার একটা ধারাবাহিকতা রয়েছে আমাদের এই বঙ্গে। শিক্ষার অধিকার আইন (২০০৯) — এর দৌড় যেহেতু অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত, তাই নবম-দশমে শিক্ষা বঞ্চনার চেহারাটা প্রকট হলেও তা নিয়ে নীরব রাজ্য সরকার। আজ রাজ্যের সাড়ে পনেরো হাজার শিশু শিক্ষাকেন্দ্র (প্রি-প্রাইমারী থেকে চতুর্থশ্রেণি) আর ১,৯০০ মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্র (পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি) শেষ প্রহর গুনছে। এগুলোর দায় কে নেবে, তা নিয়ে চলছে ঠেলাঠেলি। ২০২০ সালে পঞ্চায়েত দপ্তর সেগুলোকে পাঠিয়েছিল শিক্ষা দপ্তরে — যাতে বঞ্চিত এই স্কুলগুলো ‘মানুষ’ হয়ে উঠতে পারে। দু’টো বছর চুপচাপ থেকে, হালে শিক্ষা দপ্তর সে ফাইল ফেরত পাঠিয়েছে। পঞ্চায়েতের অধীনে এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষাকেন্দ্র আজ যেন বেওয়ারিশ লাশ!

রাজ্যে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রটিও গভীর সমস্যায় জর্জরিত। রাজ্যে ভাষাশিক্ষা প্রসারের অবিসংবাদী অবদান রাখার জন্য রাজ্যের নামী দু’দুটো বিশ্ববিদ্যালয় মহীয়সী মুখ্যমন্ত্রীকে ডিলিট’এর সম্মানে ভূষিত করল (এর পেছনে কতটা সংকীর্ণ প্রাপ্তিযোগের স্বার্থ আর কতটা শিক্ষা প্রসারের স্বার্থ, তা নিয়ে বিতর্ক চলুক)। কিন্তু প্রকৃত বাস্তব — কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় সহ রাজ্যের ন’টি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী উপাচার্যনেই। অস্থায়ী উপাচার্যের মেয়াদ ফুরিয়েছে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় ও আলিপুরদুয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী উপাচার্য শুরু থেকেই কার্যভার হাতে নিয়েছিলেন দার্জিলিং হিল বিশ্ববিদ্যালয়ের। সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি এখন অভিভাবকহীন। ঝাড়গ্রামে সাধু রামচাঁদ মুর্মু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মেয়াদ সবে শেষ হল। স্থায়ী উপাচার্য না থাকায় অতল সমস্যায় পড়েছে এ’রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় বহু ঢাক ঢোল পিটিয়ে গড়ে তোলা অন্য দু’তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়।

গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে বেসরকারিকরণ ক্ষেত্রের হাতে তুলে দিতে প্রকট ভাবে চলছে সরকারী আয়োজন — সর্বময়ীর অনুপ্রেরণায়। জরাজীর্ণ স্কুল বিল্ডিং, অব্যবহারযোগ্য শৌচালয়, বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব, ভাঙাচোরা আসবাব, শিক্ষা অধিকার আইন মোতাবেক যে দূরত্বের মধ্যে শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তোলার কথা তা অমান্য করা, ছাত্র-শিক্ষকের বৈধ অনুপাতকে দলন করা, শিক্ষার পঠন পাঠনকে চূড়ান্ত অবহেলার দিকে ঠেলে দেওয়া — আর এ সমস্ত কিছুর যোগফল হল — সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার বিসর্জন — বেসরকারি শিক্ষা ক্ষেত্রের আবাহন।

এই সংগঠিত সরকারি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রাজ্যবাসীকে রুখে দাঁড়াতেই হবে।

খণ্ড-30
সংখ্যা-4