বিবিসি কার্যালয়ে আয়কর দপ্তরের তল্লাশি নরেন্দ্র মোদীর এক প্রতিহিংসামূলক পদক্ষেপ
income-tax-department-search-at-bbc

নরেন্দ্র মোদীকে নিয়ে বিবিসির তৈরি তথ্যচিত্র “ইণ্ডিয়া : দ্য মোদী কোয়েশ্চেন”এর ভারতে প্রদর্শন মোদী সরকার নিষিদ্ধ করেছিল। তথ্যচিত্রটির সমস্ত অনলাইন লিঙ্ককে তুলে নেওয়া, তথ্যচিত্র নিয়ে করা সমস্ত টুইটগুলোকে মুছে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। বিজেপি নেতৃবৃন্দ এবং মোদী সরকারের মন্ত্রীরা এই তথ্যচিত্র এবং তার সাথে আদানি গোষ্ঠীর ব্যবসায়িক কার্যকলাপ এবং কারচুপির মাধ্যমে গোষ্ঠীর সংস্থাগুলোর শেয়ারের দামকে উঁচুতে তোলা সম্পর্কে ‘হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ’-এর রিপোর্টকে মোদী-বিরোধী চক্রান্ত বলে অভিহিত করেছিলেন। কিন্তু এর মধ্যেই মোদী সরকারের বিবিসি-বিরোধী সক্রিয়তা থেমে থাকল না। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ আয়কর দপ্তরের অফিসাররা বিবিসির মুম্বই ও দিল্লী অফিসে হানা দিলেন। টানা তিনদিন (৬০ ঘণ্টারও বেশি) ধরে চলল সেই তল্লাশি। ঐ হানাদারিকে আয়কর দপ্তরের পক্ষে কর ফাঁকির তদন্তে শুধুই ‘সমীক্ষা’ বলে চালানো হলেও সেটা যে বিবিসিকে শিক্ষা দেওয়ারই অভিযান এবং তারসঙ্গে যে মোদী সম্পর্কে বিবিসির তৈরি তথ্যচিত্রের যোগ রয়েছে, তা নিয়ে কোনো পর্যবেক্ষকেরই বিন্দুমাত্র সন্দেহ রইল না। আয়কর দপ্তরের অফিসাররা বিবিসি অফিসে কর্মরত কর্মীদের ফোন ও ল্যাপটপের দখল নিয়ে নেন, কর্মীদের অফিসে আটকে রাখেন, তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন বলেও অভিযোগ। কাজের এই ধারাটা ‘সমীক্ষার’ সঙ্গে একেবারেই মেলে না।

এই হানাদারির পর খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে — মোদী সরকার কেন বিবিসি কার্যালয়ে আয়কর দপ্তরকে পাঠালো? ঐ পদক্ষেপের পিছনে কোন অভিসন্ধি সক্রিয় হয়েছিল? ভারতের প্রাধান্যকারী সংবাদ মাধ্যমকে ‘গোদি মিডিয়া’ বা সরকারের বশংবদ সংবাদ মাধ্যমে পরিণত করার পর মোদী সরকার সম্ভবত মনে করছে যে, বিদেশী সংবাদ মাধ্যমগুলোও তাদের অনুগত হবে, তাদের পছন্দের তথ্য ও সংবাদ পরিবেশনের মধ্যেই নিজেদের নিয়ন্ত্রিত রাখবে। কিন্তু দুনিয়া বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র ও নেতার বশবর্তী হয় না, এবং মোদী সরকার ও আরএসএস’এর ক্ষেত্রেও তা হওয়ার নয়। বিবিসি দপ্তরে আয়কর দপ্তরের অভিযানের পর বিশ্বের প্রথম সারির সংবাদ মাধ্যমগুলি ঐ পদক্ষেপের বিরোধিতায় তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। ঐ প্রতিক্রিয়ার কয়েকটির দিকে তাকানো যাক।

বিবিসি’র মুম্বই ও দিল্লী কার্যালয়ে আয়কর দপ্তরের তল্লাশি সম্পর্কে দ্য নিউ ইয়র্কটাইমস তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, “মোদীর অধীনস্থ ভারতীয় কর্তৃপক্ষসমূহ প্রায়ই স্বাধীন সংবাদ মাধ্যম, মানবাধিকার গোষ্ঠী ও চিন্তাবিদদের বিরুদ্ধে এই ধরনের তল্লাশি চালিয়েছে, যেটাকে আন্দোলনের কর্মীরা বলে থাকেন অর্থ সংস্থানের উৎসগুলোকে নিশানা বানিয়ে হয়রানি ঘটিয়ে সমালোচনামূলক কণ্ঠগুলোকে স্তব্ধ করার প্রচেষ্টা।” দ্য টাইমস পত্রিকার প্রতিক্রিয়া হয়েছে এই রকম — “করপোরেশনটির উপর হামলার মাধ্যমে নরেন্দ্র মোদীর ভারত গণতান্ত্রিক রীতি থেকে আরও বিচ্যুত হয়েছে।” আর, দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা আয়কর দপ্তরের তল্লাশিকে সরকারের আক্রোশের প্রকাশ বলতেও দ্বিধা করেনি — “এই সপ্তাহে দিল্লী ও মুম্বই অফিসে একাধিক দিন ধরে তল্লাশি দেখা গেল করপোরেশনটির বিরুদ্ধে সরকারের হম্বিতম্বি এবং দাঙ্গায় তাঁর ভূমিকা ও মুসলিমদের প্রতি তাঁর আচরণ নিয়ে তৈরি তথ্যচিত্রকে নিষিদ্ধ করার কয়েক সপ্তাহ পর। কর্তৃপক্ষ বলছেন এটা গতানুগতিক কাজ। তবে, ভারতে অনেকেই এটা পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে, বাঁধাধরা আমলাতান্ত্রিক কার্যপদ্ধতির পরিবর্তে এটা প্রতিহিংসার চরিতার্থতা বলেই দেখাচ্ছে।” ভারতের এডিটার্স গিল্ডও তল্লাশির নিন্দায় বলেছে, “আয়কর দপ্তরের সমীক্ষা সরকারি সংস্থাকে কাজে লাগিয়ে সরকারের নীতি বা শাসক প্রতিষ্ঠানের সমালোচনামূলক সংবাদপত্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে চোখ রাঙানো প্রবণতার ধারাবাহিকতার সঙ্গে সুসংগত বলেই দেখা যাচ্ছে।”

বিদেশী সংবাদ মাধ্যমগুলো এইভাবে সুস্পষ্ট রূপে জানিয়ে দিয়েছে এবং ভারতের পর্যবেক্ষকদেরও এই ব্যাপারে সামান্যতম সন্দেহ নেই যে, বিবিসি কার্যালয়ে আয়কর দপ্তরের তল্লাশি কখনই বাঁধাধরা কাজ ছিল না। তা ছিল মোদীর সমালোচনা করে তথ্যচিত্র নির্মাণের জন্য বিবিসিকে শিক্ষা দেওয়ারই এক উদ্যোগ। এছাড়া, নিজের ৫৬ ইঞ্চি ছাতি নিয়ে মোদীর অহমিকা অপরিমিত, সেই প্রশস্ত ছাতিও বিবিসির বিরুদ্ধে হুমকির আস্ফালনে তাঁকে প্ররোচিত করে থাকবে। বিজেপি নেতারা বলছেন যে, সুপ্রিম কোর্ট যখন গুজরাট গণহত্যার সমস্ত দায় থেকে মোদীকে অব্যাহতি দিয়েছে, তখন সেই আখ্যানকে আবার উস্কিয়ে তোলার কোনো ভিত্তি থাকতে পারে না। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের সব রায়ই কি ন্যায় বিচারকে প্রতিপন্ন করে? সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়ে সমালোচনা কি একেবারেই বিরল ঘটনা? সুপ্রিম কোর্টের প্রথিতযশা এক আইনজীবী সম্প্রতি বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টে এখনে এমন কিছু আইনজীবী আছেন যাঁরা ঐ পদের যোগ্য নন। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরাই কি সে কথা জানান দেননি? স্মরণ করুন ২০১৮’র জানুয়ারি মাসে সুপ্রিম কোর্টের চার বিচারপতির সাংবাদিক সম্মেলনের কথা, যেদিন তাঁরা সরকারকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার জন্য সংবেদনশীল মামলাগুলো বিচারপতি অরুণ মিশ্রর কাছে পাঠানোর জন্য তৎকালীন প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিলেন। স্মরণ করুন একদা বিচারপতি রঞ্জন গগৈ’এর কথা, যাঁর নেতৃত্বে অযোধ্যা মামলার রায় হিন্দুত্ববাদীদের পক্ষে গেছে এবং যিনি অবসর নেওয়ার পরপরই বিজেপি তাঁকে রাজ্যসভার সাংসদ হিসাবে মনোনীত করার ব্যবস্থা করে। বিচার করুন এ’বছরের ৪ জানুয়ারি অবসর নেওয়া বিচারপতি আব্দুল নাজিরকে ১২ ফেব্রুয়ারি অন্ধ্রপ্রদেশের রাজ্যপাল রূপে পুরস্কৃত করার কথা। আব্দুল নাজির ছিলেন অযোধ্যা মামলার বেঞ্চের অন্যতম বিচারপতি, যে মামলার রায়ে আরএসএস’এর হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত বাবরি মসজিদের জমিকে রাম মন্দির বানানোর জন্য হিন্দুত্ববাদীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এই বিচারপতিরা রায় দিলে সেই সমস্ত রায় নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না? বিজেপি চাইলেও সবচেয়ে বেদনাময় ও ভয়াবহ গণহত্যার অন্যতম ২০০২’র গুজরাটে মুসলিম সম্প্রদায়ের নিধনকে কি আমরা ভুলে যাব? ভুলে যাওয়া কি আদৌ উচিৎ? এই জন্যই বিজেপি নির্মিত তথ্যচিত্রের এত আকর্ষণ, সরকারের নিষেধ সত্ত্বেও যে তথ্যচিত্র দেখতে জনগণের উৎসাহে ও আগ্ৰহে একেবারেই ভাটা নেই। আর, এই প্রশ্নটাও সংগতভাবেই ওঠে যে, আয়কর দপ্তরের তল্লাশির পিছনে অন্যতম যে উদ্দ্যেশ্য মোদী সরকারের ছিল তা কি পূরণ হয়েছে? বিবিসি কি মোদী সরকারের হাবভাবে খুব সন্ত্রস্ত হয়ে গেছে? বিবিসি’র ডাইরেক্টর জেনারেল টিম ডেভি জানিয়েছেন, “ভীত না হয়ে বা পক্ষপাতিত্ব না দেখিয়ে সংবাদ পরিবেশনের আমাদের সামর্থ্যের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু হতে পারে না।” বিবিসি অতএব জানিয়ে দিল, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশন থেকে কোনো কিছুই তাদের নিবৃত্ত করতে পারবে না। ভারতেও যেমন বিভিন্ন সংবাদপত্রের অফিসে আয়কর দপ্তরের হানাদারি সত্ত্বেও গোদি মিডিয়ার পাশাপাশি ছোটো হলেও সংবাদ মাধ্যমের একটা অংশ নির্ভিক সংবাদ পরিবেশনের পথে অবিচল রয়েছে। আর একটা বিষয়ও এই প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য। মোদী সরকারের কাছে অনভিপ্রেত হলেও দুনিয়ার দেশগুলোর কাছে মোদী সরকারের গণতান্ত্রিক নিষ্ঠার স্বরূপ আগাগোড়া উন্মোচিত হয়ে গেল। ভারত এবার জি-২০র সভাপতি হওয়ায় ২৪-২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ বেঙ্গালুরুতে অনুষ্ঠিত হল জি-২০ গোষ্ঠীর অর্থমন্ত্রীদের বৈঠক। তাঁরা যেমন মোদীকে নিয়ে বিবিসি নির্মিত তথ্যচিত্রকে জানলেন, তেমনি ঐ তথ্যচিত্রের বদলা স্বরূপ ভারতে বিবিসির কার্যালয়ে আয়কর দপ্তরের তল্লাশি সম্পর্কেও অবহিত হলেন। তাঁরা আরও জ্ঞাত হলেন যথেষ্ট চর্চিত এই অভিমত সম্পর্কে যে, যারা ভারত থেকে ঔপনিবেশিক শাসকদের দূর করতে কোনো অবদানই রাখেনি, তারাই মোদী ও সংঘ পরিবার সম্পর্কে যেকোনো সমালোচনাকে ‘ঔপনিবেশিক মানসিকতা প্রসূত’ বলে লাগিয়ে দিতে উন্মুখ। মোদী এখন এই প্রচারে সোচ্চার হন যে, ভারত হল ‘গণতন্ত্রের জননী’। সেই জননী বিশ্বের দরবারে জুলুমবাজ রূপেই প্রতিভাত হলেন!

- জয়দীপ মিত্র

খণ্ড-30
সংখ্যা-4