রামনবমী সহিংসতা: ধর্মীয় উৎসবগুলিকে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে পরিণত করে ভোটের ফসল তোলার বিজেপির চক্রান্ত রুখে দিন
communal-hate

আবারও রামনবমীর উৎসবটি রাজ্যের পর রাজ্যে মুসলিম বিরোধী সহিংসতা এবং ভাঙচুরের পরিঘটনায় পর্যবসিত হল। বিজেপি-শাসিত মহারাষ্ট্র, গুজরাট, উত্তরপ্রদেশ এবং নির্বাচনাসন্ন কর্ণাটকের পাশাপাশি বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের মতো অ-বিজেপি রাজ্যগুলি থেকে সহিংসতার বড় বড় ঘটনার খবর এসেছে। যে উৎসবগুলি শান্তি, সম্প্রীতি ও আনন্দের পরিবেশে উদযাপন করার কথা তা ক্রমবর্ধমান হারে ভাঙচুর ও সহিংসতার রঙ্গমঞ্চে পর্যবসিত হচ্ছে, মূলত ভারতের বৃহত্তম সংখ্যালঘু সম্প্রদায় মুসলমান জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে নিশানা করে।

গত বছর রামনবমী এবং হনুমান জয়ন্তীতে ব্যাপক সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিক সমাজ ও আইনজীবীদের একটি সমষ্টি অত্যন্ত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে হিংসার প্যাটার্নটা অধ্যয়ন করেছিল এবং “রামনবমী ও হনুমান জয়ন্তীর সময় সাম্প্রদায়িক সহিংসতা — জিঘাংসার শেকড় — ধর্মীয় শোভাযাত্রাকে হাতিয়ার বানানো (এপ্রিল ২০২২)” শিরোনামে ১৭৬ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিল। কোথাও কোথাও প্রশাসনিক যোগসাজশের নির্লজ্জ কিছু উদাহরণ বাদে এই প্রতিবেদনে সবচেয়ে সাধারণ যে প্রশাসনিক ত্রুটিকে এরকম সহিংস ঘটনা ঘটার সাধারণ সহযোগ প্রদায়ি হিসেবে চিহ্নিত করে তা হল মসজিদের কাছাকাছি এবং প্রধানত মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার মধ্যে দিয়ে তরোয়াল উঁচিয়ে ঘৃণাপূর্ণ শ্লোগান, গান ও ভাষণসহ রামনবমী মিছিল করার অনুমতি দেওয়া। প্যাটার্নটি এই বছর আবারও কার্যকর হতে দেখা গেল, এবং আরও ব্যাপকভাবে, রামনবমীকে বেশ কয়েক দিনব্যাপী প্রলম্বিত উৎসবে পরিণত করার অনুমোদনের মাধ্যমে। বিহারশরিফে (নালন্দা, বিহার) আজিজিয়া মাদ্রাসা ও লাইব্রেরির মর্মান্তিক ধ্বংসসাধন এবং রিষড়ার (হুগলি জেলা, পশ্চিমবঙ্গ) সহিংসতার মতো ভাঙচুর ও সহিংসতার বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে বাস্তবে রামনবমী শেষ হয়ে যাওয়ার পরে।

আজিজিয়া মাদ্রাসা ও লাইব্রেরিকে টার্গেট করে ধ্বংস করার বিষয়টি বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে। ১১০ বছরের পুরোনো মাদ্রাসাটি পাটনার প্রবাদপ্রতীম খুদা বকশ লাইব্রেরির পরেই সবচেয়ে সমৃদ্ধ একটি লাইব্রেরি ছিল। অনেক দুর্লভ বই সহ লাইব্রেরির ৪,৫০০ প্রাচীন গ্রন্থের সমগ্র সংগ্রহটি ভস্মীভূত হয়ে গেছে। বিখ্যাত সমাজসেবী ও শিক্ষাবিদ বিবি সোঘরা তাঁর স্বামী মৌলভী আব্দুল আজিজের স্মরণে এই মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আজিজ ১৮৫৭ সালের সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদানের জন্য তাঁর সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পাশাপাশি এটি একটি মডেল মাদ্রাসা হিসাবেও সমুজ্জ্বল ছিল যেখানে পাঁচ শতাধিক ছেলে ও মেয়েকে আধুনিক শিক্ষা প্রদান করা হয়। মাদ্রাসাগুলিকে সন্ত্রাসী প্রশিক্ষণের জায়গা হিসাবে কলঙ্কলেপন সংঘ ব্রিগেডের ইসলামফোবিক প্রচারের কেন্দ্রে আছে এবং আজিজিয়া মাদ্রাসার ধ্বংস এই মাদ্রাসা-বিরোধী প্রচারকে একটি নতুন স্তরে নিয়ে গেল।

ধর্মীয় উৎসবের ক্রমবর্ধমান সশস্ত্রকরণ ভারতে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী উন্মত্ততা ও আগ্রাসনের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। সব রকম উপায়ে এই নকশা বানচাল করা প্রয়োজন। আইনের শাসনের সাংবিধানিক কাঠামোকে ফ্যাসিবাদী সহিংসতার সক্রিয় যন্ত্রে পরিণত হওয়া থেকে বাঁচাতে হবে। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের এই বিষাক্ত বিস্তারকে মোকাবেলা করার জন্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যুক্তি ও সম্প্রীতির কণ্ঠকে প্রসারিত করতে হবে আমাদের। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, এই ফ্যাসিবাদী ছককে পরাস্ত করতে এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের সাংবিধানিক দিশাকে অবিচল রাখতে জনপ্রিয় রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সংকল্প জাগ্রত করতে হবে।

অনেক বছর আগে বিপ্লবী কবি গোরখ পাণ্ডে ভবিষ্যদ্বাণীর মতো এই লাইনগুলি লিখেছিলেন: ইস বার দাঙ্গা বহুৎ বড়া থা/খুব হুই থি/ খুন কি বারিশ/আগলে সাল আচ্ছি হোগি/ফসল/ মতদান কি (এবার দাঙ্গা বেশ ভালো হয়েছে/ অনেক রক্ত ঝড়েছে বৃষ্টির মতো/আগামী বছরটা খুব ভালো যাবে/বাম্পার ফলন হবে ভোটে)। আমরা সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় বারংবার এটা ঘটতে দেখেছি। গুজরাটে ২০০২ সালের গণহত্যা বিজেপি-র জন্য ধারাবাহিক নির্বাচনী জয়ের ভিত্তিভূমিতে পরিণত হয়েছে। এমনকি বিশ বছর পরেও অমিত শাহ সাম্প্রতিক গুজরাট নির্বাচনে সেই গণহত্যাকে ‘দাঙ্গাকারীদের জন্য একটি উপযুক্ত শিক্ষা, স্থায়ী শান্তির চাবিকাঠি’ হিসাবে আবাহন করেছিলেন। ২০১৩ সালের মুজাফফরনগর হত্যা ২০১৪ সালে উত্তরপ্রদেশে বিজেপির নজরকাড়া নির্বাচনী প্রদর্শনের পথ পাকা করেছিল।

এই বছরের রামনবমী সহিংসতার পিছনে বিজেপির নির্বাচনী ছককে ভেঙে বোঝার জন্য যদি আমাদের কোনও সূত্রের প্রয়োজন হয় তবে তা অমিত শাহ-ই সবচেয়ে স্পষ্টভাবে সরবরাহ করে দিয়েছেন। বিহারশরিফে সহিংসতার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে (অন্যান্য বেশ কয়েকটি জায়গায় সহিংসতা ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা সতর্ক নাগরিকদের প্রচেষ্টায় ব্যর্থ করা সম্ভব হয়) অমিত শাহ নিকটবর্তী নওয়াদা জেলায় একটি সভা থেকে গলা উঁচিয়ে নির্বাচনী আহ্বান জারি করেন: ‘২০২৪এ ৪০টা লোকসভা আসনের সবক’টা আমাদের দিয়ে মোদীজিকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনুন আর ২০২৫ এর বিধানসভা নির্বাচনে আমাদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিন, আমরা সমস্ত দাঙ্গাবাজদের উল্টো করে ঝুলিয়ে দেব!’ বিহার সম্ভবত এত স্পষ্টভাবে গণহত্যার হুমকি এবং এরকম সরাসরি সাম্প্রদায়িক হিংস্রতার ভিত্তিতে ভোটের আহ্বান আগে কখনও শোনেনি। বিহার ১৯৯০ সালে আডবানির দাঙ্গারথ থামিয়ে দিয়েছিল, ২০০৪ সালের ভোটে বিহার নির্ধারকভাবে ভোট দিয়েছিল ২০০২ গুজরাট গণহত্যার পর কেন্দ্রে আসীন বিজেপি সরকারকে পরাজিত করার জন্য, সম্প্রতি ২০২০ সালের বিধানসভা নির্বাচনে দক্ষিণ বিহার সিপিআই(এমএল) এবং তার জোটের অংশীদার আরজেডিকে অপ্রতিরোধ্যভাবে ভোট দেয় এবং সামন্তসাম্প্রদায়িক সহিংসতার রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করে। সংঘ-বিজেপির সাম্প্রদায়িক-ফ্যাসিস্ট আগ্রাসনের অভিযানকে পর্যুদস্ত করতে বিহারের এই সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী উত্তরাধিকারকে আবার জোরদার করতে হবে এবং “গণতন্ত্র বাঁচাও, ভারত বাঁচাও” অভিযান এগিয়ে নিয়ে যেতে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে।

(এমএল আপডেট সম্পাদকীয় ৪ এপ্রিল ২০২৩)

খণ্ড-30
সংখ্যা-9