মোঘলরাই এখন দেশের সবচেয়ে বড় শত্রু
enemy-of-the-country

সঙ্ঘীরা এখন বাঙালির নববর্ষকে তাদের মতাদর্শের খোপে কব্জা করতে চাইছে। তারা হঠাৎ আবিষ্কার করেছে যে বাংলা সনের প্রবর্তক গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক, তোডরমল বা আকবর নন। তাঁদের যুক্তি হাস্যকর! তাঁরা বলছেন আকবর বা তোডরমল কখনো বাংলায় আসেননি, তাঁরা কী করে বাংলা সন চালু করবেন। একই যুক্তিতে বলা চলে কোনও মোঘল সম্রাট তো বাংলায় আসেননি, তাহলে কীভাবে বাংলা প্রায় ১৫০ বছর মোঘলদের অধীনে ছিল! সঙ্ঘীরা অবশ্য যুক্তি, প্রমাণ এসবের পরোয়া করে না। রাজস্থানের পাঠ্যপুস্তকে কোনও তথ্য, যুক্তি ছাড়াই আকবর ও রানা প্রতাপের হলদিঘাট যুদ্ধে রাজপুত রাজাই যে জয়ী ছিলেন এমনটাই দাবি করা হয়েছে। তথ্য, প্রমাণের তো কোনও দরকার নেই! জ্ঞানবাপি মসজিদ নিয়ে বিতর্কের সময় এক মহাগুরু তো বলেই দিয়েছেন যে বিশ্বাসই সব, হিন্দুরা যদি মনে করে যে মসজিদের তলায় মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে, সেটাই যথেষ্ট, কোনও প্রমাণের দরকার নেই।

বিশ্বাসের ভিত্তিতে ইতিহাসের কাটাছেড়ার প্রক্রিয়া একশো বছর আগে থেকেই শুরু হয়েছে। ইতিহাস নিয়ে, বিশেষ করে তথাকথিত মুসলিম যুগ নিয়ে, সঙ্ঘীদের চিরকালই একটা সমস্যা আছে। ষাটের দশকের শুরুতে তাঁদের আদিপুরুষ এম এস গোলওয়ালকার ঘোষণা করেছিলেন যে দেশভাগের মুলে আসলে ঐ আটশো বছরের মুসলিম শাসন। তিনি আরও লিখছেন ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পরেও আমরা দেখি আমাদের ইতিহাস তিন যুগে বিভক্ত – হিন্দু, মুসলিম, খ্রিশ্চান। এই বিষাক্ত তত্ত্ব অনুযায়ী এই দেশে হিন্দুরা মুসলিম ও খ্রিশ্চানদের সমগোত্রীয়। মনে রাখতে হবে ‘সেক্যুলার’ ও বামঘেঁষা ঐতিহাসিকরাও ব্রিটিশদের দ্বারা ভারতের ইতিহাসের এই কৃত্তিম বিভাজনের বিরুদ্ধে ছিলেন। তাঁদের যুক্তি ছিল এভাবে ঔপনিবেশিক শক্তি ভারতীয় জনগণের মধ্যে সুচতুরভাবে বিভাজন সৃষ্টি করছে, যা অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। গোলওয়ালকার কিন্তু সমস্যাটাকে একেবারে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন। তাঁর মতে (১) হিন্দুরা কখনই অন্য জনগোষ্ঠীর সমগোত্রীয় নন। তাঁর ‘উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইনড’ বইয়ে তিনি ‘উই’ বলতে বোঝাচ্ছেন হিন্দুদের যারা নাকি স্মরণাতীত কাল থেকে এই মাটির আপন সন্তান এবং যারা এই দেশের স্বাভাবিক মালিক। (২) আরও গুরুত্বপূর্ণ তিনি লিখছেন আদিকাল থেকে ভারতের সমগ্র ইতিহাস নিরবচ্ছিন্নভাবে হিন্দুদের মহান ইতিহাস। এই ইতিহাস কখনো অতি উজ্জ্বল যা হিন্দুদের স্বাধীনতার প্রতিফলন আবার তা কখনো জাতীয় মুক্তি ও সম্মান রক্ষার্থে বিদেশী হানাদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কাহিনী।

সম্প্রতি এনসিইআরটি সিবিএসইর ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তক থেকে নবম অধ্যায়, ‘কিংস অ্যান্ড ক্রনিকলস, দ্যা মুঘল কোর্টস’ ছেঁটে ফেলেছে। প্রায় এক বছর আগে আহমেদাবাদের একটি সভায় আরএসএস ‘উই……’ বইটিতে সংখ্যালঘু সম্পর্কিত যে নিদান তা কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নেয়। গত ৩০শে জুন পানিপতের সভায় তাঁরা জানায় যে দেশ গঠন প্রক্রিয়ায় সাম্প্রদায়িক হিংসা অবধারিত। অতএব বুলডোজার রাজ, গোরক্ষকদের তান্ডব, মসজিদ আক্রমণ সবই আদপে নেশন-বিল্ডিং! আর দেশের প্রধানমন্ত্রী তো আওরংগজেবকে খলনায়ক বানানোর কাজ নিরন্তর করে চলেছেন। কখনো বলছেন প্রত্যেক আওরংগজেবের বিপরীতে আমাদের দেশে একজন শিবাজি আছেন; কখনো বলছেন মোঘল সম্রাট গুরু গোবিন্দ সিংয়ের সন্তানদের হত্যা করেছিলেন; কখনো বলছেন গুরু তেজ বাহাদুরকে হত্যা করে সম্রাট আমাদের ধর্মথেকে বিচ্যুত করতে পারেননি। যখন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী অতীতকে বিকৃত করে বর্তমানের কার্যকলাপকে যুক্তিগ্রাহ্য করছেন, তখন তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই বা পিছিয়ে থাকেন কেন? বিগত বছরের জুন মাসে একটি বই উন্মোচন সভায় তিনি বুক বাজিয়ে বলেছেন, ইতিহাস পুনর্লিখন করতে কে আমাদের আটকাবে?

২০১৪ থেকেই এই পুনর্লিখন শুরু হয়ে গেছে। প্রথমে রাস্তা, স্থানের নাম পালটানো হয়েছে, বিজেপি শাসিত রাজ্যের পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন করা হয়েছে। দিল্লির আওরংগজেব রোডের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। রাজস্থানের পরে মহারাষ্ট্রে ইতিহাস বইয়ে কাঁচি চালানো হয়েছে। ক্লাস সেভেন ও নাইনের পাঠ্যপুস্তকে আকবরের শাসনকাল মাত্র তিন লাইনে নামিয়ে আনা হয়েছে এবং মোঘল যুগ অনেকটাই ছেঁটে ফেলা হয়েছে। বিপরীতে ‘মারাঠা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা শিবাজি’কে প্রবলভাবে মহিমান্বিত করা হয়েছে। যুক্তি : ইতিহাসকে মহারাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা হয়েছে। আরও সাঙ্ঘাতিক ক্লাস সেভেনের ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকের কভারে ভারতবর্ষের মানচিত্র জুড়ে গেরুয়া পতাকা। উত্তরপ্রদেশের রাজ্য সরকার ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে তারা এনসিইআরটির নতুন পাঠ্যপুস্তকই অনুসরণ করবে।

শুধু যে ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকে কাঁচি চালানো হয়েছে এমনটা নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানও সঙ্ঘীদের কোপে পড়েছে। ক্লাস টুয়েলভের বইয়ে জনপ্রিয় আন্দোলন সংক্রান্ত অধ্যায় যাতে সমাজবাদি ও কম্যুনিস্ট দলগুলো সম্পর্কে বিবরণ এবং স্বাধীনতা-উত্তর এক দলীয় শাসন সম্পর্কে আলোচনা আছে তা ব্যাপকভাবে সংশোধন করা হয়েছে। বলাই বাহুল্য নক্সালবাড়িও এর মধ্যে পড়ে। এছাড়া ‘চ্যালেঞ্জেস অফ ডেমোক্রেসি’, ‘ডেমোক্রেসি এন্ড ডাইভারসিটি’ অধ্যায়গুলিও বাদ। এক বছর আগে মেধা পাটকারের নর্মদা আন্দোলন ও চিপকো মুভমেন্ট সহ আরও বেশ কিছু গণআন্দোলনকে বাদ দেওয়া হয়েছে। গুজরাট দাঙ্গা সংক্রান্ত বিবরণ সংশোধন করা হয়েছে। ‘গুজরাট দাঙ্গা দেখিয়ে দেয় যে সরকারি ব্যবস্থা সংকীর্ণ আবেগ দ্বারা প্রভাবিত হয়’ এবং ‘ধর্মীয় আবেগকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার বিপদ সম্পর্কে গুজরাট আমাদের সতর্ক করেছে’ এই লাইনগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে। বাজপেয়ীর ‘রাজধর্ম’ সম্পর্কিত বাণীও বাদ। এতেই শেষ নয়। সাহিত্যও সঙ্ঘীদের কোপে পড়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে ২০২১ এ মহাশ্বেতা দেবীর অমর, প্রতিষ্ঠান-বিরোধী গল্প ‘দ্রৌপদী’ দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরাজি পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। এর পরিবর্তে লেখিকার অন্য কোনও গল্পও পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। একই সাথে তামিল দলিত লেখিকা বামা ফাউস্তিনা সুসাইরাজ এবং সুকির্থরানির লেখার ওপরেও কোপ পড়েছিল।

২০১৪ সালে আরএসএস ‘ভারতীয় শিক্ষা নীতি আয়োগ’ গঠন করে। এর দায়িত্বে ছিলেন দিননাথ বাটরা যিনি ততদিনে ওয়েন্ডি ডোনিগারের ‘দ্য হিন্দুস : এন অল্টারনেটিভ হিস্ট্রি’ বইটি নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা নিয়ে শিরোনামে চলে এসেছিলেন। তিনি চাপ দিয়ে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস থেকে এ.কে.রামানুজানের ‘থ্রী হান্ড্রেড রামায়ণস’ ছেঁটে ফেলতে বাধ্য করেন কারণ সংঘ পরিবারের মতে রামায়ণ একটিই এবং অবশ্যই সেটি তাদের দ্বারা স্বীকৃত। দিননাথ বাটরার বিখ্যাত/কুখ্যাত বই হচ্ছে, ‘দ্য এনেমিজ অফ ইন্ডিয়ানাইজেশন-দ্য চিল্ড্রেন অফ মার্ক্স, ম্যাকলে এন্ড মাদ্রাসা’। এতে তিনি বর্তমানে যে ইতিহাস পড়ান হয় তাতে ৪১টি ভুল খুঁজে পেয়েছেন। চারটি প্রধান ভুল হল : (১) আর্যরা বাইরে থেকে এসেছে এটি একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রটনা কারণ হিন্দুরাই হচ্ছে এখানকার ভূমিপুত্র। (২) মহাকাব্যগুলিতে যে চমৎকার, তথাকথিত অলৌকিক ঘটনাগুলি বর্ণিত হয়েছে সেগুলি বাস্তব। এই ব্যাখ্যা থেকেই বলা হচ্ছে যে ইতিহাস আর মিথোলজি মূলত এক (৩) মুসলমানদের আক্রমণ ভারতের ইতিহাসের অন্ধকারতম অধ্যায়। (৪) স্বাধীনতা সংগ্রামে গান্ধী এবং নেহুরুকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

পাঠ্যক্রমের ওপর সঙ্ঘীদের এই কালাপাহাড়ি আক্রমণে একটা পরিকল্পিত মতলব বোঝা যায়। প্রথমত যা কিছুই তাঁদের রাজনীতি, দর্শন, ধর্মীয় চিন্তা, আদর্শর বিরোধী সেটা তারা মুছে দিতে উদ্যত হয়েছে। এই প্রক্রিয়া ২০১৪ থেকে শুরু হয়েছে এবং সেটার গতিবেগ যত দিন যাচ্ছে বৃদ্ধি পাচ্ছে। দ্বিতীয়ত তারা মুসলিমদের ওপর আক্রমণ কেন্দ্রীভুত করেছে। মোঘলদের আক্রমণ করে, আওরংগজেবকে আক্রমণ করে তারা আসলে আজকের মুসলিম সম্প্রদায়কে সবক শেখাতে চাইছে। দেশের প্রধান সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ওপর তাদের আক্রমণ বহুমুখী। রাস্তা, স্থানের নাম পরিবর্তন করে তারা জনজীবন থেকে সুলতান ও মোঘল আমলের চিহ্ন মুছে দিচ্ছে। ইতিহাস থেকে তাদের কীর্তিকলাপ মুছে দিচ্ছে। গোরক্ষকদের তান্ডব, বুলডোজার, প্রকাশ্য সভায় গণহত্যা, গণধর্ষণের হুমকি দিয়ে তারা মুসলিমদের সন্ত্রস্ত করে রাখছে। উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার। জীবনের সর্বক্ষেত্রে হিন্দুদের আধিপত্য মেনে নাও নচেৎ দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে বাস কর। মুসলিমদের সম্পর্কে এটাই তো গুরুজি গোলওয়ালকারের নিদান ছিল। আরএসএসের একশো বছর পূর্তিতে এতেই তো তাদের মোক্ষলাভ হবে। গুরুজি তাঁর লেখার ছত্রে ছত্রে নাৎসি জার্মানি কী ভাবে ইহুদিদের টাইট দিয়েছে সেটা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তিনি তো নিশ্চয়ই জানতেন ইহুদিরা ছিল জার্মানির জনসংখ্যার মাত্র ০.৭৫%, যেখানে মুসলিমরা আমাদের দেশে ১৪%।

- সোমনাথ গুহ

খণ্ড-30
সংখ্যা-10