আন্দোলনের কাছে নত হল নেতানিয়াহু সরকার
the-netanyahu

বিচার ব্যবস্থাকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনার নেতানিয়াহু সরকারের যে প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ইজরায়েলের জনগণ গত তিন মাস ধরে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছিলেন, তার কাছে সরকারকে আপাতত নত হতে হল। ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়াভ গ্যালান্টকে নেতানিয়াহু ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় মন্ত্রীসভা থেকে বরখাস্ত করেন। গ্যালান্ট প্রতিবাদরত জনগণের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেছিলেন, ইজরায়েলে বর্তমানে যা চলছে তা “রাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রতি সুস্পষ্ট এবং আশু এবং মূর্ত বিপদ – আমি এর অংশিদার হতে পারব না। “ যে সরকার বিচার ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে প্রস্তাব এনেছে, সেই সরকারের মন্ত্রীরই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোটা সরকারের পক্ষে ইতিবাচক কোনো বার্তা হতে পারে না। কাজেই, মন্ত্রীকে ছাঁটাই করা ছাড়া অন্য কোনো পথ নেতানিয়াহুর কাছে ছিল না। তবে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রীকে মন্ত্রীসভা থেকে বরখাস্ত করাটা চলমান আন্দোলনে প্রভূত ঘৃতাহুতির সঞ্চার করল – আন্দোলন প্রবলতর হয়ে উঠে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। জনগণ বিভিন্ন স্থানেই রাস্তা অবরোধ করলেন, কোথাও কোথাও অগ্নি সংযোগ করাও হল, সরকারি প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রইল, দেশের সর্ববৃহৎ কর্মী সংগঠন ধর্মঘটের ডাক দেওয়ায় স্বাস্থ্য পরিষেবা, পরিবহণ, ব্যাঙ্ক, বিমান পরিবহন ক্ষেত্রে কাজ ভালো মাত্রায় ব্যাহত হল, মলগুলো বন্ধ রইল। বিশ্বের দেশগুলোতে ইজরায়েলি দূতাবাসের কর্মীরাও সরকার বিরোধী প্রতিবাদে অংশ নিলেন। অর্থনীতি পর্যুদস্ত হল। ইজরায়েলি সংসদ নেসেট ও প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বাড়ির সামনে প্রতিবাদরত জনগণের ঢল নামল। প্রকশিত একটা সংবাদ জানিয়েছে, সমাবেশের ব্যাপকতা ও জনগণের রুদ্র মূর্তি দেখে নেতানিয়াহু নাকি বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। প্রতিবাদ পরিস্থিতির সমস্ত দিক বিবেচনা করে নেতানিয়াহু অবশেষে জানালেন, “আমি অবিলম্বে বিচার ব্যবস্থা সংস্কার প্রক্রিয়া বন্ধ রাখার কথা বলছি। “

ইজরায়েলের বর্তমান সরকার যে ইজরায়েলের গণতন্ত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে দক্ষিণপন্থী সরকার তা ভাষ্যকাররা জানাচ্ছেন এবং আজকের দেশব্রতীর ১৬ মার্চ সংখ্যার প্রতিবেদনেও সেই অভিমত ব্যক্ত হয়েছে। এই সরকারের চোখে ইজরায়েলের সুপ্রিম কোর্ট হলো দক্ষিণপন্থী একনায়কতান্ত্রিক শাসনের পথে এক বৈরিভাবাপন্ন প্রতিবন্ধক। আর তাই সেই আদালতের ডানা ছাঁটার লক্ষ্যে সরকার প্রস্তাবিত আইনের অভিপ্রায় হল –

(১) সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের নিয়োগ কমিটিতে সরকার মনোনীত প্রতিনিধিদের সংখ্যাকে বাড়িয়ে সুপ্রিম কোর্টে সরকার অনুগত বিচারপতির সংখ্যাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ করে তোলা। বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি মনোনয়নের কমিটির সদস্য সংখ্যা নয় – দুই মন্ত্রী ও সংসদের দুই সদস্য, সুপ্রিম কোর্টের প্রেসিডেন্ট ও দুই বিচারপতি এবং আইনজীবীদের থেকে মনোনীত দুজন। প্রস্তাবিত নতুন কমিটির সংখ্যা হবে এগার যাতে সরকারের বেছে নেওয়া প্রতিনিধিই হবে সাত জন, ফলে সরকার অনুগত বিচারপতিদের সর্বোচ্চ আদালতে পাঠাতে অসুবিধা হবে না।

(২) সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতাকে সীমিত করে আদালতের ওপর শাসক কর্তৃত্বকে কায়েম করা।

(৩) সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সম্মতির ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ/রায়কে খারিজ করা। ইজরায়েলি সংসদের বর্তমান সদস্য সংখ্যা ১২০ – এর পরিপ্রেক্ষিতে ৬১ জন সাংসদ তাঁদের মতামতের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের কোনো রায়কে খারিজ করে দিতে পারবেন।

প্রতিবাদের সংগঠকদের মতে সরকারের পেশ করা এই প্রস্তাব সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাংসদদের সমর্থনে পাশ হয়ে আইনে পরিণত হলে তা গণতন্ত্রের কফিনেই পেরেক পুঁতবে, একনায়কতন্ত্রের পথ প্রশস্ত হবে। সরকার-বিরোধী এই আন্দোলনে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর এক অংশের সমর্থনও ভালো মাত্রায় রয়েছে বলে দেখা গেছে। রিজার্ভিস্ট বা সংরক্ষিত সেনারা ইজরায়েলি সেনাবাহিনীর এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এরাও মনে করছে, সুপ্রিম কোর্টের হাতে সরকারি নির্দেশের যথার্থতার বিচার ক্ষমতা না থাকলে সরকারের স্বেচ্ছাচারী নির্দেশের বলে তাদের অবৈধ কাজে বাধ্য করা হবে। আর তাই তারা আদালতের ক্ষমতা খর্বের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে প্রতিবাদে অংশ নিয়েছে।

এই প্রতিবেদনের শুরুতেই ‘আপাতত’ শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে এবং তা এই জন্যই যে নেতানিয়াহু বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণের তাঁদের প্রস্তাব বাতিল করেননি, কিছু সময়ের জন্য স্থগিত করেছেন মাত্র। মে মাসের গোড়ায় সংসদের অধিবেশন পুনরায় শুরু হলে এই প্রস্তাবকে আইনে পরিণত করার চেষ্টা আবার হবে বলেই মনে করা হচ্ছে। সরকার-বিরোধী এই আন্দোলন ইজরায়েলি সমাজের মধ্যে বিভিন্ন ধারা ও বিভাজনকেও প্রকট করে তুলেছে। ইজরায়েলি সমাজে একটা কট্টর দক্ষিণপন্থী অংশ রয়েছে যারা রাষ্ট্র পরিচালনায় ও সমাজে ইহুদি ধর্মের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় উদগ্রীব, দখলিকৃত ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ইজরায়েলি বসতি স্থাপনে সুপ্রিম কোর্টের অসম্মতিকে অবাঞ্ছিত বাধা বলে মনে করে, আদালতকে তাদের অভিপ্রেত জায়নবাদী জীবনধারার পথে এক অনাবশ্যক অন্তরায় বলে মনে করে। আবার, এর বিপরীতে উদারপন্থী গণতান্ত্রিক ধারাও রয়েছে যা উচ্চ জাতীয়তাবাদী ধারাকে প্রত্যাখ্যান করে ইজরায়েলি সমাজের ধর্মনিরপেক্ষ ও বহুত্ববাদী ধারাকে অক্ষুণ্ন রাখতে চায়। ইজরায়েলি সংসদের আসন বিন্যাসের মধ্যেও এই বিভাজন প্রতিফলিত – ১২০ সদস্য বিশিষ্ট সংসদে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর লিকুড পার্টির সদস্য সংখ্যা মাত্র ৩২, এবং অন্যান্য চরম দক্ষিণপন্থী সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে শাসক পক্ষে রয়েছে মাত্র ৬৪ জন সাংসদ, সরল সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে যা মাত্র ৩ বেশি। কোনে পক্ষেই গরিষ্ঠতা তেমন বেশি না হওয়ায় বারবারই সরকারের পতন ঘটে – গত চার বছরে জাতীয় নির্বাচন হয়েছে পাঁচ পাঁচবার! নেতানিয়াহু সরকারের প্রস্তাবকে স্থগিত করায় আন্দোলন এখনকার মতো স্তিমিত হবে। কিন্তু সেটা কি ঝড়ের আগের স্তব্ধতা হয়ে দেখা দেবে? সংসদের পরবর্তী অধিবেশনে বিচার ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাবকে আইনে পরিণত করার চেষ্টা পুনরায় হলে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন কি আবার মাথাচাড়া দেবে? সে সম্ভাবনাকে একেবারে খারিজ করা যায় না। প্রতিবাদের এক সংগঠক যেমন বলেছেন, “সাময়িকভাবে স্থগিত করাটাই যথেষ্ট নয়, এবং নেসেটে (ইজরায়েলি সংসদ) আইনটা বাতিল না হলে জাতীয় স্তরে প্রতিবাদ তীব্র হতে থাকবে।” ভারতেও আজ যখন বিচার বিভাগকে কব্জা করার ফ্যাসিবাদী প্রচেষ্টা সক্রিয় ও সচল রয়েছে, তখন ইজরায়েলের জনগণের প্রতিবাদ আন্দোলন থেকে আমাদেরও শিক্ষা নেওয়ার, অনুপ্রাণিত হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ উপস্থিত।

– জয়দীপ মিত্র

খণ্ড-30
সংখ্যা-8