সংকটে মোদী-আদানি মডেল: মোদী সরকারকে আদানি কেলেঙ্কারির পিছনে থাকা অপরাধীদের নাম প্রকাশ করে শাস্তি দিতে হবে
modi-adani-model-in-crisis_0

হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট যে বোমাগুচ্ছ গত ২৪ জানুয়ারি ফাটালো তা শুধু নির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হেনে তাকে ঘায়েল করেই থেমে যায়নি, সেই প্রতিঘাতে আরও অনেকে মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে — যার মধ্যে রয়েছে বেশ কিছু ব্যবসায়ী সংস্থা আর শেয়ার বাজারের ছোটোখাটো খেলোয়াড়দের — এবং তা বিনিয়োগ ও রাজনীতি উভয় ক্ষেত্রেই একেবারে ঝড় বইয়ে দিয়েছে।

হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট যে প্রধানতম বিষয়টিকে উদ্ঘাটন করলে তা হচ্ছে, বিশ্বে কর ছাড়ের স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত দেশগুলিতে অবস্থিত নির্দিষ্ট কিছু কোম্পানি শুধুমাত্র আদানি গোষ্ঠীর স্টকে বিনিয়োগ করছে। আর দেখা যাচ্ছে যে এইসব কোম্পানিগুলোর টিঁকি বাঁধা আছে বা শেষ নিয়ন্ত্রণের দড়িটা ধরা আছে গৌতম আদানির দাদা বিনোদ আদানির হাতে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, এইসব বিনিয়োগ ভারতের শেয়ার আইন লঙ্ঘন করেছে চোরা পথে[১] , বিনিয়োগ করা হয়েছে কিছু “সম্পর্কিত পার্টির” মাধ্যমে। কোম্পানির নিজস্ব শেয়ার হোল্ডারদের বাইরের শেয়ারের পরিমাণ কমপক্ষে ২৫ শতাংশ রাখার বিধি ওরা এইভাবে লঙ্ঘন করে। কর-স্বর্গের ‘শেল কোম্পানিগুলোর’[২] মধ্যে শেয়ার লেনদেন — যা ‘রাউন্ড ট্রিপিং’[৩] নামে পরিচিত — আদানি গোষ্ঠীর তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মূল্য নির্ধারণকে কৃত্রিমভাবে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেয়। এছাড়া, সম্পদভিত্তির মাত্রাতিরিক্ত মূল্যায়ন জাহির করে আদানি গোষ্ঠী নিজেদের বিশ্বের অন্যতম ধনী, সবচেয়ে দ্রুত বাড়তে থাকা, এবং তাই স্পষ্টতই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যবসায়ী গোষ্ঠী হিসাবে তুলে ধরে শুধু ভারতে নয়, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ইজরায়েল ও অস্ট্রেলিয়ায় বহুসংখ্যক পরিকাঠামো নির্মাণের বরাত কুক্ষিগত করে। এরই পাশাপাশি, অত্যধিক দাম চড়ানো শেয়ারগুলোকে বন্ধক রেখে তারা ভারতীয় এবং বিদেশী ঋণদাতাদের কাছ থেকে অনেক বেশি পরিমাণে ঋণ পেতেও সমর্থ হয়, শেয়ারমূল্য কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে না দেখালে যে ঋণ পাওয়া সম্ভব হতো না।

এইভাবেই গড়ে উঠেছিল ভারতের ইতিহাসের সর্ববৃহৎ কর্পোরেট সাম্রাজ্যটি। ভারতের দোর্দণ্ড প্রতাপ রাজনীতিবিদ ব্যক্তিটির সাথে হাত মিলিয়ে লুকোছাপা আর জালিয়াতি ভরা, ভ্রষ্ট এই ব্যবসায়ী মডেলটির মধ্যে যে বিরাট ঝুঁকি ও টানাপোরেন নিহিত ছিল তা আজ হোক বা কাল বিস্ফোরণে ফেটে পড়তই, হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট দূর থেকে এই ডিনামাইট বাক্সের ডিটোনেটরের কাজটা করে দিল।

রিপোর্ট প্রকাশ হতে না হতেই মুহুর্তে শেয়ার বাজারে আদানি গোষ্ঠী মুখ থুবড়ে পড়ল, কোম্পানিগুলোর শেয়ার মূল্যে ধ্বস নামল। হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার ঠিক আগে আদানি গোষ্ঠীর সম্পদের মূল্যায়ন ১০ লক্ষ কোটি টাকা পেরিয়ে গিয়েছিল; এখন তা কমে এসেছে ৩ লক্ষ কোটি টাকারও নীচে। এর ফলে ফোর্বসের ধনী তালিকায় থাকা সর্বোচ্চ ২০ জন ধনীর মধ্যে থেকে আদানি ছিটকে গেছেন, যে তালিকায় একসময় তাঁর স্থান ছিল বিশ্বের মধ্যে তিন নম্বরে এবং এশিয়ার মধ্যে প্রথম স্থানে। আদানি গোষ্ঠীর অগ্ৰগণ্য কোম্পানি আদানি এন্টারপ্রাইজেসকে ‘ফলো-অন পাবলিক অফার’ বা এফপিওর মাধ্যমে তোলা (এফপিও হল স্টক এক্সচেঞ্জে নথিভুক্ত কোম্পানির দ্বারা অতিরিক্ত শেয়ার বাজারে ছাড়া) ২০,০০০ কোটি টাকা ফিরিয়ে দিতে হয়, এবং তা সম্ভবত এফপিওর প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের চাপে। বিদেশে আদানির কয়েকটা প্রকল্প হয় বাতিল হয়ে গেছে অথবা আটকে রয়েছে। ঋণের কিছু অংশ নির্ধারিত সময়ের আগেই শোধ করা-সহ সংকট সামাল দেওয়ার কয়েকটি পদক্ষেপ, এবং এলআইসি, ব্যাঙ্ক অব বরোদার মতো রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের সংস্থাগুলোর সহায়তা এবং হয়ত বা তাঁর কিছু ব্যবসায়ীক যোগাযোগ এবং শক্তিশালী রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকদের সহায়তায় কয়েকটা কোম্পানির শেয়ার মূল্যে কিছুটা পুনরুদ্ধার ঘটে, তবে সেগুলো এখনও নড়বড়ে অবস্থাতেই রয়েছে।

হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট এই অভিযোগে মোদী সরকারকেও কাঠগড়ায় তোলে যে, কারচুপির কদর্য এই কৌশল “সক্ষম হতে পেরেছে লগ্নি সংক্রান্ত নজরদারি কার্যত অস্তিত্বহীন থাকার জন্য।” রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, “তাঁর বিরুদ্ধে যারা প্রশ্ন তুলছে তাঁদের তাড়া করার জন্য আদানি তাঁর বিপুল ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে সরকার এবং নিয়ন্ত্রকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন”, আর তাই সাংবাদিক, নাগরিক এবং এমনকি রাজনীতিবিদরাও “প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপের ভয়ে মুখ খুলতে ভয় পেতেন”।

হিন্ডেনবার্গ এইভাবে প্রশংসনীয় পেশাদারি দক্ষতায় আর্থিক অপরাধে সরাসরি যুক্ত অতিবৃহৎ কর্পোরেট এবং তার রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক তথা দোসর ও সহযোগী — উভয়কেই ধাক্কা দিতে পেরেছে। ধুরন্ধর মোদী অবশ্য আমেরিকার এই সংস্থাটির বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি (তিনি জানতেন যে সেটা করলে অকাট্য অভিযোগগুলোর দিকেই জনগণের দৃষ্টি আরও আকৃষ্ট হবে), কিন্তু সংসদের ভিতরে ও বাইরে তিনি বিরোধীপক্ষের প্রতি ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ চালিয়ে গেছেন, বলাই বাহুল্য তা নজর ঘোরানোর কৌশল।

লড়াইটা শুরু হল

আদানির কাছে কোনো বিকল্প ছিল না, কেননা লগ্নিকারীদের বাজিয়ে দেখা ও আশ্বস্ত করার প্রয়োজন তাঁর ছিল। এই ক্ষেত্রে, সাফাই দেওয়ার মুখ যখন আর নাই তখন পাল্টা আক্রমণই একমাত্র প্রতিরক্ষা। আর তাই উদ্ধত আদানি দেরি না করে ৪৩৭ পৃষ্ঠার এক রোষকষায়িত প্রত্যুত্তর পাঠালেন (কলেবরে যা হিন্ডেনবার্গের সংক্ষিপ্ত রিপোর্টটির চার গুণেরও বেশি) যাতে যথারীতি ওদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্ৰহণের আদানি মার্কা হুমকিও রইল। মার্কিন মুলুকের চ্যালেঞ্জারের কাছ থেকে সঙ্গে সঙ্গেই এল মুখের মতো জবাব : “আমরা রিপোর্টপেশ করার ৩৬ ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরও আদানি আমাদের তোলা মৌলিক ইস্যুগুলোর একটারও জবাব দেননি। এর বিপরীতে প্রত্যাশিতভাবেই আদানি হম্বিতম্বি ও হুমকির আশ্রয় নিয়েছেন।… আমাদের ১০৬ পাতার, ৩২,০০০ শব্দের রিপোর্টকে — যেখানে ৭২০টা উদ্ধৃতি রয়েছে এবং যা দু-বছর ধরে তৈরি হয়েছে — আদানি “গবেষণালব্ধ নয়” বলে উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন যে তাঁরা আমাদের বিরুদ্ধে প্রতিকারমূলক ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমেরিকার ও ভারতের আইনের প্রাসঙ্গিক বিধানগুলো খতিয়ে দেখছেন।… আমরা এটাকে স্বাগত জানাই।… আদানি যদি সত্যিই আন্তরিক হন তবে তাঁকে আমেরিকাতেও মামলা করতে হবে যেখান থেকে আমরা কাজ চালাই। প্রয়োজনীয় নথিপত্রের একটা লম্বা তালিকা আমাদের কাছে আছে যেগুলো আমরা আইনি উদঘাটন প্রক্রিয়া চললে দাবি করতে পারব।” (নজরটান আমাদের)

স্পষ্টতই এক দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান। কিন্তু তা গ্ৰহণ করে মামলা দায়ের করতে এগিয়ে যাওয়ার হিম্মত আদানি দেখাতে পারেননি, যদিও রবি নায়ার ও পরঞ্জয় গুহঠাকুরতার মতো সত্যনিষ্ঠ কর্মী-সাংবাদিক এবং ইপিডব্লিউ ও দ্য ওয়্যার-এর মতো পত্রিকার বিরুদ্ধে আদানি নিয়মিতভাবেই তা করে থাকে, লম্বা সময় ধরে টেনে নিয়ে যাওয়া, অনেকগুলো শহরে ছড়ানো, ব্যয়বহুল আইনি লড়াই লড়ার মতো প্রতিপত্তি ও আর্থিক ক্ষমতা যাদের নেই তাদের বিরুদ্ধে। মামলাবাজ, বিদ্বেষপরায়ণ ধনকুবেরটি বুঝলেন যে, এবার তিনি প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়েছেন। কাজেই, গুজরাটের সিংহরাজ তৎক্ষণাৎ লেজ গুটিয়ে মেকি দেশপ্রেমের আশ্রয় নিলেন। তাঁর গুরুর অনুসরণে তিনি রিপোর্টটাকে ‘ভারতের ওপর এক সুপরিকল্পিত আক্রমণ’ এবং ‘ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা, সততা ও গুণমানের’ ওপরও আক্রমণ বলে অভিহিত করে জনমানসে এক তীব্র প্রতিক্রিয়া উস্কিয়ে তোলার চেষ্টা করলেন। সেই কবে ১৭৭৫ সালে স্যামুয়েল জনসনের করা সেই বিখ্যাত উক্তিটি আছেনা, সংকীর্ণদেশপ্রেম হল “দুর্জনদের শেষ আশ্রয়”।

এই ঐকতানে গলা মেলানোর জন্য মোদীভক্তদের এবং আদানি অনুগতদের তড়িঘড়ি সমাবেশিত করা হল। “ভারত আদানির পাশে দাঁড়াচ্ছে” এবং “ভারতের আইএনসিএস আদানিকে সমর্থন করছে” হ্যাশট্যাগ সমাজমাধ্যমে ট্রেণ্ডিং করতে উঠে পড়ে লেগে গেল। তবে, বিশ্বাসযোগ্য কোনও ছাপা কি ডিজিটাল মিডিয়ায় এই ব্যবসায়ী গোষ্ঠীটির সমর্থনে তাৎপর্যপূর্ণ কোনো লেখাপত্তর আসতে দেখা গেল না। বিপরীতে, খ্যাতনামা পত্রিকা এবং ডিজিটাল মঞ্চগুলোয় একের পর এক নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হতে লাগল যেগুলোতে হিন্ডেনবার্গ-এর উন্মোচনের সত্যতা প্রতিপাদিত হল, ঐ উন্মোচনকে আরো বিস্তৃত করা হল এবং বেশ কিছু দীর্ঘমেয়াদী সিদ্ধান্তও টানা হল।

নিরপেক্ষ বিশ্লেষকরা যা বলেছেন

ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল হিন্ডেনবার্গ-এর কিছু দাবিকে স্বতন্ত্রভাবে সমর্থন করে। তারা ট্রাস্টলিঙ্ক ইন্টারন্যাশনাল নামে মরিশাসস্থিত একটা কোম্পানির সঙ্গে বিনোদ আদানির যোগ দেখতে পায়। এই কোম্পানিটা আবার মরিশাসের আরো দুটো কোম্পানিকে নিজের অন্তর্ভুক্ত করে। ব্লুমবার্গও জানায় যে, বিনোদ আদানি ও তাঁর স্ত্রী রঞ্জনাবেন আদানি ‘এন্ডিভার ট্রেড এন্ড ইনভেস্টমেন্ট’ সংস্থার মূল সুবিধা প্রাপক মালিক হিসাবে তালিকাভুক্ত। মরিশাসের এই কোম্পানিটাকে আদানি গোষ্ঠী এর আগে ব্যবহার করেছিল সুইজারল্যান্ডের হলসিমএর কাছ থেকে অম্বুজা সিমেন্টস ও এসিসি-কে অধিগ্ৰহণ করতে। এরপর ফোর্বস প্রকাশিত এক নিবন্ধে জানানো হলো বিদেশে চালানো এতদিন অপ্রকাশিত কিছু লেনদেনের কথা যেগুলোর সাথে বিনোদ আদানি যুক্ত[৪] এবং যেগুলো ‘আদানি গোষ্ঠীকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত’।

উইকিপিডিয়া প্রকাশিত মাসিক অনলাইন পত্রিকা সাইনপোস্ট থেকে বেরোলো কৌতূহল জাগানো আরও এক কাহিনি। আদানির সাথে যুক্ত একাউন্ট থেকে — যে অ্যাকাউন্টগুলোর বেশ কয়েকটা চালাতো আদানি গোষ্ঠীর কর্মীরা — উইকিপিডিয়ার কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণের সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা উইকিপিডিয়া দেখতে পেয়েছে। এভাবে আদানি গোষ্ঠী সম্বন্ধে উইকিপিডিয়ায় বিধৃত তথ্যাবলিতে কারচুপি করত আদানিরা। ঐ নিবন্ধে বলা হয়েছে, “৪০টারও বেশি… সকপাপেট বা বেতনে লালিত কিন্তু অঘোষিত সম্পাদক… উইকিপিডিয়ায় দেওয়া (আদানি গোষ্ঠী সম্পর্কে) নিবন্ধের অ-নিরপেক্ষ পিআর ভাষ্য দিয়ে উইকিপিডিয়ার পাঠকদের প্রতারিত করার চেষ্টা করে।” তারা অনেকেই “বেশ কয়েকটি নিবন্ধ এডিট করে… এবং পক্ষপাতদুষ্ট কনটেন্ট বা অতিরঞ্জিত প্রশস্তি ভরে দেয়”।

টাইম পত্রিকা ২০২৩-এর ৯ ফেব্রুয়ারি “আদানি গোষ্ঠীর সমস্যাগুলো কেন সারা ভারতেই অনুরণিত হবে” শীর্ষক এক গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ প্রকাশ করে এবং তাতে একটা জুতসই ও অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন উপশিরোনামও থাকে: ঐ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী শুধু সুবৃহৎই নয়; দেশের বৃদ্ধির মডেলের অন্তর্নিহিত টানাপোড়েনকেও তা মূর্ত করে। বিলিয়ন ডলার সম্পদের অধিকারী ও বিনিয়োগকারী এবং ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশেনস-এর প্রতিষ্ঠাতা জর্জ সোরোস বলেন, মোদী এবং আদানি “ঘনিষ্ঠ মিত্র; তাঁদের নিয়তি পরস্পরের সঙ্গে জড়িত” আর তাই এই ইস্যুটা “ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের ওপর মোদীর নাগপাশকে যথেষ্ট মাত্রায় দুর্বল করে তুলবে”। তিনি আরও বলেন, এটা ভারতে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠা প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের দাবিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার সূত্রপাত ঘটাতে পারে, যার ফলে শেষমেশ দেশের গণতান্ত্রিক পুনরুজ্জীবনের পথ প্রশস্ত হবে। তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে ভারত সরকার মাত্রাতিরিক্ত বৈরি প্রতিক্রিয়া দেখালো। অবশ্য ভারতের শাসকরা সবেতেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠছিল।

নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের লগ্নি বিষয়ের অধ্যাপক অশ্বথ দামোদরণ এক বিশদ ও ক্ষুরধার বিশ্লেষণ উপস্থাপিত করেন। ‘মানি কন্ট্রোল’ পত্রিকার ২০২৩-এর ১ মার্চ সংখ্যায় শুভম রাজের তোলা রিপোর্টে যেমন বলা হয়েছে, “মূল্যায়ণ গুরু অশ্বথ দামোদরণ বলেছেন যে, সামগ্রিকভাবে আদানি গোষ্ঠী এবং বিশেষভাবে আদানি এন্টারপ্রাইজেস-এর প্রচুর ঋণ রয়েছে…

  • “উঁচু মাত্রার এই ঋণ গোষ্ঠীর ভালো করার চেয়ে ক্ষতি করেছে বেশি, একটি ব্লগে ২৭ ফেব্রুয়ারি এক পোস্টে অধ্যাপক এই কথা বলেছেন।
    “আদানি গোষ্ঠীর সমবেতভাবে যত ঋণ থাকার কথা তার তিন গুণ ঋণ আছে…
    “সত্যি বলতে কি, আদানির ঋণ নেওয়াটা সম্পদ বৃদ্ধির দিক থেকে কোনো সাহায্যই করে না, করলেও তা যৎসামান্য (যদি না সেই ঋণ সরকার বা কোনো অসতর্ক ব্যাঙ্ক অথবা গ্রীন বন্ড হোল্ডার বা অন্য কেউ অতিরিক্ত সুবিধাজনক শর্তে দিয়ে থাকে…
    “একটা বর্ধিষ্ণু সংস্থার বৃদ্ধিতে অর্থ জোগানের জন্য পুঁজির প্রয়োজন, আর সেই পুঁজিকে আসতে হবে শেয়ার ছেড়ে অথবা ঋণের মাধ্যমে।… নিয়ন্ত্রণই যদি কোম্পানির পরিচালকদের অভিপ্রায় হয়ে থাকে তবে তারা সাধারণের কাছে শেয়ার ছাড়ার চেয়ে ঋণ গ্ৰহণকেই বেছে নিতে পারে, এমনকি যদি তা অর্থ সংগ্রহের খরচা বাড়িয়ে দেয় বা বিনিয়োগ থেকে শেষ পর্যন্ত লাভের কড়ি কিছুই মিলবে না এমন একটা ঝুঁকিও সৃষ্টি করে।”

হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টের বাইরের আরও কিছু

দামোদরণ আমাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্দৃষ্টি যোগায়। একচেটিয়া কারবারিরা কেন প্রায়শই অত্যধিক ঋণ নিতে পছন্দ করে, এবং কেন এটা জেনেও করে যে শেয়ার ছাড়ার চেয়েও এটা আরও ব্যয়বহুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ, এমনকি শেয়ারের জন্য জনসাধারণের মধ্যে উচ্চ মাত্রার দাবি থাকলেও ঋণ নেয়? এর সংক্ষিপ্ত উত্তর হল : নিয়ন্ত্রণের, চূড়ান্ত ব্যক্তিগত এবং পরিবারগত নিয়ন্ত্রণের প্রবণতা। ঠিক যেমন রাজনীতিতে কোনো স্বৈরাচারী শাসক সব সময় ব্যক্তিগত/পরিবারগত/ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠীর প্রাধান্যকেই সব কিছুর ওপর স্থান দেয়।

আর এভাবেই অতি-ধনীদের হাতে আয় ও সম্পদের কেন্দ্রীভবন এবং এক ক্ষুদ্র চক্রের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন (শেষমেশ এক স্বৈরাচারী নেতার হাতে) এক সাথেই চলে। আদানি ও আম্বানিদের মতো ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর নির্মাণ মূলত হয়েছে রাষ্ট্রীয় সম্পদের ব্যাপক বেসরকারিকরণ, বাজারের ওপর একচেটিয়া দখল কায়েম এবং প্রতিযোগিতাকে দমিয়ে রাখার ভিত্তিতে — এর পরিণামেই ২০২১ সালে মাত্র ১ শতাংশ ভারতীয় দেশের মোট সম্পদের ৪০ শতাংশের মালিক হয়ে যায় (যা যুক্তরাষ্ট্রের ৩২ শতাংশের চেয়ে অনেকটাই বেশি), যেমনটা জানিয়েছে অক্সফ্যাম-এর একটা রিপোর্ট। এই চরম অসাম্যের সঙ্গেই আসছে গণতন্ত্রের বিপুল ক্ষয় (হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট নিয়ে সংসদে আলোচনা করতে শাসক দলের অস্বীকার করার ধৃষ্টতাটার দিকেই শুধু তাকান), সীমাহীন দুর্নীতি এবং জনগণের অপরিমেয় দুর্ভোগ। এর কয়েকটা উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত নীচে তুলে ধরা হচ্ছে।

মোদী-আদানি কয়লা কেলেঙ্কারি

ইউপিএ-র সময়কার ‘কোলগেট’ কেলেঙ্কারি নিশ্চয় মনে আছে। সুপ্রিম কোর্ট ২০১৪ সালের এক রায়ে বিভিন্ন রাজ্য সরকারের মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর জন্য বরাদ্দ হওয়া ২০৪টি কয়লা ব্লককে বাতিল করে, যে কোম্পানিগুলো আবার ঐ লাভজনক ব্যবসাটাকে গোপন চুক্তির মাধ্যমে অপ্রকাশিত দামে বেসরকারি সংস্থাগুলোর হাতে তুলে দিচ্ছিল। ঐ বছরই ক্ষমতায় বসে মোদী সরকার কয়লা খননের জন্য একটা পরিচ্ছন্ন, স্বচ্ছ ব্যবস্থা চালু করার প্রতিশ্রুতি দেয়। এর বিপরীতে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের বলে নিষেধাজ্ঞামুক্ত হয়ে ও তার নিজের সিদ্ধান্তের বলে বেশকিছু বেসরকারি সংস্থাকে প্রতিবন্ধকতায় ফেলে মোদী সরকার ছত্তিসগড় ও রাজস্থানের খনিতে আদানি গোষ্ঠীকে খননকার্য চালিয়ে যেতে দেয়। এটা তারা করে গোপন প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ও কারচুপির এক জটিল জাল তৈরি করে (উদাহরণস্বরূপ, আইন, বিধি ও রীতিতে পরিবর্তন এনে বা নতুন সংস্থান জুড়ে।)[৫]

ভারতে কর ছাড়ের সুবিধা, বাংলাদেশে মাত্রাধিক মুনাফা

২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন ঘোষণার ঠিক ১২ দিন আগে ২৫ ফেব্রুয়ারি মোদী সরকার ঝাড়খণ্ডে আদানির এমন একটা প্রকল্প গড়ে ওঠার সমস্ত বাধাকে দূর করলেন যেটা হল ভারতের প্রথম স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ প্রকল্প যা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের মর্যাদা ও বিপুল সুবিধা পাবে (আয়করের ক্ষেত্রে প্রথম পাঁচ বছর ১০০ শতাংশ বাদ, দ্রুত ছাড়পত্র লাভ, করপোরেট কর, আমদানি শুল্ক, জিএসটি ইত্যাদির ছাড়ের সুবিধা)। এটাকে সফল করতে বাণিজ্য মন্ত্রক সে বছরের গোড়ায় বিদ্যুৎ সংক্রান্ত চালিকা নীতিতে সংশোধন আনে। অপরদিকে, বিদ্যুৎ ক্রয়ের জন্য বাংলাদেশকে দিতে হবে অত্যন্ত চড়া দাম, কেননা, দু-পক্ষের মধ্যে হওয়া চুক্তিটি ছিল বাজে রকম বৈষম্যপূর্ণ। বাংলাদেশের তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ, বিদ্যুৎ ও বন্দর সংরক্ষণের সদস্য-সম্পাদক ও অর্থনীতিবিদ এবং গণ বুদ্ধিজীবী, সম্পাদক ও রাজনৈতিক কর্মী অধ্যাপক আনু মহম্মদ দ্ব্যর্থহীনভাবেই এটা বলেছেন, “কোনো আলাপ-আলোচনাই ছিল না। আদানি শর্তদেয় আর রাজনৈতিক লাভের জন্য বাংলাদেশ সেগুলো মেনে নেয়।” আদানির পিছনে মোদীর হাত এখানে সুস্পষ্ট রূপেই ধরা পড়ছে।

আদানি প্রকল্পের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে খুব স্বাভাবিকভাবেই যথেষ্ট ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে। অন্য একটা প্রতিবেশী দেশেও এই জঘন্য ধরনের আধা-উপনিবেশবাদী শোষণ আখ্যানের পুনরাবৃত্তি দেখা গেল। গত বছর জুন মাসে শ্রীলঙ্কায় দেখা গিয়েছিল “আদানিকে থামাও” প্রতিবাদ। শ্রীলঙ্কার সিলোন ইলেকট্রিসিটি বোর্ডের চেয়ারম্যান এম এম সি ফার্ডিনান্ডো সংসদীয় এক প্যানেলকে যখন জানান যে রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপক্ষে তাঁকে বলেছেন যে মান্নার-এর বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্প আদানি গোষ্ঠীকে দেওয়ার জন্য মোদী তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন, তখনই ঐ প্রতিবাদ ঘটে। পরবর্তীতে ফার্ডিনান্ডো স্পষ্টতই চাপের মুখে তাঁর বিবৃতি প্রত্যাহার করে নিয়ে পদত্যাগ করেন।

মোদী ছাড়া আর কারও ওপর দায় বর্তায় না, উত্তর তাঁকেই দিতে হবে

এই লেখা যখন ছাপার জন্য পাঠানো হচ্ছে দেশের সঙ্গে প্রতারণা তখন আরও কদর্য হয়ে উঠছে। হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ ইতিমধ্যেই জানিয়েছে যে, তিনটে অর্থ তহবিল বর্তনীচক্রের লেনদেনে এবং আদানি গোষ্ঠীর কোম্পানিগুলোর শেয়ার মূল্যের কারচুপিতে যুক্ত ছিল, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে এলারা ক্যাপিটাল পরিচালিত ফাটকা অর্থ তহবিল এলারা ইন্ডিয়া অপরচুনিটিজ ফান্ড। এই বিষয়ে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সংবাদপত্র আরও বিশদ তথ্য দিয়েছে। এলারা ও তার সাথে আদানি ডিফেন্স হল বেঙ্গালুরুর প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সম্পর্কিত একটা কোম্পানি আলফা ডিজাইন টেকনোলজিস প্রাইভেট লিমিটেড-এর (এডিটিপিএল) প্রমোটার। এই এডিটিপিএল ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো) এবং প্রতিরক্ষা উন্নয়ন ও গবেষণা সংস্থার (ডিআরডিও) সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে ৫৯০ কোটি টাকার বরাত পেয়েছে। এর সংকেতগুলো ভয়াবহ। সন্দেহজনক একটা বিদেশী সংস্থা যখন ডিআরডিও এবং ইসরোর মত সংবেদনশীল কার্যকলাপে প্রবেশাধিকার পায়, সে ক্ষেত্রে ভারতের নিরাপত্তাকে সংকটাপন্ন করে তোলার ঝুঁকি কি থাকে না?

বিপুলাকায় এই কেলেঙ্কারির যথাযথ তদন্ত চালানোর পরিবর্তে সরকার তদন্তকে প্রতিহত বা বানচাল করতেই কোমর বেঁধেছে। সুপ্রিম কোর্ট যে তদন্ত প্যানেল গড়েছে তাকে আমরা স্বাগত জানাই, কিন্তু সেই প্যানেলের কাজ তো হবে কেবল বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা; হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ যে বুনিয়াদি প্রশ্নটা তুলেছে, এই কেলেঙ্কারির পিছনে মোদী-আদানি গাঁটছড়া কাজ করেছে কি না, সেটা এই প্যানেলের বিচার্যই নয়। সুতরাং দায়টা বর্তাচ্ছে আমাদের ওপর, ভারতীয় জনগণের ওপর। সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাকে শুধু এই কেলেঙ্কারির জন্যই নয়, গোটা দেশের পক্ষে ভীষণ বিপর্যয়কর স্যাঙাতি পুঁজিবাদের উত্থানের জন্যও জবাবদিহি করতে বাধ্য করতে হবে।


আদানি সাম্রাজ্যের গড়ে ওঠা : যুগলবন্দিতে তো দুজনই লাগে, তাই না?

বিদ্যুৎ গতিতে আদানির উত্থানের ব্যাখ্যা কি হতে পারে? এর উত্তরের সূত্র রয়েছে স্যাঙাতি পুঁজিবাদের রাজনৈতিক অর্থনীতির মধ্যে যা হল অবক্ষয়ী একচেটিয়া পুঁজিবাদের এক চরম হানিকর ও ধ্বংসাত্মক রূপ, ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন যেটাকে পুঁজিবাদের সাম্রাজ্যবাদী স্তরের অর্থনৈতিক মর্মবস্তু বলে অভিহিত করেছিলেন, ভারতে যেটা সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছায় মোদীর তত্ত্বাবধানে। কলঙ্কজনক এই আখ্যানের তিনটে সুস্পষ্ট পর্যায় রয়েছে বলে দেখা যাচ্ছে।

২০০৩–২০১৪: উন্নয়নের তথাকথিত গুজরাট মডেলের উত্থান

২০০২-এর গুজরাট দাঙ্গায় গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মোদীর ভূমিকার জন্য ভারতের বড় ব্যবসায়ীদের অনেকেই দেশে ও বিদেশে মোদীর নিন্দায় গলা মেলান। এটা একেবারেই স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল, কেননা, সাম্প্রদায়িক এবং অন্যান্য সামাজিক ইস্যুতে তাদের ব্যক্তিগত মতামত যাই হোক না কেন, ব্যবসাদার হওয়ায় আইন ও শৃঙ্খলার শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতিই সব সময় তাদের কাছে কাম্য ছিল। তখন হীরে ও রত্নের নামগোত্রহীন ব্যবসায়ী গৌতম আদানি নিজের ব্যবসায়ী জীবনে উন্নতির লক্ষ্যে এই সুযোগকে সুচতুরভাবে কাজে লাগালেন। উঠতি ধনকুবের মুকেশ আম্বানি-সহ অন্যান্য গুজরাটি ব্যবসায়ীদের নিয়ে তিনি ২০০৩-এর নবরাত্রি উৎসবের সময় গুজরাট সরকারকে প্রথম ‘প্রাণোচ্ছল গুজরাট : বিশ্বের বিনিয়োগকারীদের শীর্ষবৈঠক’ সংগঠনে সহায়তা করলেন। এই শীর্ষবৈঠক দু-বছর অন্তর নিয়মিত অনুষ্ঠান হয়ে উঠল এবং মোদীকে সহায়তা করল রক্তেরাঙা হাতের শাসক হিসেবে প্রতিভাত হওয়ার বদলে আধুনিক অর্থনৈতিক প্রগতির মুখ হিসাবে – ‘গুজরাট মডেল’-এর রূপকার হিসাবে – নতুন রূপে নিজেকে জাহির করতে। ইত্যবসরে, অন্যান্যদের মধ্যে আদানিকে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ছাড় মঞ্জুর করা হলো যা তাঁর সম্পদ ও মর্যাদাকে দ্রুত বহুগুণ বাড়িয়ে তুলল।

২০১৪–২০২২: ‘গুজরাট মডেল’-এর উগ্ৰতা বাড়িয়ে তাকে ‘নয়া ভরতে’ সম্প্রসারিত করা

প্রাদেশিক একটা মডেলকে জাতীয় স্তরে খাপ খাওয়াতে গেলে যথেষ্ট উদ্ভাবনার প্রয়োজন। আরএসএস-এর পরিচালনায় ও সক্রিয় সমর্থনে মোদী এক আগ্রাসী হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণে জোর দিয়ে রাজনৈতিক ফ্রন্টে নেতৃত্ব দিলেন; আর আদানি, আম্বানি ও তাদের সম্প্রদায়ের হাতে অর্পণ করলেন অর্থনৈতিক এজেন্ডাটা: ‘জাতীয় সমৃদ্ধির’ পথ হল রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের সংস্থাগুলো-সহ বিদ্যমান সমস্ত কিছুর করপোরেটিকরণ। ২০১৮ সালে ভারত সরকারের একটা বিতর্কিত সিদ্ধান্তের বলে বিমানবন্দর পরিচালনায় পূর্ববর্তী কোনো অভিজ্ঞতা বর্জিত আদানিদের ছটা বিমানবন্দর পরিচালনার নিলামে অংশ নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হলো এবং সেই নিলামে তারা সফলও হলেন। এই সিদ্ধান্ত আদানি গোষ্ঠীকে রাতারাতি দেশের অন্যতম বেসরকারি বৃহৎ বিমানবন্দর পরিচালকে পরিণত করল। আদানি দেশের বন্দর, সড়ক, রেল, জীবাশ্ম-জ্বালানি ও সবুজ বিদ্যুত ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক টেন্ডারে জয়ী হতে ও পরিকাঠামো প্রকল্পে বরাত পেতেও সফল হলেন। মোদী এটাকে ‘জাতির নির্মাণ’ বলে অভিহিত করলেন আর তার পর থেকে আদানিও প্রায়শই দেশপ্রেম ও লোকপ্রিয়তার রং চড়িয়ে এই মন্ত্র আউড়ে চলেছেন। আদানি এইভাবে তাঁর সম্প্রদায়ের অন্যান্যদের চেয়ে মোদীর মার্কামারা রাজনীতির সঙ্গে তাঁর ব্যবসায়ী মডেলের সমন্বয় ঘটাতে অনেক বেশি সফল হয়েছেন। আর এর মধ্যেই রয়েছে তাঁর অসামান্য সাফল্যের ভিত্তি।

২০২৩-এর জানুয়ারি: সংকটে যুগল আঁতাত

গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় নির্বাচনের মোটামুটি এক বছর আগে এবং বিবিসির তথ্যচিত্র প্রদর্শনীর পরবর্তী পর্যায়ে হিন্ডেনবার্গ-এর রিপোর্ট মোদী-আদানির আঁতাতবদ্ধ মডেলের প্রতি এক গুরুতর চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। ভারত ও বিশ্বের অথনীতিতে এখন যে জোরালো প্রতিকূল হাওয়া বইছে এবং ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সংবাদপত্র নতুনতর যে উন্মোচন ঘটিয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এই মডেলের সংকট আগামী মাসগুলোতে আরও জটিল হয়ে উঠবে বলেই মনে হয়।


টীকা:

১। পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির প্রোমোটাররা যাতে শেয়ারের দাম ইচ্ছেমতো বাড়িয়ে তুলতে বা কমাতে না পারেন তার জন্য মোট শেয়ারের ৭৫ শতাংশের বেশি মালিকানা নিজেদের দখলে রাখার অধিকার তাঁদের নেই।

২) একটা শেল কোম্পানি হলো এমন এক সংস্থা যার ব্যবসায়ী সত্ত্বার একটা খোলস বা বহিরাবরণ রয়েছে, কিন্তু ভেতরে-ভেতরে যা ফোঁপড়া — যার শুধু কাগুজে অস্তিত্বই রয়েছে, যার সত্যিকারের কোনো ব্যবসা নেই বা থাকলেও একেবারেই সামান্য।

৩) রাউন্ড ট্রিপিং এমন একটা পদ্ধতি যার মাধ্যমে অর্থ এক দেশ থেকে অন্য দেশে নিয়ে গিয়ে প্রথম দেশটিতে পুনরায় ফিরিয়ে আনা হয়। যে উদ্দেশ্যে তা করা হয় তা হলো কালো টাকাকে সাদা করা অথবা মরিশাসের মতো দেশে কর ছাড়/ ফাঁকির সুবিধা নেওয়া, যে দেশগুলোতে করের পরিমাণ খুব কম, কর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা খুবই শিথিল, ইত্যাদি। এছাড়া, এমন দৃষ্টান্তও রয়েছে (আদানি গোষ্ঠী যার একটা নিদর্শন) যখন ঘুরপথে ফিরিয়ে আনা অর্থ ভারতে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ার মূল্যকে বাড়িয়ে তুলতেও কাজে লাগানো হয়েছিল। এই সমস্ত কারণে ক্ষেত্র বিশেষে রিজার্ভ ব্যাংকের পূর্ব অনুমতি ছাড়া ঐ ধরনের লেনদেন নিষিদ্ধ। তবে, ২০১৯ সালে দ্বিতীয় বারের জন্য ক্ষমতায় বসার পর সরকার নিয়োজিত এক উচ্চপর্যায়ের পরামর্শদাতা গোষ্ঠী বলে, “রাউন্ড ট্রিপিং-এর এই অন্তরায়টা দিয়ে একটা বৃহৎ ক্ষেত্রকে আর রুদ্ধ করা যাবে না যেমন যান দুর্ঘটনার ঝুঁকির কথা বলে একটা গুরুত্বপূর্ণ হাইওয়ের নির্মাণকে বন্ধ করা যায় না”। ঐ গোষ্ঠী সুপারিশ করে, আইন সংশোধন করে রাউন্ড ট্রিপিং-এর বিষয়টাকে ভারতের নিয়ন্ত্রণ কাঠামোয় চালু করা হোক। এইভাবে, ব্যবসা করাকে সহজসাধ্য করার নামে আগের কঠোর ব্যবস্থার কিছুটা উদারিকরণ ঘটানো হয়েছিল।

৪) দীর্ঘ সময় ধরে আদানিরা তাদের গোষ্ঠীতে বিনোদ আদানির কোনো পদমর্যাদা থাকার কথা সরকারিভাবে অস্বীকার করে এসেছে। কিন্তু গত ১৭ মার্চ একেবারে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে তারা জানায় যে, বিনোদ আদানি হলেন গোষ্ঠীর অন্যতম প্রমোটার।

৫) বিশদে জানবার জন্য দেখুন আলজাজিরায় ২০২৩-এর ১মার্চ প্রকাশিত শ্রী গিরেশ জালিহাল ও কুমারসম্ভবের লেখা নিবন্ধ মোদী সরকার আদানিকে এমন কয়লাচুক্তি মঞ্জুর করে যেটা তারা নিজেরাই ‘অসংগত’ বলে জানত।

– অরিন্দম সেন
(লিবারেশন, এপ্রিল ২০২৩ সংখ্যা থেকে)

খণ্ড-30
সংখ্যা-9