পেনশন-সংস্কার বিরোধী আন্দোলনে উত্তাল ফ্রান্স
movement-in-france

গত ২০ মার্চ ফ্রান্সের সংসদের নিম্নকক্ষে রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল মাকোঁর সরকারের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাব মাত্র নয় ভোটের জন্য পরাজিত হল। বহু বিতর্কিত পেনশন-সংস্কারের বিরুদ্ধে এই অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়েছিল। ২৭৮ সদস্য অনাস্থার পক্ষে ভোট দেন, প্রয়োজন ছিল ২৮৭ ভোট। এই প্রস্তাব যদি পাস হতো তাহলে প্রধানমন্ত্রী এলিজাবেথ বর্নের সরকারকে পদত্যাগ করতে হতো, যদিও মাকোঁ রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকতেন। অল্পের জন্য তাঁর সরকার বেঁচে গেলেও মাকোঁ অদম্য। তিনি বলে দিয়েছেন সরকারে কোনও অদলবদল হবে না, নতুন করে নির্বাচন হবে না, পেনশন-সংস্কারের ওপর কোনও গণভোটও হবে না। এর অর্থ এই সংস্কার আইন হয়ে গেল, যদি না মাকোঁ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এটা রদ করেন। আন্দোলনকারীরা কিন্তু এই সংস্কারগুলি রদের দাবিতে অনড় যা এই সরকারের অপসারণ ছাড়া এখন কোনওভাবেই সম্ভব নয়। অতএব ভবিষ্যৎ দিনগুলি ফ্রান্সে যে অগ্নিগর্ভ হবে তা বলাই বাহুল্য।

এতো বিতর্কিত পেনশন-সংস্কার আদপে কী? এর ফলে ২০৩০ এর মধ্যে অবসরের বয়স ৬২ থেকে ৬৪ করা হবে। এই লক্ষ্যে প্রতি বছর অবসরের বয়স তিন মাস করে বাড়ানো হবে। এছাড়া পুরো পেনশন পেতে হলে ৪৩ বছর চাকরি করতে হবে। একই সঙ্গে ৬৭ বছর হচ্ছে চাকরি বা কাজের সর্বোচ্চ বয়স। সরকারের যুক্তি গড় আয়ু বৃদ্ধির ফলে দেশে বরিষ্ঠ নাগরিকের সংখ্যা বাড়ছে (ফ্রান্সে গড় আয়ু ৮২.১৮, ভারতে ৭০.১৫) এবং সেই কারণে পেনশন বিল ঊর্ধ্বমুখি। তাদের আরও দাবি পেনশন তহবিল প্রায় দেউলিয়া এবং সংস্কার নাহলে নাকি পেনশন কাঠামো ভেঙে পড়বে।

আন্দোলনকারীরা বলছেন পেনশন তহবিল দেউলিয়া এই কথাটা মিথ্যা। যে সংকটের কথা বলা হচ্ছে তাও অতিরঞ্জিত। দীর্ঘমেয়াদে যদিবা তহবিলে ঘাটতি দেখা যায় তা ধনীদের ওপর সম্পদ কর বৃদ্ধি করে পূরণ করা যেতে পারে কিংবা পেনশন ব্যবস্থাকে মুদ্রাস্ফীতি থেকে বিযুক্ত করা যেতে পারে। তাঁরা এও বলছেন যে চাকুরিজীবীদের মাইনে থেকে প্রতি মাসে কিছু অধিক অর্থকেটে নেওয়া যেতে পারে। একটি যৌথ বিবৃতিতে তাঁরা বলছেন যাঁদের আয়ু কম, যাঁরা ছোটোখাটো কাজ করেন, ক্যাজুয়াল বা বদলির কাজ, এবং যাঁরা অধিক মেহনতি কাজ করেন তাঁরা এই সংস্কার দ্বারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। অধিক পরিশ্রমের ফলে এঁরা বেশি অসুস্থ হন, চাকরির মোট সময়সীমাও কম হয়, যার ফলে এঁদের পেনশন কম হবে। নারী শ্রমিক কর্মচারীরাও এই সংস্কারের ফলে অধিক বঞ্চিত হবেন। বর্তমানে চালু ব্যবস্থাতেই তাঁরা পুরুষদের থেকে ৪০% পেনশন কম পান। এই প্রকট বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পাবে। মহিলাদের পরিবারের কারণে অনেক বেশি ছুটি নিতে হয়, অন্তঃসত্ত্বাকালীন ছুটি তো আছেই। একই কারণে তাঁরা পার্ট-টাইম কাজ করেন, এর ফলে তাঁদের বেশি বছর চাকরি করতে হয়।

যুব সংগঠনগুলি অবসরের বয়স কমিয়ে ৬০ করার দাবি জানিয়েছে। তাঁদের অন্য দাবিগুলি হল : ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি করা; অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের বাজারদর স্থিতিশীল করা; পরিবেশ রক্ষার্থে বিনিয়োগ করা; বিভিন্ন গণ-পরিষেবা যেমন যাতায়াত, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদিতে সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো। মাকোঁর আনা সংস্কারের তীব্র বিরোধিতা করে ‘ইয়ং কম্যুনিস্ট মুভমেন্ট অব ফ্রান্স’ বলছে, মাকোঁর উদ্দেশ্য পরিস্কার, তিনি যুবদের বেকার রাখতে চান, বয়স্কদের খাটিয়ে মারতে চান।

ফ্রান্সের একটি ওয়েবসাইট ইকোনমিস্ট ডট কম বলছে পেনশন সংস্কারকারীদের কাজ গ্রিক পুরাণের সিসিফাসের চেয়ে দুরূহ — যতই তাঁরা পাথরটা ওপরে ঠেলে তুলতে চায়, ততোই সেটা গড়িয়ে পড়ে। ১৯৯৫ সালে প্রবল বিক্ষোভের কারণে তৎকালীন জাক্ শিরাক সরকার পেনশন কাঠামোয় পরিবর্তন মুলতুবি রাখতে বাধ্য হয়। ২০১০-এ নিকোলাস সারকোজি অনেক চেষ্টা করে অবসরের বয়স ৬০ থেকে ৬২ করতে সক্ষম হন। ২০১৭ সালে প্রথমবার রাষ্ট্রপতি হবার পর মাকোঁ সংস্কার লাগু করার চেষ্টা করেন কিন্তু মানুষের প্রবল বিরোধীতা এবং কোভিড অতিমারীর কারণে তা মুলতুবি রাখতে বাধ্য হন। এই বছরের জানুয়ারি মাসে আবার সংস্কারের প্রস্তাব ঘোষণা হয়। কয়েক দিনের মধ্যে বিরোধী শ্রমিক সংগঠনগুলি, কম্যুনিস্ট পার্টি, গ্রিন পার্টি, অন্যান্য বাম দল, এমনকি দক্ষিণপন্থী দলগুলির একাংশ এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। পুরো দেশজুড়ে ধর্মঘট হয়, প্যারিসে কয়েক লাখ মানুষের বিপুল সমাবেশ হয়।

pension-reform-movement-in-france

আন্দোলনের তীব্রতা রাষ্ট্রপতিকে ভীত করে। গত বছরের নির্বাচনে তাঁর রেনেসাঁ পার্টি ন্যাশানাল এসেম্বলিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে। সংসদে ভোটাভুটিতে হেরে যাওয়ার ভয়ে মাকোঁ সংবিধানের বিতর্কিত ধারা ৪৯.৩ প্রয়োগ করেন। এই ধারা সরকারকে বিনা ভোটে আইন প্রণয়ন করার অধিকার দেয়। একই সাথে অভিনবভাবে সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনারও অধিকার দেয়। আমরা দেখেছি সরকার এই অনাস্থা প্রস্তাব কোনও রকমে উতরে যায়। কিন্তু তাদের যে ভোটাভুটি এড়িয়ে, বিতর্কিত ধারা প্রয়োগ করে আইন প্রণয়ন করতে হয়েছে, এটাই সরকারের দুর্বলতা প্রকাশ করে দিয়েছে। অনেকের মতামত সংসদকে এড়িয়ে সংবিধানের বিশেষ ধারা প্রয়োগের অর্থ আমরা গণতন্ত্র নয় রাজতন্ত্রে আছি!

গত বৃহস্পতিবার দেশজুড়ে আবার একদফা ধর্মঘট পালিত হয়। এছাড়া লাগাতার বিক্ষোভ সমাবেশ তো চলছেই। সাফাই কর্মচারীদের ধর্মঘটের কারণে সারা প্যারিস জুড়ে আবর্জনার স্তূপ দাউদাউ করে জ্বলছে। বহু স্কুল কলেজ বন্ধ। কিছু জায়গায় বিমানবন্দরে যাওয়ার রাস্তা অবরোধ করে দেওয়া হয়েছে, উড়ান বাতিল হচ্ছে। মানুষ বেপরোয়া। এমনিতে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা ইউরোপে জিনিসপত্রের দাম, বিশেষ করে জ্বালানির দাম, ঊর্ধ্বমুখি। মুদ্রাস্ফীতিও বাড়ছে। মনে করা হচ্ছে অন্তত ৭০% লোক এই পেনশন-রিফর্মের বিরুদ্ধে। অবস্থা এতটাই খারাপ যে ব্রিটেনের রাজা চার্লসের সৌজন্য সফর বাতিল করতে হয়েছে। মাকোঁ তবু অনমনীয়, তিনি ঘোষণা করেছেন যে এই বছরের শেষের দিকে নতুন পেনশন ব্যবস্থা চালু হয়ে যাবে।

বাগাড়ম্বর করলেও মাকোঁর অবস্থা কিন্তু স্বস্তিদায়ক নয়। মাত্র দু-বছর আগে ইয়েলো ভেস্ট আন্দোলনে ফ্রান্স উত্তাল হয়েছে। তখন মাকোঁর সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল, দ্বিতীয় বার নির্বাচিত হবার পরে সেটা কিন্তু আর নেই। যতদিন এগিয়েছে তিনি উদ্ধত, ধনীদের প্রেসিডেন্ট হিসাবে প্রতিপন্ন হয়েছেন। ইয়েলো ভেস্ট আন্দোলন তাঁর সরকারের জনবিরোধী চরিত্র আরও পরিস্কার করে দেয়। ঐ আন্দোলনে অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া ছাড়া, রাজনৈতিক সংস্কারের দাবিও ছিল যা মাকোঁ পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাই এই আন্দোলন পেনশন-রিফর্ম বিরোধী হলেও, মানুষের ক্ষোভের শিকড় আরও গভীরে। তাঁদের আন্দোলন মাকোঁর সামগ্রিক জমানার বিরুদ্ধে। বিভিন্ন অঞ্চলে স্বায়ত্তশাসনের দাবি উঠছে। মানুষ প্রশ্ন করছেন সমস্ত ক্ষমতা প্যারিসে কুক্ষিগত থাকবে কেন? এটা লক্ষণীয় যে ২০১৭-তে মাকোঁ যে বার প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসাবে নির্বাচিত হন তখন তাঁর প্রবল জনপ্রিয়তার কারণে অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলি প্রায় ধরাশায়ী হয়ে যায়। দেশের মানুষের মধ্যে তিনি নতুন আশার সঞ্চার করেন। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে তিনি কর্পোরেটদের কর লাঘব করেন, শিল্পপতিদের স্বার্থে শ্রম আইনে রদবদল করেন। ধীরে ধীরে তাঁর ভাবমূর্তি ম্লান হয় এবং তিনি ধনীদের প্রেসিডেন্ট হিসাবেই জনমানসে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যান। দ্বিতীয় বার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়লাভ করলেও সংসদে তাঁর দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখতে পারেনি। যেটা আশঙ্কার সেটা হচ্ছে মাকোঁর জনপ্রিয়তা হ্রাস মারিন লা পেন এবং তাঁর চরম দক্ষিণপন্থী দল ন্যাশানাল র‍্যালির উত্থানের কারণ না হয়ে দাঁড়ায়। আপাতত মারিন লা পেনের অবস্থান ধরি মাছ না ছুঁই পানি গোছের! তিনি বলেছেন মাকোঁ এই অবস্থা সৃষ্টি করেছেন, তাঁকেই এর সমাধান করতে হবে। আবার একই সঙ্গে বলছেন, ফ্রান্স জঙ্গি ইউনিয়ানবাজির শিকার। অন্যদিকে সিজিটি ও সিএফডিটির মতো বাম ও অতিবাম ট্রেড ইউনিয়নগুলি এই আন্দোলনের মূল শক্তি। এই আন্দোলন মাকোঁর শেষের শুরু হতে পারে এবং রাজনৈতিক দলগুলির নতুন শক্তি-বিন্যাসের সূচনা করতে পারে।

– সোমনাথ গুহ

খণ্ড-30
সংখ্যা-8