ভারতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপর চূড়ান্ত আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে
press-freedom

( দেশজুড়ে সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের স্বাধীনতা আজ কতটা আক্রান্ত, বিপন্ন, তার উপর নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ ৮ মার্চ এক অত্যন্ত তীক্ষ্ণ ও ক্ষুরধার লেখা লিখেছেন কাশ্মীর টাইমস্-এর কার্যনির্বাহী সম্পাদক অনুরাধা ভাসিন। এই লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পর আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র আলোড়ন ওঠে। বিজেপি-র প্রথম সারির নেতৃবৃন্দ এটাকে ভারত বিরোধী ষড়যন্ত্র হিসাবে দাগিয়ে হৈচৈ শুরু করে। আমরা এই লেখাটির গুরুত্ব বুঝে এখানে প্রকাশ করছি। — সম্পাদকমন্ডলী, দেশব্রতী। )

অক্টোবর ১৯, ২০২০’র সন্ধ্যে। শ্রীনগর শহরে ‘দি কাশ্মীর টাইমস্’ পত্রিকার অফিসে সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফাররা দিনের কাজ শেষ করার তাড়ায় ছিলেন। ঠিক সেই সময়ে, ঝড়ের বেগে অফিসে ঢুকলেন সরকারি কর্মকর্তারা, সঙ্গে পুলিশ। তারা প্রায় ঘাড় ধরে কর্মীদের বের করে দিয়ে, অফিসের দরজায় তালা লাগিয়ে দিলেন। সেই তালা আজও ঝুলছে।

আমি জানি, এই হানা ছিল একটা শাস্তি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নীতি নিয়ে প্রশ্ন করার ধৃষ্টতার শাস্তি! এই সংবাদপত্রটি, আমি যার কার্যনির্বাহী সম্পাদক, জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের এক স্বাধীন কণ্ঠস্বর হিসেবেই থেকেছে তার জন্মলগ্ন অর্থাৎ সেই ১৯৫৪ সাল থেকে। আমার বাবার হাতেই তার সূচনা হয়েছিল। তখন থেকে, যুদ্ধ ও সামরিক দখলদারির ঝড়ঝাপ্টার বেশ কয়েকটি দশকের দাপটের মধ্যেও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থেকেছে। কিন্তু মোদিজীর আমলে তার সংকট ঘনিয়ে এল, আর বোধ হয় তাকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। মোদিজীর দমনমূলক মিডিয়া পলিসি কাশ্মীরী সাংবাদিকতাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। সংবাদসংস্থাগুলিকে সরকারি মুখপাত্র হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করার জন্য লাগাতার হুমকি দিয়ে আর আমাদের প্রায় ১৩০ লক্ষ মানুষের এই অঞ্চলে কার্যত তথ্যের এক বিরাট শূন্যতা তৈরি করে সেই ধ্বংসপর্ব চলছে।

এবার শ্রী মোদী এই বিপর্যয়ের মডেলটির অবিকল প্রতিরূপ জাতীয় স্তরে চালু করার জন্যে পদক্ষেপ নিচ্ছেন। তার উগ্র হিন্দু-জাতীয়তাবাদী পদক্ষেপ ভারতীয় মুসলমানদের বিরুদ্ধে অসহিষ্ণুতা ও হিংসাকে স্বাভাবিক ব্যাপার করে ফেলেছে। শুধু তাই নয়, তা ইতিমধ্যেই সাংবাদিকদের নজরবন্দি ও কারারুদ্ধ করে, এবং সরকারের পছন্দসই খবরের জন্য সংবাদসংস্থাগুলির ওপর আক্রমণাত্মক কৌশল প্রয়োগ করে, ভারতের একদা-প্রাণোচ্ছল দুর্দমনীয় সংবাদমাধ্যমের ওপর ভয়ঙ্কর চাপ তৈরি করে ফেলেছে। কিন্তু এই জানুয়ারিতে ডিজিটাল মিডিয়ার নির্দেশিকার যে খসড়া সংশোধনী চালু হয়েছে, তা আরও ভয়ঙ্কর, এবার সরকার তার অপছন্দের যে কোন প্রচারবস্তুকে আটকে দেওয়ার ক্ষমতা পেয়ে গেল।

অন্যভাবে বলতে গেলে, বাকি ভারতের জন্যেও শেষপর্যন্ত হয়তো কাশ্মীরের মতো ভাগ্যই অপেক্ষা করছে।

গত ২০১৯-এ মোদী সরকার কাশ্মীর ভূখণ্ডের জনগণের থেকে কোন রায় না নিয়েই আচমকা তার স্বশাসনের মর্যাদা বাতিল করে দেয়, হাজার হাজার সেনা পাঠায় এবং ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেয়। এই শাট ডাউন প্রায় ছ’মাস স্থায়ী হয়েছিল। শ’য়ে শ’য়ে সাংবাদিকদের তখন ইন্টারনেটযুক্ত সরকার-নির্দিষ্ট একটা মাত্র সাইট থেকে রিপোর্ট পাঠানোর জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। প্রত্যেকের জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র ১৫ মিনিট সময়। তখন থেকে ইন্টারনেটের শ্লথ গতি দুঃসহ যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠেছে।

পরের বছর এমন বিধি লাগু করা হল যা সরকারি কর্মকর্তাদের সংবাদমাধ্যমের যে কোনো প্রচার্য বিষয়কে “ভুয়ো খবর, টুকলিবাজি এবং অনৈতিক বা দেশদ্রোহী” ছাপ্পা মারার আর সাংবাদিক ও প্রকাশন সংস্থাগুলিকে শাস্তি দেওয়ার অধিকার দিয়ে দিল। এসব বিধির ঘোষিত লক্ষ্য নাকি “সাংবাদিকতার সর্বোচ্চ মানকে উৎসাহিত করা” — কী নিদারুণ পরিহাস!

পুলিশ সাংবাদিকদের নিয়ম করে ডেকে পাঠায়, জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং মিথ্যে অভিযোগে ফাঁসানোর হুমকি দেয় — কখনও সেটা আয়কর লঙ্ঘন আবার কখনও সন্ত্রাসবাদ বা বিচ্ছিন্নতাবাদের ‘অভিযোগ’। বেশ কিছু বিশিষ্ট সাংবাদিক হয় আটক আছেন আর নয়তো জেল খাটছেন।

আমরা একটা ভয়ের বাতাবরণের মধ্যে কাজ করে যাচ্ছি। ২০২১-এর শেষে, আমি এক তরুণ সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলছিলাম — সাজিদ গুল — নিজের রিপোর্টিং-এর জন্যে ওকে অনেক হেনস্থা সইতে হচ্ছিল। আমাকে ও বলেছিল, গ্রেপ্তারির ভয়ে প্রতিটা রাতে ও বাইরের পোশাক পরেই ঘুমোতে যায়, বিছানার পাশেই জুতো রেখে — যেটা কাশ্মীরে একেবারেই দস্তুর নয়; সেখানে জুতো খুলে বাইরে রেখে তবে ঘরে ঢোকাটাই রীতি। যে কোনো মুহূর্তে দৌড়ে পালানোর পথ খোলা রাখতেই ওকে এটা করতে হত। গত বছর জানুয়ারিতে ছেলেটি ধরা পড়ে যায়, আজ পর্যন্ত সে হেফাজতেই আছে। অনেক সাংবাদিক নিজেদের রিপোর্ট সেল্ফ সেন্সর করছেন, অনেকে ছেড়েই চলে গেছেন। গ্রেপ্তারি এড়াতে অনেকে বিদেশে পালিয়ে গা ঢাকা দিয়ে আছেন। ভারত সরকার, দেশ ছেড়ে যাওয়া আটকাতে অন্তত কুড়ি জন অন্য সাংবাদিককে ‘নো- ফ্লাই’ তালিকায় রেখে দিয়েছে (বিমান যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে)।

কাশ্মীরে সাংবাদিকতা সব সময়েই এক বিপন্নতার মধ্যে থেকেছে। ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই এই পার্বত্য অঞ্চলকে নিজের বলে দাবি করে এসেছে। ফলে এটি দশকের পর দশক যুদ্ধ আর বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে বিপর্যস্ত থেকেছে। সাংবাদিকরা তার মাঝখানে পড়ে গেছেন। সব সময়েই তাদের একদিকে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী আর অন্য দিকে জঙ্গিদের হুমকি ও ভীতি প্রদর্শনের মধ্যে কাজ চালিয়ে যেতে হয়েছে। এরা উভয়েই কীভাবে সংবাদ করা হবে তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। কাশ্মীরে ১৯৯০ থেকে ২০১৮’র মধ্যে কম করে ১৯ জন সাংবাদিককে খুন করা হয়েছে। তবুও কাশ্মীরী সাংবাদিকতা শেষ হয়ে যায়নি, বরং নিজের বিকাশ ঘটিয়েছে। খবরের কাগজ আর নিউজ ওয়েবসাইটের সংখ্যা বেড়েছে, আর প্রতিভাবান তরুণ অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের একটি নতুন প্রজন্ম তাদের নতুন স্বচ্ছ দৃষ্টিতে কাশ্মীরের সমস্যাকে দেখেছে, তুলে এনেছে জনস্বার্থ সম্পর্কিত অনুপুঙ্খ-গবেষণানির্ভর নানা সাহসী প্রতিবেদন যা অনেক সময় সরকারকেও ছেড়ে কথা বলেনি।

কিন্তু আজ মোদী জমানায় সবটাই হারিয়ে গেছে। এই সরকারের উদ্দেশ্য হল কাশ্মীরে যে কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী কণ্ঠস্বরকে যেমন, তেমনি যারা আপোস-মীমাংসা বা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তির কথা বলে তাদেরও চুপ করিয়ে দেওয়া। কাশ্মীরী খবরের কাগজগুলো সরকারি বিজ্ঞাপন আর সংবাদমাধ্যমের ভর্তুকির ওপর যথেষ্ট নির্ভরশীল, আর সরকার এই সুযোগটা পুরোপুরি উশুল করে নেয় যাতে কাগজে যে কোন ঘটনার প্রশাসন-অনুমোদিত বিবরণটাই ছাপার ব্যাপারটা নিশ্চিত হয়। আজ ক’টি কাশ্মীরী সংবাদসংস্থা আর সরকারি নীতিকে প্রশ্ন করার সাহস রাখে! অনেকেই শুধুমাত্র ব্যবসায়ে টিঁকে থাকার জন্যে সরকারের উচ্চকণ্ঠ মুখপাত্র হয়ে উঠেছে। আমার নিজের কাগজ কোনোমতে টিঁকে আছে। ২০১৯’এ আমি ইন্টারনেট শাট ডাউনকে চ্যালেঞ্জ করে মামলা দায়ের করি। স্পষ্টতই প্রতিশোধ নিতে, সরকার আমাদের শ্রীনগরের অফিস সিল করে দেয়। আমাদের সাংবাদিকদের মধ্যে অনেকেই ছেড়ে চলে গেছেন, আমাদের কাজকর্মও চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। আজ, আমি যখন প্রস্তাব রাখলাম যে জনস্বার্থ সম্পর্কিত রিপোর্টিং-এর ক্ষেত্রে আমরা আক্রমণাত্মক অবস্থানে থাকব, কাউকে ছেড়ে কথা বলব না — আমাকে অতি সতর্ক, হাতে গোনা কর্মীদের প্রতিরোধের সামনেই পড়তে হল।

কাশ্মীরে এক তথ্যের শূন্যতা বিরাজ করছে — এই অঞ্চলে যা ঘটছে সে সম্পর্কে মানুষ যথেষ্ট তথ্য পাচ্ছেন না অথবা ভুল তথ্যে বিভ্রান্ত হচ্ছেন — গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো চেপে যাওয়া হচ্ছে, গুরুত্বহীন করে বা সরকারের উদ্দেশ্যের উপযোগী করে বিকৃত করে প্রচার করা হচ্ছে।

২০২১’এ যখন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের এক শীর্ষব্যক্তিত্ব সৈয়দ আলি শাহ গিলানি মারা যান, কাশ্মীরে এই সংবাদ সম্প্রচারিত হয়নি অথবা খুব সংক্ষেপে প্রচার করা হয়েছিল। গত মাসে সরকার যখন কয়েক হাজার বাড়ি, কর্তৃপক্ষের মতে যেগুলো নাকি সরকারি জমিতে অবৈধভাবে নির্মিত, ধূলিসাৎ (বুলডোজ) করার অভিযান শুরু করে, কাশ্মীরের একটি প্রথম সারির সংবাদসংস্থা তাকে অজ্ঞাতনামা “প্রভাবশালী জমি- হাঙরদের” বিরুদ্ধে ‘এক বলিষ্ঠ আঘাত’ বলে তাদের প্রচারে তুলে ধরেছিল। সেখানে আচমকা ঘর হারানো গরিব কাশ্মীরীদের বা সেই সব বাসিন্দা যারা মালিকানার বৈধ নথিপত্র আছে বলে দাবি করছিলেন তাদের সম্পর্কে একটি শব্দও খরচ করা হয়নি।

এক অসচেতন জনতা আর পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ, সমালোচনা ও দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত সরকার গণতন্ত্রের জন্য এক বিপদ। কিন্তু মোদীজী সারা ভারত জুড়ে এটারই পুনরাবৃত্তির অভিপ্রায় পোষণ করছেন। ডিজিটাল মাধ্যমের জাতীয় গাইডলাইনের প্রস্তাবিত সংশোধনী যা গত জানুয়ারিতে প্রকাশ্যে এসেছে তার সঙ্গে কাশ্মীরে যেসববিধি আরোপিত হয়েছিল তার এক বিস্ময়কর সাদৃশ্য আছে। এর মাধ্যমে সরকারি ফ্যাক্ট চেকাররা অনলাইন কোনো প্রচার্য বিষয়কে “ভুয়ো বা মিথ্যা” তকমা দেওয়ার ক্ষমতা পেয়ে গেলেন। এই পরিবর্তনগুলো ঘোষণার পরই সরকার প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সমালোচনামূলক বিবিসি’র তথ্যচিত্র “ইন্ডিয়া: দ্যা মোদী কোয়েশ্চেন”-এর লিঙ্ক বন্ধ করে দেওয়ার জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলিকে আদেশ দেয়। পরে ভারতীয় আয়কর কর্মীরা ভারতে বিবিসি’র অফিসে তল্লাশী চালায়। ভারতে সমালোচনার কণ্ঠগুলিকে চাপে রাখার জন্য বারবার এইরকম হানাদারি চালানো হচ্ছে।

২০১৪-তে ক্ষমতায় আসার পর মিস্টার মোদী আদালত এবং অন্যান্য সরকারি প্রশাসনযন্ত্রকে তার ইচ্ছামতো পরিবর্তন করে ধারাবাহিকভাবে ভারতের গণতান্ত্রিক ভাবাদর্শগুলির অবনমন ঘটিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত টিঁকে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সংবাদ মাধ্যম হল এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা ভারতের অধোগতিকে স্বৈরতন্ত্রের ঠিকানায় পৌঁছানোকে রুখে দিতে পারতো। কিন্তু মোদীজী তথ্য নিয়ন্ত্রণের ‘কাশ্মীর মডেলকে’ বাকি ভারতের জন্যেও চালু করতে সক্ষম হলেন, এতে শুধু সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাই নয়, ভারতের গণতন্ত্রেরও বিপদ ঘনিয়ে এল।

ভাষান্তর : জয়ন্তী দাশগুপ্ত

খণ্ড-30
সংখ্যা-9