কেন্দ্রীয় কয়লা মন্ত্রক ও আদানির অবৈধ আঁতাত ফাঁস হল
illegal-collusion

আরও একটা কেলেঙ্কারির ঘটনা ফাঁস হয়ে গেল। আদানির সাথে ভারত সরকারের গভীর আঁতাতের আরও একটি তথ্য প্রকাশ করল স্ক্রোল ডট ইন, দ্য ওয়্যার, বিজনেস টুডে সহ বেশ কিছু সংবাদমাধ্যম।

ভারত সরকারের তরফ থেকে কয়লা নিলাম কান্ডে আদানির হাতে তুলে দেওয়া হলো চার চারটে কয়লা ব্লক, একেবারে জলের দরে! এর মধ্যে মহারাষ্ট্রের উত্তর পশ্চিম মাধেরিতে কয়লা ব্লকের নিলাম প্রক্রিয়ায় মাত্র একজন “প্রতিযোগী” ছিল — ক্যাভিল মাইনিং প্রাইভেট লিমিটেড। আর তাকে শিখন্ডি হিসাবে সামনে রেখে আদানি পকেটে পুরে নিল পশ্চিম মাধেরির কয়লা খনি, একেবারে জলের দরে।

কে এই ক্যাভিল মাইনিং প্রাইভেট লিমিটেড?

এরা হল এডিকর্প এন্টারপ্রাইজের প্রধান প্রোমোটার, হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট দেখিয়েছে, এই ছোট্ট ব্যক্তি মালিকানাধীন সংস্থাটিকে আদানি ব্যবহার করত নিজের সংস্থাগুলোতে মূলধন পাচার করার কাজে।

বিভিন্ন নথি থেকে দেখা গেছে, এই ক্যাভিল মাইনিং আর এডিকর্প-এর ঠিকানা একই, আমেদাবাদে। আর, উভয়ের প্রোমোটার একজনই — যার নাম উৎকর্ষ শাহ। এই ব্যক্তি হলেন গৌতম আদানির বিশেষ বন্ধু। দীর্ঘদিন এদের বন্ধুত্ব ছিল গলায় গলায়।

ক্যাভিল মাইনিং খুবই এক আনকোরা গোছের সংস্থা, যার নেই কয়লা খনি সংক্রান্ত ছিঁটে ফোটা অভিজ্ঞতা। এই সংস্থাটি আদানি-র এমএইচ ন্যাচারাল রিসোর্স প্রাইভেট লিমিটেডএর সাথে মহারাষ্ট্রের চন্দ্রপুরের ২০০ মিলিয়ন কয়লা ব্লকের জন্য নিলাম প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়!!

ক্যাভিল মাইনিংকে আসরে নামানো হয় এই কারণে, যাতে উত্তর পশ্চিম মাধেরির কয়লা ব্লকের নিলাম প্রক্রিয়াটি ভেস্তে না যায়। নিয়ম হল, নিলাম প্রক্রিয়ায় একমাত্র আদানি থাকলে সেই প্রক্রিয়াটি বাতিল করা হোত। কেন্দ্রীয় কয়লা মন্ত্রকের নিয়মানুযায়ী, একদম প্রথম দিকে অন্তত পক্ষে যদি দু’টো সংস্থা নিলাম প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়, তবেই বাণিজ্যিক কয়লা ব্লকের নিলাম প্রক্রিয়া শুরু করা যাবে।

এ নিয়ে অতীতে কয়লা ব্লক নিলামের প্রক্রিয়াটি যে ভাবে হয়, তাতে ক্যাগ (কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটার জেনারেল) রীতিমতো উদ্বেগ প্রকাশ করে জানায়, “নিলামে অংশগ্রহণকারীরা নিজেদের মধ্যে একটা বোঝাপড়া করে এই প্রক্রিয়ায় অংশ নিচ্ছে প্রতিযোগিতার রাস্তাকে এড়াতে।” ২০১৫ তে প্রথম দু’টো কয়লা ব্লকের নিলাম প্রক্রিয়ার অডিট রিপোর্টে ক্যাগ জানায়, নিজেদেরই একাধিক সাবসিয়াডিরিকে নিলামে সামিল করিয়ে প্রতিযোগিতার রাস্তা বন্ধ করার পাশাপাশি বিক্রয় মূল্যকে অনেক নীচে নামিয়ে আনা হচ্ছে। এর ফলে বিরাট অপচয় ও লোকসান হচ্ছে জাতীয় সম্পদের। পরবর্তীতে, কয়লা মন্ত্রক নিলামের নিয়ম কানুনের ফাঁক ফোকরগুলোকে বন্ধ করতে সাবসিডিয়ারি ও জয়েন্ট ভেঞ্চারগুলোকে অখন্ড অংশগ্রহণকারী হিসাবে গণ্য করতে শুরু করে।

কিন্তু, ২০২১ এর পর থেকে কয়লা মন্ত্রক মনে করতে শুরু করল যে কয়লার নিলাম প্রক্রিয়ায় তেমন খরিদ্দার খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এমন অনেক কয়লা খনির নিলাম প্রক্রিয়ায় একটাও নাকি খরিদ্দার পাওয়া যায়নি। এর পর কয়লা মন্ত্রক সিদ্ধান্ত নেয়, তিনটের বদলে দু’টো সংস্থা নিলাম প্রক্রিয়ায় অংশ নিলে তা শুরু করা যাবে। যদিও বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্ট ভিন্ন সুপারিশ করে। বিশেষজ্ঞ কমিটি জানায়, প্রথম পর্বে তিনের কম যোগ্য অংশগ্রহণকারী থাকলে গোটা নিলাম প্রক্রিয়াকেই বাতিল করতে হবে।

দেখা গেল, কয়লা ব্লক নিলামের প্রক্রিয়ায় তেমন সাড়া না পাওয়া গেলেও ২০২২-এর নভেম্বরে কেন্দ্রীয় কয়লা মন্ত্রক ১৪১টা কয়লা খনি নিলামের সিদ্ধান্ত নিল — যা ছিল এ যাবতকালে বৃহত্তম বাণিজ্যিক কয়লা ব্লক নিলামের ঘটনা।

কিন্তু দেখা গেল, ৩৬টি কয়লা ব্লকের জন্য মাত্র ৯৬টি সংস্থা নিলামে অংশ নিয়ে দর হাঁকল, অর্থাৎ একটা খনি পিছু তিনজন নিলামদার। ৯ মার্চযখন গোটা নিলাম প্রক্রিয়া শেষ হল তখন দেখা গেল মাত্র ২৯টি খনির সফলভাবে নিলাম হয়েছে। একসাথে অনেকগুলো কয়লা খনি একসঙ্গে নিলামে তুলে দেওয়ার এই যৌক্তিকতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। কারণ, এর ফলে প্রতিযোগিতা মার খায়।

ক্যাভিল মাইনিং যে আদানি-র এক ছায়া সংস্থা তার অনেক প্রমাণ মিলেছে। কেন্দ্রীয় কর্পোরেট মন্ত্রকের কাছে যে নথি রয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে ২৪ এপ্রিল, ২০২২-এ এই সংস্থাটি আমেদাবাদে নথিভুক্ত হয়। এই সংস্থার ৮০ শতাংশ মূলধন এসেছে উৎকর্ষ শাহ-র কাছ থেকে, যা তাঁকে ওই সংস্থার নিয়ন্ত্রক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে। এই উৎকর্ষ শাহ এডিকর্প-এর ৮০ শতাংশ শেয়ার নিয়ন্ত্রণ করে। তিনি মারা যাবার আগে পর্যন্ত এডি-হেরিটেজ গ্রুপের কর্ণধার ছিলেন। আর, এই সংস্থার ওয়েবসাইটে বলাই আছে যে “এটি বিশ্বাসযোগ্য এক রিয়াল এস্টেট ডেভেলপর”। পিতার মৃত্যুর পর তার পুত্র আদর্শ শাহ এডিকর্প ও ক্যাভিল-এর কর্ণধার হন। এডিকর্প ও ক্যাভিল একই পরিবারের দু’টি সংস্থা। ইকনমিক টাইমস্-কে দেওয়া ২০১৩’র এক সাক্ষাৎকারে গৌতম আদানি উৎকর্ষ শাহ-কে “বিগত ৩০ বছরের বন্ধু” হিসাবে বর্ণনা করেন।

যতদিন যাচ্ছে, ততই নতুন নতুন কেলেঙ্কারির ঘটনা সামনে আসছে। মোদী সরকারের সাথে আদানি-র যোগসাজশের নানা তথ্য দেখিয়ে দেয় সমস্ত দিক থেকে এই শিল্প গোষ্ঠীকে সরকার সমস্ত দিক দিয়ে মদত দিয়েছিল।

- অতনু চক্রবর্তী

খণ্ড-30
সংখ্যা-10