উত্তরপ্রদেশে যোগীর সন্ত্রাস ও দায়মুক্তির রাজত্ব পুলিশী হেফাজতে টেলিসম্প্রচারসহ হত‍্যা সংগঠিত করার রাস্তা খুলে দিয়েছে
murder-in-police-custody-in-uttar-pradesh

উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথের শাসন মডেলের যে দুটি চিহ্নকে সবচেয়ে গর্বের সাথে তুলে ধরা হয় তা হল বুলডোজার আর এনকাউন্টার। রাজ্য সরকারেরই প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, যোগী আদিত্যনাথ মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর, ইউপি পুলিশ ১০,৭১৩টি এনকাউন্টার করেছে এবং অপরাধীদের চাপে রাখার ‘প্রধান কৌশল’ হিসাবে ‘এনকাউন্টার’-কে গ্রহণ করেছে। বিচার বহির্ভূত হত্যার এই কৌশলকে সরকার তার সবচেয়ে বড় অর্জন হিসেবে গর্ব করে। এই কৌশল নাকি ইউপিকে অপরাধমুক্ত রাজ‍্যে উন্নিত করেছে। কিন্তু উমেশ পালের চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যোগী আদিত্যনাথ ইউপি বিধানসভায় দাঁড়িয়ে ‘মাফিয়াদের নিশ্চিহ্ন’ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও, যোগী মডেলের এনকাউন্টার নীতির কট্টর সমর্থকরাও বোধহয় আতিক আহমেদ ও তার ভাই আশরাফ আহমেদকে পুলিশী হেফাজতেই এরকমভাবে হত্যা করার কথা ভাবেনি।

গত ছয় বছরে ১০,০০০-এরও বেশি এনকাউন্টার চালিয়েছে বলে যারা দাবি করে সেই পুলিশের হাতে কিন্তু আতিক ও আশরাফ নিহত হননি। তাঁরা নিহত হয়েছেন তিনজন বন্দুকধারী যুবকের হাতে যারা হত্যাকাণ্ডের পর জয় শ্রী রাম স্লোগান দিতে দিতে শান্ত ভাবে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে। পুলিশ নিজেদের হেফাজতে থাকা দুই ব্যক্তিকে বাঁচানোর জন‍্য কিছু করেনি। বন্দুকধারীরা নিজেরাই এসে আত্মসমর্পন না করা পর্যন্ত ওদের গ্রেপ্তার করার জন্যও পুলিশ কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। পুলিশের এই সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়তা অপরাধী মোকাবেলায় এনকাউন্টার নীতি অনুসরণ করার দাবিকেই সম্পূর্ণরূপে বাতিল করে দেয়। প্রয়াগরাজ ঘটনাস্থলটিই তো প্রকৃতপক্ষে এনকাউন্টার পরিস্থিতির নিখুঁত এক উদাহরণ ছিল, কিন্তু পুলিশ সম্পূর্ণ নীরব ও নিষ্ক্রিয় দর্শক সেজে থাকাই শ্রেয় মনে করল। এই আপাত নিষ্ক্রিয়তার পেছনে কোনো গভীর কারণ জড়িয়ে আছে তা অনুপুঙ্খ তদন্তের মাধ‍্যমেই প্রকাশিত হতে পারে।

সবরমতি জেল থেকে প্রয়াগরাজে ট্রান্সফার করা থেকে শুরু করে শেষে পুলিশী হেফাজতে খতম করা পর্যন্ত – আতিক আহমেদ মামলা পরিচালনার পুরো প্রকৃয়াটির সমস্ত ধাপেই পুলিশী কর্তব‍্যকর্মের মূল নীতির লঙ্ঘন খুবই স্পষ্ট। হেলিকপ্টারে আকাশপথে আনা অনেক দ্রুত, সহজ ও সস্তা হওয়া সত্বেও তাঁকে সড়কপথেই আনার সিদ্ধান্ত কেন নেওয়া হল সেটাই তো প্রথম প্রশ্ন। গুজরাট থেকে উত্তরপ্রদেশে আনার মিডিয়া কভারেজের দিকে তাকালে স্পষ্ট হয় যায় যে উদ্দেশ্যই ছিল সমগ্র বিষয়টিকে একটা মিডিয়া ইভেন্টে পরিণত করা এবং মাফিয়ার বিরুদ্ধে যোগী কত্ত লড়াই করছে তা বিরাট করে দেখানো। মেডিকাল চেক-আপে নিয়ে যাওয়ার পথে আতিক এবং আশরাফের সাথে মিডিয়াকে যোগাযোগ করতে দেওয়াটাও নজিরবিহীন, এবং এটাই ঘাতকদের সুযোগ করে দিয়েছিল মিডিয়া পার্সন সেজে হত‍্যার পরিকল্পনা কার্যকর করার।

গভীর রাতে মেডিকেল চেকআপ করাতে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তটিও একই রকম সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই বলেছে যে এরকম বিশেষ ঝুঁকি থাকা বন্দীর ক্ষেত্রে হাসপাতালে আনার বদলে যেখানে বন্দী ছিল সেখানে গিয়েই তো ডাক্তাররা চেকআপ করে আসতে পারত। সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি মদন লোকুর প্রশ্ন তুলেছেন যে, পরের দিন সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা না করে অত গভীর রাতে মেডিকেল চেকআপ করার কী এমন বিশেষ তাড়া ছিল? বেশ কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা মিডিয়া চ্যানেলকে বলেছেন যে ঐ বন্দুকধারীরা পুলিশের গাড়িতেই এসেছিল। মেডিকেল চেকআপের জন‍্য আতিক ও আশরাফকে যে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেই খবরও কি পুলিশই মিডিয়াকে দিয়েছিল? সাংবাদিক সেজে থাকা ঘাতকেরা খবরটা পেল কীভাবে? সংবাদ মাধ‍্যমের যেসব কর্মীরা এই ঘটনা কভার করছিলেন তাঁরা সকলেই তো পুলিশের পরিচিত স্থানীয় মানুষ - তাহলে তিনজন বন্দুকধারী, যাদের সকলেই বহিরাগত, সাংবাদিক পরিচয়ে ঘটনাস্থলে প্রবেশ করতে পারল কীভাবে?

শ‍্যুটার তিনজনের পরিচয়ও অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। তিনজন তিন ভিন্ন ভিন্ন জেলা থেকে এসেছে এবং তবু তারা অত্যন্ত সুসংহত ও সমন্বিতভাবে পুরো কাজটা সুসম্পন্ন করেছে। সমগ্র ঘটনাটি থেকে খুবই স্পষ্ট যে তারা যথেষ্ট প্রশিক্ষণ নিয়েই এবং ঘটনাস্থল সম্পর্কে সম্পূর্ণ পরিচিত হয়েই কার্য সমাধা করেছে। তাদের ব্যবহৃত অস্ত্রগুলোও বিদেশ থেকে সংগ্রহ করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল আধা-স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। এবং বেশ কৌতূহলজনক ব‍্যাপার হল, পুলিশ ওই বন্দুকবাজদের মোকাবিলা করার কোনো চেষ্টা তো করেইনি, এমনকি ওরা আত্মসমর্পণ করার পর জিজ্ঞাসাবাদ করার আগ্রহও দেখায়নি, গ্রেফতারের পর তাদের বিচার বিভাগীয় হেফাজতে পাঠাতেই রাজি হয়ে গেছে।

অন্তত একজন শ্যুটারের সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইল একটি শক্তিশালী হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সাথে সম্পর্ক প্রকাশিত করে। হত‍্যাকাণ্ডের ভিডিও ক্লিপগুলিতে শ‍্যুটারদের পরিস্কার দেখা যাচ্ছে বারবার জয় শ্রী রাম বলে চিৎকার করতে। প্রথমে এই “জয় শ্রী রাম” ছিল ভিড়-হত‍্যার চিৎকার, তারপর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবাজদের ধ্বনি, শেষে এখন হয়ে উঠল ঘাতকের স্লোগান। বন্দুকবাজরা বিখ‍্যাত হওয়ার আশা নিয়ে আতিক ও আশরাফকে হত্যা করেছে বলেও শোনা গেছে। এই তিন বন্দুকবাজ যুবকের উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, এই সত্যটি এড়ানো যাচ্ছে না যে মাফিয়াদের বিরুদ্ধে যোগী আদিত্যনাথের তথাকথিত যুদ্ধ আসলে এক হিন্দুত্ব-পোষিত নয়া মাফিয়ারাজের উত্থান ঘটাচ্ছে যেখানে যুবকেরা শিক্ষা ও মর্যাদাপূর্ণ কাজের নিরাপদ ভবিষ‍্যতের দিকে এগনোর বদলে এখন রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত অপরাধ জগতে পা রাখছে।

দেশের আইনকানুন বা গণমাধ‍্যমের নীতিনৈতিকতাকে সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে কিছু গোদি মিডিয়া চ্যানেল এখন আতিকের স্ত্রী শায়েস্তা পারভীনের রক্ত চেয়ে কদর্য চেচামেচি শুরু করে দিয়েছে। আর সঙ্ঘ বাহিনী এই টেলিসম্প্রচারিত হত্যাকাণ্ডকেই কোনো অপরাধের উপযুক্ত শাস্তি হিসাবে তুলে ধরে প্রচার চালাচ্ছে যে একমাত্র যোগীই এরকম শাস্তি দিতে পারে। মোদি যদি হয় সংঘের দুর্নীতি বিরোধী আইকন, তাহলে যোগী হল অপরাধ দমনের যুদ্ধে ওদের পোস্টার বয়। কেন্দ্রে মোদী শাসনের গত নয় বছরের অভিজ্ঞতা এবং ইউপিতে যোগী শাসনের ছয় বছরের অভিজ্ঞতা অবশ‍্য এই সঙ্ঘী প্রচারের প্রকৃত উদ্দেশ‍্য বোঝার জন‍্য যথেষ্ট। কৌশলগত স্তরে দেখলে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে মোদির ক্রুসেড বাস্তবে বিরোধীদের নিশানা বানানোর এবং বিভিন্ন শিবিরের কলঙ্কিত নেতাদের বিজেপিতে যোগদানে প্রলুব্ধ করার এক ছক মাত্র। এবং রণনীতির স্তরে, ওদের দুর্নীতি বিরোধী বাগাড়ম্বর বাস্তবে সাঁটগাট পুঁজিবাদ এবং কর্পোরেট-নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনী ব্যবস্থার নির্লজ্জ দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ারই এক আবরণ হিসেবে কাজ করেছে। একইভাবে, মাফিয়ার বিরুদ্ধে যোগীর যুদ্ধ ন্যায়বিচার ও আইনের সাংবিধানিক শাসনের মৌলিক নীতিকেই খর্ব করছে, এবং তাকে প্রতিস্থাপিত করছে এক নিরন্তর ঘৃণামূলক অপরাধ ও সামরিক হিন্দুত্ব দিয়ে।

খুন হয়ে যাওয়ার দুই সপ্তাহ আগে আতিক যখন সুরক্ষার জন্য সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছিলেন, তখন তাঁর আবেদন নাকচ করে দেওয়া হয়েছিল ‘তিনি ইতিমধ্যেই রাষ্ট্রের হেফাজতে রয়েছেন’ - এই যুক্তিতে। এখন তো পুলিশের হেফাজতে মর্মান্তিক এই হত্যাকাণ্ডের মামলাটি সামনে থাকছে। এবারে তাহলে সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ করুক। হত্যার পিছনের ষড়যন্ত্রটিকে সম্পূর্ণরূপে উন্মোচিত করুক। এই জঘন্য অপরাধের আসল মাথা ও অপরাধীদের বিচারের সম্মুখীন করার সময় এখন এসেছে। প্রতিটি এনকাউন্টারের ঘটনায় বাধ্যতামূলক তদন্তের বিধান অলরেডি আছে। রাজ্য সরকারের স্বীকারোক্তি অনুযায়ি প্রায় দুই শতাধিক ‘এনকাউন্টারে মৃত্যু’ সংঘটিত হয়েছে। এরকম সাম্প্রতিক ঘটনাগুলির মধ‍্যে অন‍্যতম হল আতিকের ছেলে আসাদের হত্যা। এইসব এনকাউন্টারের ঘটনার একটিকেও কি আদৌ কোনও বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের আওতায় আনা হয়েছে? সুপ্রিম কোর্টের সামনে এখনই উপযুক্ত সময় ইউপি সরকারকে থামানোর এবং এইভাবে লাগাতার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাওয়া থেকে বিরত করার।

পুলিশী হেফাজতে প্রয়াগরাজ হত্যাকাণ্ডকে উত্তরপ্রদেশে আইনের শাসনের পতনের একটি টেলিসম্প্রচারিত দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা চলে। এবং যখন মুসলমান ও দলিতকে আক্রমণের নিশানা বানানো মত্রাছাড়া চেহারা নিয়েছে, যারা মনে করেন যে সন্ত্রাস ও দায়মুক্তির এই বেলাগাম রাজত্ব নিয়ে অন্যদের অত ভাবার বা ভয় পাওয়ার কিছু নেই, তারা নিজেদের চোখকান একটু খোলা রাখলেই মঙ্গল। অ্যাপল কোম্পানির মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ বিবেক তিওয়ারি (লখনউ, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮), পুলিশ ইন্সপেক্টর সুবোধ কুমার সিং (বুলন্দশহর, ৩ ডিসেম্বর ২০১৮), সাংবাদিক বিক্রম জোশি (২০ জুলাই, ২০২০), ট্রান্সপোর্ট ম্যানেজার শিবম জোহরি (শাহজাহানপুর, ১২ এপ্রিল ২০২৩), কলেজ ছাত্র রোশনি আহিরওয়ার (জালাউন, ১৭ এপ্রিল ২০২৩) — এই তালিকা উত্তরপ্রদেশে প্রতি মুহূর্তেই লম্বা হয়ে চলেছে। যখন আইনের শাসন ভেঙ্গে পড়ে এবং শাসন পর্যবসিত হয় প্রাতিষ্ঠানিক অনাচার ও দায়মুক্তিতে, তখন তার গুনাগার সকলকেই দিতে হয় আজ হোক বা কাল। পুলিশী হেফাজতে প্রয়াগরাজের এই হত্যাকাণ্ড সকলের জন্যই ঘুম ভেঙে চোখ মেলে তাকানোর চূড়ান্ত এক বার্তা হওয়া উচিত।

- এমএল আপডেট এডিটরিয়াল, ১৮ - ২৪ এপ্রিল ২০২৩

খণ্ড-30
সংখ্যা-12