বাম আন্দোলন ফ্যাসিবাদ বিরোধী বৃহত্তর লড়াইকে প্রেরণা জোগাবে

struggle-against-fascism
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সিপিআই(এমএল)-এর একাদশ পার্টি কংগ্রেসের প্রতিনিধি সম্মেলনের প্রথম দিন সম্মেলনকক্ষের ভেতরে দেশের বিভিন্ন বাম সংগঠনের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে শুরু হয় উদ্বোধনী পর্ব। সভাপতিত্ব করেন কমরেড স্বদেশ ভট্টাচার্য এবং পরিচালনা করেন কমরেড মীনা তেওয়ারি। উপস্থিত ছিলেন দীপঙ্কর ভট্টাচার্য (সিপিআইএমএল), জি দেবরাজন (ফরওয়ার্ড ব্লক), মনোজ ভট্টাচার্য (আরএসপি), অরূপ চ্যাটার্জী (এমসিসি), পল্লব সেনগুপ্ত (সিপিআই), মহম্মদ সেলিম (সিপিআইএম), ভীমরাও বানসোর (লাল নিশান পার্টি), কিশোর ধামালে (সত্যসাধক কমিউনিস্ট পার্টি), মঙ্গতরাম পাসলা (আরএমপিআই)। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন নেপালের ইউনাইটেড মার্কসিস্ট লেনিনিস্ট (ইউএমএল) পাটির সহ সভাপতি ঈশ্বর পোখরেল, বিশিষ্ট অধ্যাপক ওপি জয়সওয়াল প্রমুখরা।

দীপঙ্কর ভট্টাচার্য তাঁর বক্তব্যে বলেন যে এখনো অবধি আমাদের পার্টির সবচেয়ে বড় পার্টি কংগ্রেস এটা। আমরা দেখেছি আমাদের পার্টি শুধু নয়, গোটা বিহারের জনগণেরই এই সম্মেলন নিয়ে আগ্রহ ও উৎসাহ আছে। এজন্য বিহারের জনগণকে ধন্যবাদ। নেপালের ইউএমএল ও আমাদের দেশের বামপন্থী বিভিন্ন পার্টির নেতৃত্ব আমাদের মঞ্চে এসেছেন। তাঁদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। আগ্রাসী পুঁজিবাদ ও জলবায়ু সঙ্কট গোটা বিশ্বকেই আক্রমণ শানাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক স্তরে সংগ্রামী জনগণের ঐক্য প্রয়োজনীয়। ২০১৪ থেকে আমাদের দেশ মোদী সরকারের ফ্যাসিবাদের একের পর এক নিদর্শন দেখছে। সাম্প্রতিকটি সদ্য দেখা গেল বিবিসি’র গুজরাট দাঙ্গা কেন্দ্রিক তথ্যচিত্র নিয়ে। আইটি আইন দিয়ে তার প্রদর্শন আটকানো হল। তারপরেই ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টের রেইড হল দিল্লীর বিবিসি অফিসে। সরকার ক্রমশ বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠছে। আমাদের দেশে সামাজিক বৈষম্য তো আছেই। আর্থিক বৈষম্য ভয়ংকরভাবে বাড়ছে। এর প্রতিকারে ট্যাক্স ব্যবস্থার রদবদল দরকার ছিল। গরিবকে সবচেয়ে বেশি ট্যাক্স দিতে হয়। এবারের বাজেটেও সব ছাড় বড়লোকদেরই বেশি করে মিলল। সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ যা হচ্ছে তাকে আটকানোর জন্য একদিকে আক্রমণ অন্যদিকে ঘৃণার চাষ বাড়াচ্ছে সরকার। বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলিতে রাজ্যপালের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় শাসন চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। বিচার ব্যবস্থাকে দখল করার চেষ্টা হচ্ছে।

সম্পত্তির ঘনীভবন, শাসনের ঘনীভবন দেখা যাচ্ছে। একজোট হয়ে লড়লে ২০২৪-এ মোদী সরকারকে হারানো যাবে হয়ত। কিন্তু আরএসএস যে ছায়া ছড়িয়ে দিয়েছে গোটা দেশের ওপর তার বিরুদ্ধে লম্বা লড়াই দরকার। এই লম্বা ও সবচেয়ে শক্তিশালী লড়াইয়ের জন্য বাম ঐক্য খুব জরুরি। বামেরা ঐক্যবদ্ধভাবে শক্তিশালী লড়াই শুরু করলে তা সরকার বদলের প্রেরণা দিতে পারে। বুনিয়াদী মানুষের লড়াই-ই ওপরের লড়াইকে শক্তি দিতে পারে। আমাদের সম্মেলন এই সমস্ত বিষয়গুলি নিয়েই চর্চা করতে চলেছে। ফ্যাসিবাদ সংক্রান্ত বোঝাপড়া ও তার বিরুদ্ধে লড়াই এবং জলবায়ু আন্দোলনের বিষয় নিয়ে আমরা খুব গুরুত্ব দিয়ে চর্চা করব সম্মেলনে। বুনিয়াদী মানুষের সমস্ত আন্দোলন নিয়ে চর্চা হবে। আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ফ্যাসিবাদ থেকে দেশকে মুক্ত করার সংকল্প গ্রহণের সম্মেলন এটা।

ঈশ্বর পোখরাল (ইউএমএল, নেপাল) বলেন নেপালে এখন কোনও দলের একক গরিষ্ঠতা নেই। আমরা নেপালের সবচেয়ে সামনের দল হিসেবে সামনে এসেছি। জনতার রায়কে মর্যাদা দিতে আমরা বাম ঐক্য গঠনের চেষ্টা করেছি এবং তার মধ্যে দিয়ে সরকারকে নেতৃত্ব দিতে চেয়েছি। সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা ও তাদের ন্যায্য সুযোগ সুবিধা প্রদানের চেষ্টা আমরা করে যাচ্ছি। সমৃদ্ধ নেপাল, সুখী নেপাল গঠনই আমাদের লক্ষ্য। সংবিধান সভার মাধ্যমে নেপাল তার সংবিধান পেয়েছে। জনগণকে তার দেওয়া আশ্বাসগুলি রূপায়ণ ও পালনে আমরা বদ্ধ পরিকর।

পল্লব সেনগুপ্ত (সিপিআই) বলেন গোটা বিশ্ব জুড়েই আগ্রাসী পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের থাবা দেখা যাচ্ছে। পরিবেশের সঙ্কট প্রতিদিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। এইরকম একটা সময়েই আমাদের দেশে গত কয়েক বছর ধরেই ফ্যাসিবাদের আক্রমণ বাড়ছে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা কমছে। বিচার ব্যবস্থাকে কুক্ষীগত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। দক্ষিণপন্থী ও অতি দক্ষিণপন্থীরা ছায়াযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। মনুবাদী আরএসএস’এর আক্রমণের সামনে দলিত, আদিবাসী, নারী ও সমাজের নানা অংশ বিপদের সম্মুখীন। আমি আপনাদের খসড়া দলিল পড়েছি ও এরসঙ্গে একমত। বামেরা যদিও প্রাণপণে লড়াই করছে তবুও ফ্যাসিবাদকে হারাতে সেটাই যথেষ্ট নয়। ফ্যাসিবাদকে হারাতে বামেদের অন্যান্য শক্তির সঙ্গে হাত মেলাতে হবে। আমরা মনে করি ভারতে কমিউনিস্ট ঐক্য সময়ের দাবি। আমরা আশা করি সিপিআই(এমএল) তার শক্তি বাড়াবে এবং বাম ঐক্যকে শক্তিশালী করবে। হো চি মিন’এর কথা দিয়ে শেষ করব। বড় ঐক্য বড় সাফল্যের সূত্র।

মহম্মদ সেলিম (সিপিআইএম) বলেন স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর ফ্যাসিস্ট আরএসএস দ্বারা এখন দেশ শাসিত হচ্ছে। মোদী সরকার স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিস্ট আক্রমণ নামিয়ে আনছে। হিন্দুরাষ্ট্র তৈরি করে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক আদর্শকে ধ্বংস করতে চাইছে। সংবিধান ও জনগণের মৌলিক অধিকারের ওপর আক্রমণ শানাচ্ছে। চারটি শ্রমকোডের মধ্যে দিয়ে শ্রমিক শ্রেণির ওপর তারা আক্রমণ নামিয়েছে। তিনটি কৃষি আইনের মধ্যে দিয়ে কৃষি ও কৃষকের ওপর আক্রমণ নামানোর চেষ্টা করেছিল।

সাম্প্রতিক বাজেটে মনরেগার বরাদ্দ কমেছে। সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নানারকম আক্রমণ নামছে। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে এই হামলা বেশি। মনুবাদি আক্রমণ নামছে মহিলাদের ওপর, দলিত আদিবাসীদের ওপর। নব্য উদারবাদী নীতির বিরুদ্ধে প্রবল লড়াই চলছে। সিএএ আইনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী লড়াই হয়েছে। শ্রমিক শ্রেণী শ্রমকোডের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। কৃষি আইনের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক লড়াই এই আইন বাতিলে সরকারকে বাধ্য করেছে। সমস্ত ধরনের বাম গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে।

অরূপ চ্যাটার্জী (এমসিসি) বলেন যে সমস্ত প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা সহ সর্বত্র আরএসএস’এর চিন্তাধারার লোককে বসানোর চেষ্টা করছে মোদী সরকার। গোটা দেশকে এই বিচারধারার মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে। এর বিরুদ্ধে বামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। আমি আশা করি গোটা দেশে একটি দলে সব বামপন্থীরা ঐক্যবদ্ধ হবেন।

মনোজ ভট্টাচার্য (আরএসপি) বলেন আমি হিন্দিতে ততটা সড়গড় নই। তবু হিন্দিতে বলার চেষ্টা করছি। হিন্দির বিরুদ্ধে আমরা কেউ’ই নই। কিন্তু হিন্দি হিন্দুস্থানকে চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে। হিন্দিকে গোটা দেশে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। ইতিহাসকে নতুন করে লেখার চেষ্টা চলছে। ইতিহাসকে বিকৃত করার চেষ্টা চলছে। পুঁজি ও শ্রমের দ্বন্দ্ব বাড়ছে। জনগণের সঙ্গে শাসকের দ্বন্দ্ব বাড়ছে। শুধু বাম ঐক্য বড় কথা নয়। বড় কথা জনতার ঐক্য। জনতার ঐক্য ভাষণের মধ্যে দিয়ে হয় না। আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে হয়। বামেরা জনগণের ঐক্য গঠনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিতে পারেন। হিন্দুদের মধ্যে ৩৫৩৯ সম্প্রদায় আছে। এই ভিন্নতাকে মোদী-শাহরা মানতে চায় না। তাদের হিন্দুত্বের ধারণায় তারা সবকিছুকে একরঙা দেখতে চায়।

জি দেবরাজন (ফরওয়ার্ড ব্লক) বলেন যে সম্পত্তির সমানাধিকারের কথা ছেড়ে দেওয়া যাক, সামান্য কিছু অধিকারও দেশের গরিব মেহনতি মানুষ পাচ্ছে না। অথচ সংবিধানে সমাজতন্ত্রের কথা যুক্ত করা আছে। আছে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা, যার ওপর প্রতিদিন আক্রমণ নামছে। এইসবের বিরুদ্ধে বামেদের লড়াইতে আমাদের খামতিগুলি খতিয়ে দেখতে হবে। সংগঠিত ও অসংগঠিত ক্ষেত্রে লাল ঝাণ্ডার তলায় শ্রমিকরা লড়ছে। নির্বাচনের ময়দানে তাদের ভোট বামেরা পাচ্ছে না। বামেদের নিজেদের মধ্যে ঐক্যের অভাবও একটা সমস্যা। চেষ্টা করতে হবে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হবার। আমাদের জাতীয় সম্মেলনও আসন্ন। সেখানেও আমরা এই বিষয়গুলো নিয়ে আন্তরিকভাবে চর্চা করব।

ভীমরাও বানসোর (লাল নিশান পার্টি) বলেন বিজেপি মূলত হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে শাসনে টিঁকে থাকে। সেই বিভাজনের নকশাকে ধ্বংস করতে হবে বামপন্থীদের।

মঙ্গতরাম পাসলা (আরএমপিআই) বলেন যে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে শুধু নয়, স্বাধীনতার পরেও জনগণের আন্দোলনের স্বার্থে সবচেয়ে বেশি আত্ম বলিদান বামপন্থীরাই করেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বামপন্থীদের দুর্বলতা কেন, তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। কমিউনিস্ট আন্দোলন কীভাবে এগোবে সে বিষয়ে চর্চার সঙ্গেই বামপন্থীদের দুর্বলতা নিয়ে চর্চার প্রশ্নটি জড়িত। সমস্ত বামপন্থী দলের একসঙ্গে বসে এই নিয়ে গভীর চর্চা দরকার।

রুটি-রুজির লড়াই করতেই হবে। কিন্তু তা যেন অর্থনীতিবাদে আটকে না যায় সেটা বামেদের দেখতে হবে। রাজনীতিকরণ খুব জরুরি একটা কাজ, যেখানে কিছু সমস্যা থেকে যাচ্ছে।

গোটা দেশে সব বামপন্থী দল মিলে একটি সম্মেলন করা হোক — এই আমার অনুরোধ। দেশের সামনে যে বড় সঙ্কট তার মোকাবিলার পথ একসঙ্গে বসে ঠিক করা হোক।

ঐক্যবদ্ধ বাম আন্দোলনের বার্তা রেখে উদ্বোধনী পর্বটি সমাপ্ত হয়।

খণ্ড-30
সংখ্যা-4