প্রসঙ্গ: সত্যপাল মালিককে সিবিআই-এর নোটিশ এবং মালিকের কাছে অমিত শাহর জবাব চাওয়া
satyapal-malik

দেশব্রতীর গত সংখ্যায় আমরা করণ থাপারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জম্মু ও কাশ্মীরের শেষ রাজ্যপাল সত্যপাল মালিকের তোলা অনেক বিষয়ের মধ্যে দুটো বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। সে বিষয় দুটো ছিল – ২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামায় সিআরপিএফ জওয়ানদের ওপর সন্ত্রাসবাদী হামলায় ৪০ জনেরও বেশি জওয়ান নিহত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জম্মু ও কাশ্মীরের তৎকালীন রাজ্যপালকে সরকারের ত্রুটি সম্পর্কে “চুপ” থাকতে বলা এবং মোদীর “দুর্নীতিকে তেমন ঘৃণা না করা” সম্পর্কে মালিকের অভিমত। আমরা দাবি জানিয়েছিলাম – মোদী যেন মুখে কুলুপ এঁটে না থেকে এই সমস্ত বিষয়ের জবাব দেন। কিন্তু মোদী মুখ বন্ধ করে রাখার কৌশলের ওপরই পুনরায় আশ্রয় নিলেন, কিন্তু তাঁর হয়ে আসরে নেমে অমিত শাহ সত্যপাল মালিকের কাছে কিছু জবাব চাইলেন। সে প্রসঙ্গে আমরা পরে আসব, এখন তাঁকে সিবিআই-এর পাঠানো নোটিশের তাৎপর্য নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা।

সত্যপাল মালিক জানিয়েছেন, জম্মু ও কাশ্মীরে দুটো প্রকল্প চালু করার প্রস্তাব তাঁর কাছে রাখা হয়েছিল। সেই প্রকল্প দুটোয় দুর্নীতির গন্ধ পেয়ে দুটো প্রকল্পকেই তিনি বাতিল করে দেন। প্রকল্প দুটোর মধ্যে একটা ছিল সরকারি কর্মচারীদের স্বাস্থ্য বিমা প্রকল্প, যেটার উদ্যোক্তা ছিল অনিল আম্বানির রিলায়েন্স জেনারেল ইনসিওরেন্স কোম্পানি। আর অন্যটা ছিল ২২০০ কোটি টাকার কিরু জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, যেটা পাওয়ার জন্য মুখিয়ে ছিল বিজেপি ঘনিষ্ঠ এক কর্পোরেট সংস্থা। মালিক জানিয়েছেন, ঐ প্রকল্প দুটোর প্রত্যেকটার জন্য ১৫০ কোটি টাকা করে মোট ৩০০ কোটি টাকার ঘুষের প্রস্তাব ছিল, অর্থের যে প্রলোভনের কাছে মালিক নিজেকে বিকিয়ে দেননি।

এখানে উল্লেখ্য যে, ঐ দুটো প্রকল্পের জন্য, বিশেষভাবে অনিল আম্বানির স্বাস্থ্য বিমা প্রকল্পের জন্য মালিকের কাছে তদবির করতে গিয়েছিলেন আরএসএস ও বিজেপি নেতা রাম মাধব। প্রকল্পটা অনিল আম্বানিকে পাইয়ে দেওয়ার এতটাই স্পৃহা বিজেপি পরিচালনাধীন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের প্রশাসনের ছিল যে, প্রকল্প অনিল আম্বানি পাচ্ছেন সে সম্পর্কে একেবারেই সংশয়হীন হয়ে প্রকল্পের চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার আগেই (যেটি স্বাক্ষরিত হয় ২০১৮র ১৫ অক্টোবর) অনিল আম্বানির বিমা কোম্পানিকে ২০১৮-র ২৮ সেপ্টেম্বর চুক্তির প্রথম কিস্তি স্বরূপ ৬১.৪৩ কোটি টাকা দিয়ে দেওয়া হয়। পরে চুক্তি বাতিল হওয়ায় ঐ টাকা আম্বানির সরকারকে ফেরত দেওয়ার কথা। দুর্নীতি-দমন ব্যুরো ২০২০-র ৩০ ডিসেম্বর একটি নোট পাঠিয়ে আম্বানির কাছ থেকে ঐ টাকা পুনরুদ্ধারের কথা বলে – “সতর্ক করা এই নোটের মাধ্যমে এই পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে যে, জম্মু ও কাশ্মীর সরকার চুক্তির মতৈক্যের ধারা অনুসারে রিলায়েন্স জেনারেল ইনসিওরেন্স কোম্পানি লিমিটেড-এর কাছ থেকে বাকি ৪৪৩৯৯২৬১৮ টাকা (রিলায়েন্স সরকারি কর্মী ও পেনশন প্রাপকদের ১৭.০৩ কোটি টাকা দিয়েছে বলে জানায়) পুনরুদ্ধারের কথা বিবেচনা করতে পারে।” সত্যপাল মালিকও প্রকল্পটার মধ্যে যথেষ্ট ভ্রষ্টতার সন্ধান প্রথমে না পেয়ে তাতে অনুমোদন দিয়ে দেন। পরে প্রকল্পটার মধ্যে দুর্নীতির অস্তিত্ব টের পেয়ে সেটিকে বাতিল করেন এবং সাংবাদিকদের সামনে বলেন – “এটা ছিল কারচুপিতে ভরা”, এমনকি টেন্ডারগুলোও “গোপনে খোলা হয় একটা ছুটির দিনে যাতে বিশেষ এক কোম্পানিই সুবিধা পায়।”

সত্যপাল মালিক এই দুই প্রকল্পে দুর্নীতির প্রসঙ্গ প্রথম উত্থাপন করেন ২০২১ সালের অক্টোবরে। দুর্নীতির সেই অভিযোগ নিয়ে সিবিআই তদন্ত শুরু করে ২০২২ সালের এপ্রিলে এবং তারা এ নিয়ে দুটি এফআইআর-ও করে। সিবিআই এর আগে এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মালিককে দুবার ডেকে পাঠিয়েও ছিল। তারা আবার নোটিশ পাঠিয়েছে কিছু বিষয়ে তাঁর কাছ থেকে “স্পষ্ট হওয়ার” জন্য। লক্ষণীয় যে, এই নোটিশ এসেছে পুলওয়ামার ঘটনায় সরকারি ত্রুটি এবং দুর্নীতি নিয়ে মোদীর মনোভাব সম্পর্কে সত্যপাল মালিক মুখ খোলার পর। সিবিআই-এর এই নোটিশ পাঠানোর মধ্যে কি শাসক তথা মোদী সরকারের কোনো অভিসন্ধি আছে? সিবিআই ও ইডির হাতে বিরোধী নেতাদের ইদানীং যেমন নাকাল হতে হচ্ছে, সিবিআই-এর হাতে সেই ধরনের হেনস্তা কি মালিকের জন্যও অপেক্ষা করছে? মালিক কিন্তু সেরকমই আঁচ করেছেন – “আমি সত্য কথা বলে কিছু লোকের পাপ প্রকাশ্যে এনেছি। বোধ হয় সে কারণেই ডাক এসেছে। আমি কৃষকের ছেলে, ভয় পাব না। সত্যের পক্ষে দাঁড়াব।”

মোদী এই প্রসঙ্গে মুখ না খুললেও দল ও সরকারের দ্বিতীয় ক্ষমতাশালী ব্যক্তি অমিত শাহ বলেছেন – “প্রশাসনের অংশ হিসাবে থাকার সময় কেন তাঁর অন্তরাত্মা জেগে ওঠেনি?” তিনি আরও বলেছেন, “জনগণ এবং সাংবাদিকদের বিশ্বাসযোগ্যতার কথা বিবেচনা করতে হবে। এ সব যদি সত্যি হয়, তবে রাজ্যপাল থাকার সময় তিনি মুখ খোলেননি কেন?” অমিত শাহ অতএব জনগণ এবং সাংবাদিকদের বলছেন যে, তাঁরা যেন সত্যপাল মালিকের তোলা প্রশ্নগুলোকে বিশ্বাস না করেন। কিন্তু এখানে প্রশ্ন হল – পুলওয়ামায় সন্ত্রাসবাদী হামলার পর নরেন্দ্র মোদী মালিককে সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে “চুপ” থাকতে বলেছিলেন কি না? জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালও একই পরামর্শ সত্যপাল মালিককে দিয়েছিলেন কি না? সিআরপিএফ জওয়ানদের নিয়ে যাওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তরের কাছে বিমান চাওয়া হলে রাজনাথ সিং-এর মন্ত্রক তা দিতে অস্বীকার করেছিল কি না? নরেন্দ্র মোদীর দিক থেকে সত্য গোপনের যে অভিযোগ মালিক এনেছেন, হলফনামা দিয়ে অমিত শাহরা তাকে অস্বীকার করতে পারবেন? আর, রাজ্যপাল থাকার সময় যে কথা বলেননি বা বলতে পারেননি, এখন বললে সেগুলো কি মিথ্যা হয়ে যাবে? তবে, বাস্তব ঘটনা কিন্তু অমিত শাহর প্রশ্নের বিশ্বাসযোগ্যতা সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয় বলেই প্রতিপন্ন করছে, খন্ডন করছে রাজ্যপাল থাকাকালীন মালিকের কিছু না বলার তাঁর অভিযোগকে। দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ২৫ এপ্রিল প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন জানাচ্ছে যে, পুলওয়ামা ঘটনার পরদিনই মালিক এনডি টিভিকে ফোনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “কোনো গোয়েন্দা ব্যর্থতা ছিল না, কেননা, আমরা খবর পেয়েছিলাম (আক্রমণের সম্ভাবনা সম্পর্কে)। কিন্তু গাফিলতি অবশ্যই ছিল। সন্ত্রাসবাদীরা অত বড় একটা গাড়ি কোনো ধরনের নজরদারির মধ্যে না পড়েই আনতে পারল, সেটা অবশ্যই আমাদের দিক থেকে ব্যর্থতা ছিল।”

সত্যপাল মালিকের তোলা প্রশ্নগুলো নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর সরকারকে স্পষ্টতই বিপাকে ফেলেছে। আর অমিত শাহ মালিক উত্থাপিত প্রশ্নগুলোকে সরাসরি অস্বীকার না করে সেগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সেই বেগতিক পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেতে চাইছেন। আর, মালিকের মোকাবিলায় হয়ত বা সিবিআই-এর ওপর ভর করছেন। 

সত্যপাল মালিক গত ২২ এপ্রিল হরিয়ানা, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ ও পাঞ্জাবের কিছু কৃষক নেতাকে তাঁর বাড়িতে ডেকেছিলেন। বাড়িতে সবার জায়গা না হওয়ায় বাড়ি সংলগ্ন পার্কে দুপুরে তাঁদের খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু দিল্লী পুলিশের বিশাল বাহিনী গিয়ে তাতে বাধা দেয় এবং বলে যে, পার্কে সভার অনুমতি নেই। কৃষক নেতাদের আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সত্যপাল মালিকও রাম কৃষ্ণ পুরম থানায় পৌঁছে কৃষক নেতাদের কেন আটক করা হলো তা জানতে চান। পুলিশ শেষমেষ সবাইকে ছেড়ে দেয়। কৃষক নেতারা সেদিন গিয়েছিলেন সত্যপাল মালিকের প্রতি সমর্থন ও সংহতি জানাতে। কানডালা খাপ-এর নেতা জগৎ সিং রেধু সেদিন বলেন, "আমরা এখানে সত্যপাল মালিকের সাথে দেখা করতে এসেছি, তিনি একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুকে তুলে ধরেছেন এবং সরকারকে তার উত্তর দিতে হবে। উত্তরপ্রদেশের কৃষকরা মোদীকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, কেন্দ্র সরকার মালিকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিলে তাঁরা বিশেষ পঞ্চায়েত ডাকবেন এবং “সত্যপাল মালিকের বিরুদ্ধে নিপীড়ন বন্ধের জন্য সরকারকে হুঁশিয়ারি দেবেন, অন্যথায়, রাজ্যব্যাপী প্রতিবাদের মুখোমুখি হওয়ার জন্য সরকারকে প্রস্তুত হতে হবে।” মালিকও এর আগে বলেছিলেন, “আমার গায়ে হাত দিলে ওরা ঝামেলায় পড়বে”, কেননা, “আমার একটা শক্তিশালী সম্প্রদায় (জাট)” এবং “কৃষকদের সঙ্গে সংহতি আছে।” সত্যপাল মালিক ও তাঁর কৃষক সমর্থকরা এইভাবে জানিয়ে দিলেন যে, মোদী সরকার তাঁদের হেনস্তায় উদ্যত হলে তাঁরা মুখ বুজে তা মেনে নেবেন না। পুলওয়ামার ঘটনা ও দুর্নীতি নিয়ে মোদীর ভূমিকার যে উন্মোচন মালিক ঘটালেন, তার মধ্যে দিয়ে কি মোদী-বনাম-মালিক লড়াইয়ের একটা সূত্রপাত ঘটল?

জয়দীপ মিত্র 

খণ্ড-30
সংখ্যা-12