ক্ষমতার রাজনীতি, অর্থনীতি, দুর্নীতি
power-politics

ভারতের কেন্দ্রীয় বা রাজ্য রাজনীতিতে দুর্নীতি মাঝেমধ্যেই কেন্দ্রীয় প্রশ্ন হিসেবে উঠে আসে। এই প্রশ্নে সরকারের পতন হতে বা কখনও কখনও কিছু নেতা মন্ত্রীকে জেলে যেতেও আমরা দেখেছি। কিন্ত দুর্নীতির বহর কমেনি, বাড়তেই থেকেছে। অনেকটা রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতির হিমালয়যাত্রা অধ্যায়ের সেই গল্পের মতো। দুধে জল মেশানো আটকানোর জন্য পরিদর্শকের সংখ্যা যত বাড়ছে, দুধের রঙ তত ঘোলা থেকে স্বচ্ছনীল হয়ে উঠছে। অবশেষে গোয়ালা বলতে বাধ্য হল যে পরিদর্শকের সংখ্যা আরও বাড়লে পরে দুধের মধ্যে এবার শামুক, ঝিনুক, চিংড়িমাছের প্রাদুর্ভাব ঘটার সমূহ সম্ভাবনা।

আশির দশকের শেষভাগে বোফর্স কেলেঙ্কারিকে ঘিরে ভারতের রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন ঘটে যায়। রাজীব গান্ধীর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতাসম্পন্ন সরকারকে পরাজিত করে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং অকংগ্রেসী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উঠে আসেন। তখন কথা উঠেছিল উঁচুতলার দুর্নীতি এবং বিশেষ করে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত কেনাবেচার ক্ষেত্রে দুর্নীতিকে আটকাতে হবে। কিন্ত সেদিনের বোফর্সতোপ থেকে আজকের রাফেল বিমান – দুর্নীতির সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে। কিছু নতুনত্ব অবশ্যই যুক্ত হয়েছে। দুর্নীতির পরিমাণগত মাত্রা বেড়েছে বহুগুণ, আর দুর্নীতি সংক্রান্ত বহু খবর সামনে চলে এলেও ক্ষমতাশালী আজ এতই শক্তিমান যে সরকার এবং কোর্টের মধ্যে বন্ধ খামে কথা চলে, জনগণ কিছুই জানতে পারে না আর সরকারের গায়ে আঁচড়ও লাগে না।

বোফর্সের পর জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিতে দুর্নীতি আবার বড় প্রশ্ন হিসেবে দেখা দেয় এক দশক আগে। ইউপিএ সরকারের দ্বিতীয় দফায় কয়লা ও টেলিকম কেলেঙ্কারি, দিল্লীর বুকে কমনওয়েল্থ গেমস কেলেঙ্কারি বিরাট ঝড় তুলে দেয়। দুর্নীতি রোধে জনলোকপাল আইন প্রণয়নের প্রশ্ন তুলে দিল্লীতে নতুন পার্টিবানিয়ে ক্ষমতায় চলে আসেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। আর কালো টাকা দেশে ফিরিয়ে সকলের ব্যাঙ্কে পনেরো লক্ষ টাকা ঢোকানোর স্বপ্ন দেখিয়ে দেশের মসনদে গদিয়ান হন নরেন্দ্র মোদী। কেজরিওয়ালের আপ এখন দিল্লী পেরিয়ে পাঞ্জাবেও রাজ্য সরকারের চালকের আসনে। কিন্ত জনলোকপালের আজও দেখা মেলেনি। আর কালো টাকা ধরার নামে নোট বাতিল করা মোদী সরকার এখন ইলেকটোরাল বন্ড চালু করে কালো টাকাকে সাদা করার নতুন পথ খুলে দিয়েছে। তাছাড়া দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত রাজনেতাদের জন্য রাতারাতি দায়মুক্ত হওয়ার সবচেয়ে সহজ পথ হল দলবদল করে বিজেপিতে নাম লেখানো।

বিভিন্ন রাজ্যের রাজনীতিতেও দুর্নীতির প্রশ্নে কখনও সরকার পরিবর্তন হতে, কখনও মুখ্যমন্ত্রী সমেত বিভিন্ন মন্ত্রীদের জেলে যেতে আমরা দেখেছি। তামিলনাড়ুতে জয়াললিতা থেকে হরিয়ানাতে ওম প্রকাশ চৌটালা, বিহারে লালুপ্রসাদ যাদব থেকে পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রতিককালে পার্থ চট্টোপাধ্যায় – জেলে যাওয়া নেতা মন্ত্রীদের তালিকা খুব ছোট নয়। কিন্তু পরীক্ষার ফল প্রকাশ থেকে মেডিক্যাল বা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি থেকে যে কোনো চাকরিতে নিয়োগ – রাজ্যে রাজ্যে দুর্নীতির বহর বেড়েই চলেছে।

আসলে দুর্নীতি নিছক নৈতিক সমস্যা নয়, এর সমাধানও নিছক নীতিশিক্ষার মধ্যে নিহিত নেই। একটা খুব সত্যি কথা আমরা কয়েক প্রজন্ম ধরে শুনে আসছি – ক্ষমতা দুর্নীতি আনে, চরম ক্ষমতা আনে চরম দুর্নীতি। অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা মানেই অনিয়ন্ত্রিত দুর্নীতি। আজ দুর্নীতির সমস্যা আসলে এই অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতার সমস্যা। ক্ষমতার খেলা কোনে দুর্নীতির ঘটনাকে বড় করে তোলে, আর অনেক ঘটনাকে অবলীলাক্রমে ধামাচাপা দিয়ে দেয়। পশ্চিমবঙ্গে এত দুর্নীতির মধ্যেও বোধহয় একমাত্র স্বস্তির ব্যাপার হল এ রাজ্যে ডাবল ইঞ্জিনের সরকার নেই। তাই কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাতে ক্ষমতার খানিকটা নিয়ন্ত্রিত ভারসাম্যের সৌজন্যে নিয়োগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে ধারাবাহিক যুব-ছাত্র আন্দোলনের কিছু ফল দেখা যাচ্ছে।

এর সম্পূর্ণ বিপরীত ছবি দেখা যাবে ডাবল ইঞ্জিন শাসিত রাজ্য মধ্যপ্রদেশে। ব্যাপম কেলেঙ্কারিতে ন্যায় বিচার হওয়ার পরিবর্তে সাক্ষী, কেলেঙ্কারি উন্মোচনকারী ও সাংবাদিক সহ পঞ্চাশ জনের বেশি মানুষের রহস্যজনকভাবে মৃত্যু ঘটেছে। বিহারে পশুখাদ্য কেলেঙ্কারির জের এখনও চলছে, কিন্তু মধ্যপ্রদেশে এর চেয়ে বহুগুণ বড় শিশুখাদ্য কেলেঙ্কারির কোনো তদন্ত নেই। ডাবল ইঞ্জিন সরকার মানেই অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা আর অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা মানেই বেলাগাম দুর্নীতি এবং দুর্নীতিগ্রস্তদের বেলাগাম দাপট।

নব্বই দশকের গোড়ায় যখন বাজারকেন্দ্রিক অর্থব্যবস্থা চালু হয় তখন বলা হয়েছিল বাজার দুর্নীতিকে কম করবে। অর্থনীতিতে সরকারের হস্তক্ষেপ মানে লাইসেন্স-কোটা-পারমিট রাজ আর তার মানেই দুর্নীতি। মুক্ত বাজার এনে দেবে দুর্নীতি মুক্ত স্বচ্ছ প্রশাসন। সেই বাজারসর্বস্ব অর্থনীতির তিন দশক আমরা পেরিয়ে এসেছি। দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ প্রশাসনের দেখা কিন্তু মেলেনি, এসেছে আদানি-আম্বানি কোম্পানি রাজ। ইংরেজিতে বলে ক্রোনি ক্যাপিটালিজম। বাংলা করা যেতে পারে দোসর পুঁজিবাদ। এখানে মোদীর হাত ধরে আদানি উঠে আসে, আদানির বিমানে মোদীর নির্বাচনের প্রচার চলে। সরকারের সৌজন্যে স্টেট ব্যাঙ্কের টাকায় আদানি অস্ট্রেলিয়ায় কয়লাখনি কেনে, আবার সরকারেরই ফরমানে আদানি সেই অস্ট্রেলিয়ার কয়লা ভারতের বিদ্যুৎ কোম্পানিকে বিক্রি করে।

দু-হাজার ষোল সালের নভেম্বরে তুঘলকি ফরমান জারি করে পাঁচশো ও হাজার টাকার নোট বাতিল করার সময়ও বলা হয়েছিল এবার কালো টাকা ও দুর্নীতির অবসান ঘটবে। কিন্ত এক হাজারের বদলে এলো দু হাজারের নোট। আর আজ যখন ইডি তল্লাশি চালিয়ে বিভিন্ন বাড়ি থেকে কোটি কোটি টাকার নোট উদ্ধার করছে এবং টেলিভিশনে তার ধারা বিবরণী ও প্রদর্শনী চলছে, তখন এটা স্পষ্ট যে নোটবাতিলের খেলায় আর যাই হোক কালো টাকা বা দুর্নীতির গায়ে সামান্য আঁচড়টুকুও লাগেনি।

দুর্নীতিবলতে আমাদের নজর সাধারণত চলে যায় বড় টাকার অঙ্কের দিকে। দু-একজন নেতা বা ব্যক্তিচরিত্রকে ঘিরে কিছুদিনের জন্য সংবাদমাধ্যম রীতিমত মেতে ওঠে, আমাদের মাতিয়ে রাখে। সময়ের গতিতে অন্য গল্প চলে আসে, দুর্নীতির কাহিনী আবার পর্দার আড়ালে চলে যায়। আর মূল ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্নটি তো সবসময়ই অবহেলিত থেকে যায়। পশ্চিমবঙ্গের নিয়োগ দুর্নীতির প্রসঙ্গ ধরা যাক। নিয়োগ দুর্নীতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হাজার হাজার যুবক-যুবতীর দীর্ঘদিনের হার-না-মানা জেদ ও লড়াইয়ের ফলেই হাইকোর্টের রায়ে তদন্ত ও তল্লাশি, আর তার জের ধরেই টেলিভিশনে নোটের ছবি, বিচারপতির সাক্ষাৎকার। কিন্ত নিয়োগের কী হবে? সেই প্রশ্ন নিছকই আন্দোলনকারী ও তাদের কিছু সমর্থক ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের প্রশ্ন হিসেবে থেকে যাচ্ছে।

উপরতলার দুর্নীতি বা বড় অঙ্কের দুর্নীতির পাশাপাশি ছড়িয়ে আছে দৈনন্দিন দুর্নীতির অসংখ্য উদাহরণ। খনন, ব্যবসা, সরকারী দফতর, পঞ্চায়েত কাঠামো, থানা, আদালত, শিক্ষা, চিকিৎসা – প্রায় সর্বত্র কম-বেশি দুর্নীতির উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে। উপরতলার দুর্নীতির উৎস ক্ষমতার অপব্যবহার, নীচুতলার এই দুর্নীতির উৎস অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষের অধিকারহীনতা ও বিপন্নতা। উদাহরণস্বরূপ, আমরা যাকে অবৈধ খনন হিসেবে চিহ্নিত করি একটু ভালো করে খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে তা আসলে এক সমান্তরাল খনন ব্যবস্থা যার এক প্রান্তে রয়েছে পুলিশ-প্রশাসন-পুঁজির মালিকের অসাধু চক্র আর অন্য প্রান্তে জীবিকার তাগিদে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা নিরাপত্তাহীন শ্রমিক। এই দুই প্রান্তকে কি একই দুর্নীতির অংশীদার হিসেবে চিহ্নিত করা যায়?

ক্ষমতার অপব্যবহারকে সবসময় আর্থিক উপার্জনের মাপকাঠিতে দেখলেও ঠিক হবে না। সাংবিধানিক সংস্থার সঠিক সংবিধানসম্মত পরিচালনা এবং রাষ্ট্রক্ষমতার ন্যায়সঙ্গত বিভাজন ও ভারসাম্য নির্ধারণ হল গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত। আজ যেভাবে বিচারবিভাগ ও সংসদীয় প্রণালীর উপর কার্যনির্বাহী শক্তি বা সরকারের নিয়ন্ত্রণ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাতে গণতন্ত্রের ভিত্তি ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। যখন প্রধান বিচারপতি অযোধ্যায় মন্দির নির্মাণের পক্ষে রায় দিয়ে অবসর নেওয়ার পরই রাজ্যসভায় সদস্য হিসেবে মনোনীত হন বা একজন কার্যরত আমলাকে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তাঁর পদ থেকে ‘স্বেচ্ছা অবসর’ প্রদান করে নির্বাচন কমিশনে নিযুক্ত করা হয় তখন তাকে একমাত্র রাজনৈতিক দুর্নীতি হিসেবেই চিহ্নিত করা যেতে পারে।

ক্ষমতার অপব্যবহার ও বেলাগাম হয়ে ওঠার প্রবৃত্তিকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা এবং জনগণের ব্যাপক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সকলের জন্য সমান সুযোগের ব্যবস্থা করে সর্বস্তরে স্বচ্ছ প্রশাসনকে সুনিশ্চিত করা – দুর্নীতি নিরসনের এটাই প্রকৃত রাস্তা। এককথায় বলতে গেলে গণতন্ত্র সম্প্রসারণের পথেই দুর্নীতির অপসারণ সম্ভব ও কাম্য।

(লেখাটি পরিচয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।)

খণ্ড-30
সংখ্যা-8