সরকার নিজেই পুলিশ, নিজেই আইন আর নিজেই কি বিচারক ?
the-judge-itself

আজকের সময়টা ফেক নিউজের, আজকের সময়টা ভুল পথে চালিত করবার, আজকের সময়টা পোষ্ট ট্রুথের। কখন কোন খবরে যে একজন ব্যক্তি মানুষ ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে যাবেন, তা কেউই জোর গলায় বলতে পারবেন না। এই মিথ্যেকে কোনওভাবে সংজ্ঞায়িত না করা গেলেও, সরকারের তরফে কোনও একটি সংস্থাকে যদি দায়িত্ব দেওয়া হয় তা চিহ্নিত করার, তাকে কি সঠিক পদ্ধতি বলা উচিৎ? কিন্তু মোদীর ভারতবর্ষে সেটিই হয়। আজকের সামাজিক মাধ্যমের যুগে যখন একটি মিথ্যে খবরের উৎস সন্ধান করা একটি অত্যন্ত দুরূহ কাজ, তখন এই ধরনের একটি সরকারী নির্দেশ আসলে মানুষের বাকস্বাধীনতাই হরণ করবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

কিছুদিন আগে, গুজরাট গণহত্যার ওপর বানানো বিবিসির তথ্যচিত্রটি কেন্দ্রীয় সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। নিষিদ্ধ ঘোষণার অর্থ, কোনও জায়গায় এই তথ্যচিত্রের প্রদর্শন করা যাবে না, কোনও সামাজিক মাধ্যমে এটি পোষ্ট করা যাবে না, ইত্যাদি নানান বাধা নিষেধ আরোপ করা হয়েছিল ঐ তথ্যচিত্রটির ওপর। কেন্দ্রীয় সরকারের মনে হয়েছিল, এই তথ্যচিত্রের মধ্যে দিয়ে, আজকের দেশের প্রধানমন্ত্রী, যিনি সেই ২০০২ সালে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তাঁর ভাবমূর্তির ক্ষতি হতে পারে। ঐ তথ্যচিত্রে দেখানো হয়েছিল, যে গোধরা পরবর্তীতে যে সারা গুজরাটে ৭২ ঘণ্টা ধরে নরমেধ যজ্ঞ বা বলা ভালো মুসলমান নিধন হয়েছিল, তা বন্ধ করতে তৎকালীন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী কোনও উদ্যোগই গ্রহণ করেননি, উল্টে পুলিশকে নিস্ক্রিয় রেখে ঐ গুজরাট গণহত্যা হতে দিয়েছেন। ঐ তথ্যচিত্রে আরও একটি বিষয় ছিল, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নরেন্দ্র মোদীর একটি সাক্ষাৎকার দেখানো হয়েছিল, যাতে তিনি সোজাসুজি বলেছিলেন, গুজরাটের গণহত্যা চলাকালীন তিনি সংবাদসংস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি বলেই, তাঁর এতো বদনাম হয়েছিল। যা তিনি সেই সাক্ষাৎকারে উহ্য রেখেছিলেন, এবার তিনি সংবাদমাধ্যমে নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন করতে চান, তাই এবার তিনি তাঁর সমালোচকদের কোনও সুযোগ দিতে রাজি নন। শুধু সংবাদমাধ্যমই নয়, তিনি চান সামাজিক মাধ্যমেও যাতে তাঁর বিরুদ্ধে কোনওরকম আওয়াজ না ওঠে।

গত জানুয়ারী মাসে, ২০২১ সালের ইনফর্মেশন এবং টেকনোলজি অ্যাক্টে একটি সংশোধনী আনা হয়, তখন বলা হয়, সরকারি সংস্থা প্রেস ইনফর্মেশন ব্যুরোই ঠিক করবে, কোন খবরটি সঠিক এবং কোন খবরটি মিথ্যে। তখনই ঠিক করা হয়েছিল, যদি পিআইবি কোনও খবরের সত্যতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে, তাহলে, সরকার ফেসবুক বা টুইটার বা ইউটিউবের মতো কিছু সামাজিক মাধ্যমে সেই খবর বা তথ্য সম্প্রচার করা যাবে না। যেহেতু এই ধরনের সামাজিক মাধ্যমের কোনও দায় নেই, কোন খবর সঠিক বা কোন খবর সত্যি তা বিচার করার, তাই এক্ষেত্রে পিআইবির সিদ্ধান্তকেই তাঁদের শিরোধার্য বলে ধরতে হবে। যদি এই সরকারি সংস্থার আপত্তি সত্ত্বেও তাঁরা সেই খবর বা তথ্যকে তাঁদের মাধ্যম দিয়ে প্রচারিত হতে সাহায্য করেন, তাহলে তাঁদের এই দেশে ব্যবসা করতে দেওয়া হবে কি না, তা সরকার ভেবে দেখবে। মানে ঘুরিয়ে হুমকি দেওয়াই হল যে আমাদের দেশে কাজ করতে হলে আমাদের নিয়ম মেনেই চলতে হবে।

এই কথাটা শুনে অনেকের হয়তো মনে হতে পারে, সত্যিই তো ফেসবুক, টুইটারের মতো বহুজাতিক সংস্থা কেন আমাদের দেশের আইন মানবে না? কিন্তু বিষয়টা কি শুধু আইন মানাবা না মানার প্রশ্ন? নরেন্দ্র মোদী সরকার যে দীর্ঘদিন ধরে তাঁর দেশের বিভিন্ন সাংবাদিক থেকে শুরু করে বিভিন্ন সমাজকর্মীর ভিন্ন মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করছেন, তা তো দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। না হলে, সিদ্দিক কাপ্পান বা অন্যান্য বহু সাংবাদিককে কেন দীর্ঘদিন জেলে থাকতে হয়, কেন উমর খালিদের মতো ছাত্র সংগঠককে ইউএপিএর মতো ধারা দিয়ে কারাগারে বন্দী করে রাখা হয় দিনের পর দিন? কেন বিশ্বের প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ভারতের স্থান ১৮০টি দেশের একেবারে নীচের দিকে? সাম্প্রতিক সময়ে আবার নতুন করে আরও একটি সংশোধনী আনা হয়েছে, ঐ ২০২১ সালের ইনফর্মেশন এবং টেকনোলজি অ্যাক্টটিতে, যাতে বলা হয়েছে, সরকার একটি নিজস্ব সংস্থা গড়বে, যা দিয়ে তাঁরাই ঠিক করবে কোনটা ভুয়ো খবর, কোনটা প্ররোচনামূলক খবর বা কোনটা মানুষকে বিপথে চালনাকারী খবর। জানুয়ারি মাসে যে সংশোধনী আনা হয়েছিল, তার সঙ্গে সাম্প্রতিকতম সংশোধনীটির একটাই ফারাক, এক্ষেত্রে শুধু প্রেস ইনফর্মেশন বুরোর কথা বলা হয়নি, অন্যান্য সমস্ত কিছু আগের আইন মতোই হবে। সরকার, নিজেই পুলিশ, নিজেই আইনজীবী আবার নিজেই বিচারক। সরকার যদি মনে করে কোনও খবর মিথ্যে, তাহলে আগামীদিনে সেই খবর প্রচারের অভিযোগে কোনও ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে, নিজেই তাঁর বিচার করে, শাস্তির বিধানও সরকারই করবে। সংবাদপত্রের ভাষায়, সরকার নিজেই একজন একচ্ছত্র সম্পাদক, যাঁর অনুমতি ছাড়া কোনও খবরই ছাপা হবে না।

ভারতের বাকস্বাধীনতার ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কময় অধ্যায় হচ্ছে জরুরি অবস্থা। যদি খেয়াল করা যায়, তাহলে দেখা যাবে, এই নরেন্দ্র মোদী সরকার সেই কলঙ্কময় ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সমালোচক, কিন্তু তাঁরা যা আইন করে করছেন, তা তো অঘোষিত জরুরি অবস্থা। হ্যাঁ, এটা সত্যি যে যে কোনও ভুয়ো খবর, আজকের দিনে অগ্ন্যুৎপাত ঘটাতে পারে, কিন্তু তা বন্ধ করার নামে সরকারের হাতে যদি এই ধরনের ক্ষমতা চলে আসে, তাহলে তা নিয়ে কি শঙ্কিত হওয়া অন্যায়? যদিও কেন্দ্রীয় ইলেকট্রনিক্স এবং ইনফর্মেশন টেকনোলজীর রাষ্ট্রমন্ত্রী, রাজীব চন্দ্রশেখর বলেছেন, এই আইনের ফলে যদিও অনেকে আশঙ্কা করছেন, সরকারের হাতে আরও অনেক বেশি ক্ষমতা কুক্ষিগত হলো, কিন্তু তা নিয়ে ভাবনার কারণ নেই, সরকার বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিফহাল। অর্থাৎ সরকারের আইন নিয়ে সমালোচনা করার অধিকারও সরকারেরই। দেশের বর্তমান প্রধান বিচারপতি যখন বারংবার বলে চলেছেন, সংবাদমাধ্যম, দেশের গণতন্ত্র রক্ষার অন্যতম একটি স্তম্ভ, যখন বারংবার দেশের সর্বোচ্চ আদালত তাঁদের রায় এবং বক্তব্যের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, সরকারের গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করার প্রক্রিয়াকে তাঁরা ভালো চোখে দেখছেন না, তখন এই ধরনের একটি সংশোধনীর ফলে কি দেশের গণতন্ত্রই আবারও লুন্ঠিত হচ্ছে না? শিবঠাকুরের আপন দেশে কি সত্যিই আইন কানুন সর্বনেশে হল তবে?

- সুমন সেনগুপ্ত

খণ্ড-30
সংখ্যা-10