হ্যারি বেলাফন্টে স্মরণে
harry-belafonte

সেটা ১৯৫৬ সাল। ক্যালিপসো নামের একটা গানের অ্যালবাম বেরোল মার্কিন দুনিয়ায়। এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণের গাওয়া কয়েকটা লোকগানের সংকলন। সেখানে একটা গান ছিল যার নাম জামাইকা ফেয়ারওয়েল আর একটা ছিল ডে ও বা ব্যানানা বোট সঙ। প্রকাশের পর পরই উঠল বিপুল আলোড়ন। মার্কিন দুনিয়া থেকে গোটা বিশ্ব মেতে উঠল সেই গানের সুরে কথায় গায়কীতে। গানের ইতিহাসের সর্বকালের সেরা এক শিল্পীর আসন পাকা হয়ে গেল চিরদিনের মতো। সেই মানুষটি, বিশ্বের অগণিত শ্রোতার প্রাণের শিল্পী হ্যারি বেলাফন্টে চলে গেলেন ২৫ এপ্রিল, ৯৬ বছর বয়েসে। তারপর থেকেই কলকাতা থেকে ক্যালিফোর্নিয়া, মস্কো থেকে মেলবোর্ন – গোটা বিশ্বেই তাঁকে নিয়ে স্মরণ, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার বান ডেকেছে বিভিন্ন সমাজ মাধ্যমে।

হ্যারি বেলাফন্টে নিঃসন্দেহে লোকগানের এক কিংবদন্তী শিল্পী। কিন্তু মনভোলানো গান গাওয়ার মধ্যেই কেবল তিনি নিজেকে তিনি সীমাবদ্ধ রাখতে চান নি। কালো মানুষদের অধিকার আন্দোলন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন নাগরিক আন্দোলনের সামনের সারির এক মানুষ ছিলেন তিনি। এই সব আন্দোলনের সূত্রেই বর্ণভেদ বিরোধী লড়াইয়ের মহানায়ক মার্টিন লুথার কিং (জুনিয়ার) এর বন্ধু ও সহযোদ্ধা হিসেবে তাঁর আর এক অন্য পরিচিতি রয়েছে। তুমুল জনপ্রিয় এই লোকগায়ককে মার্কিন রাষ্ট্র তাই নজরদারির আঁতশকাঁচের তলায় রেখেছিল বরাবর। সেটা অবশ্য হ্যারি বেলাফন্টের প্রতিবাদী সত্তাকে ভয় দেখিয়ে সীমিত করতে পারেনি। পল রোবসন, পিট সিগার, বব ডিলান, জোন বয়েজদের মতোন তিনিও গান আর প্রতিবাদকে বরাবর মিশিয়েছিলেন।

১৯২৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম হলেও বেলাফন্টে ছেলেবেলাতেই চলে গিয়েছিলেন তাঁর পিতৃপুরুষের দেশ জামাইকায়। ১৯৩২ থেকে ১৯৪০ সাল অবধি সেখানেই ছিলেন তিনি। তারপর আবার মার্কিন দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু জামাইকার সুর, জীবনছন্দ আর অভিজ্ঞতা তাঁকে যেমন গড়েছিল তেমনি সারাজীবনের সৃষ্টির প্রেরণা হয়ে থেকেছিল। হ্যারি বেলাফন্টে অভিনয়ও করেছেন। নানা সিনেমায় অভিনয়ের সূত্র ধরে তাঁর শিল্পীসত্তার অন্য এক মাত্রাও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। তবে লোকগানের শিল্পী হিসেবেই তিনি অমর হয়ে থাকবেন।

বেলাফন্টের গানে প্রেম আর প্রতিবাদ হাত ধরাধরি করে থাকে। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত গান দুটির কথাই মনে করা যাক। জামাইকা ফেয়ারওয়েল যদি সে দেশে রেখে আসা এক মিষ্টি মেয়ের স্মৃতি ভালোবাসায় নিবেদিত হয় তাহলে আর এক বিখ্যাত গান ব্যানানা বোট সঙ ধরতে চেয়েছে কলা শ্রমিকদের কষ্টকর জীবন আর লড়াইকে। লাতিন আমেরিকা জুড়ে তখন বহুজাতিক দৈত্যকায় কৃষি ব্যবসায়ীদের রাজত্ব চলছে। ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানি শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রই নয়, বকলমে নানা দেশের রাজনীতিকেও নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। একের পর এক দেশে স্বৈরশাসকদের তারা ক্ষমতায় বসাচ্ছে, নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর বিরুদ্ধে মিলিটারি ক্যু-এর চক্রান্ত করছে। লাতিন আমেরিকা থেকে প্রথম কথাসাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাবেন যিনি, সেই আস্তুরিয়াস তাই লিখবেন ব্যানানা ট্রিলজি নামে পরিচিত তিন পর্বের উপন্যাস আর লাতিন আমেরিকার কলা কোম্পানিগুলির নিয়ন্ত্রণে থাকা শাসন প্রণালীর দৌলতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় ঢুকে পড়বে ব্যানানা রিপাবলিক নামটি। এই প্রেক্ষাপটেই আমাদের দেখতে হয় কলা শ্রমিকদের নিয়ে লেখা ব্যানানা বোট সঙের মতো গানকে। দীর্ঘ সময় ধরে কলা শ্রমিকেরা কাজ করেছে কলা বাগানে। ছ ফুট, সাত ফুট, আট ফুটের বিশাল বিশাল কলার কাঁদি কেটেছে তারা। সেখানে লুকিয়ে থাকা ভয়ংকর বিষাক্ত মাকড়সা টারান্টুলার হাত থেকে রক্ষা পাবার চেষ্টা চালাতে হয়েছে। এখন তারা ক্লান্ত। যে কোম্পানীর শ্রমিক তারা, তার গুণতিকারী কর্মীকে কাজের হিসাব বুঝিয়ে দিয়ে তবেই তারা ঘরে ফিরতে পারবে। তাই তাকে বারবার ডাকছে তারা। এই গানে কথার পাশাপাশি সুরের মধ্যেও বেলাফন্টে নিয়ে আসতে পারেন শ্রমের আবহকে। অন্যদিকে জামাইকায় ফেলে আসা মেয়েটির স্মৃতি নিয়ে লেখা বিখ্যাত গানটির সুরে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের আবহাওয়া আর প্রকৃতি নিবিড়ভাবে জড়িয়ে যায় আর এইভাবেই এই গানগুলি হয়ে ওঠে প্রকৃত লোকগান।

সৌভিক ঘোষাল

খণ্ড-30
সংখ্যা-12