উৎসব যখন আনন্দের বদলে আতঙ্ক ছড়ায়
fear-instead-of-joy

- দীপঙ্কর ভট্টাচার্য

গত কয়েক বছরের মতো এ বছরও রাম নবমী দেশের বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে বিদায় নিল। বাংলায় আগে রামনবমীর তেমন চল ছিল না, কিন্তু সাম্প্রতিককালে অন্য অনেক উত্তর ও পশ্চিম ভারতীয় উৎসবের মতো রামনবমী বা হনুমান জয়ন্তীও বাংলার উৎসবের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। বারো মাসে তেরো পার্বণের রাজ্যে উৎসবের তালিকা দীর্ঘতর হলে কে আপত্তি করবে? প্রশ্নটা উৎসবের আধিক্য নিয়ে নয়, প্রশ্ন হল উৎসব কেন আনন্দের পরিবর্তে আতঙ্ক ছড়াবে?

এই আতঙ্কের উৎস অবশ্যই উৎসবের মধ্যে নিহিত নেই। বছর কয়েক আগেও মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবেই রামনবমী উদযাপিত হত। রাম নবমীর এই রূপান্তরণের সূত্রপাত সাড়ে তিন দশক আগে রাম মন্দির আন্দোলনের হাত ধরে। মর্যাদা পুরুষোত্তম রামকে প্রজাকল্যাণ ও সুশাসনের প্রতীক হিসেবে দেখা হত, স্বাধীনতা আন্দোলনে গান্ধী রামরাজ্যকে আদর্শ সমাজের কল্পনা হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। সত্য ও ত্যাগের সৌম্য প্রতিমূর্তি এই রামকে অযোধ্যা অভিযানের সময় থেকে পরিণত করা হয়েছে উগ্র হিন্দুত্বের আক্রমণাত্মক প্রতীকে। ২০১৪ তে মোদী সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে এই আক্রমণের তীব্রতা ধারাবাহিকভাবে বেড়ে চলেছে।

সামাজিক মাধ্যমে এবং ধার্মিক উৎসবের আয়োজনে আজ রাম এবং রামভক্ত হনুমান, উভয়েরই ক্রুদ্ধ চেহারা চোখে পড়ে। লঙ্কাদহন ও রাক্ষসনিধনের পুনরাবৃত্তির আহ্বানের সাথে আজ হনুমান জয়ন্তী পালিত হয়, ‘জয় সিয়া রাম’ বা ‘জয় রামজী কী’-র মতো পরম্পরাগত শুভেচ্ছা সম্বোধন আজ চাপা পড়ে যায় জয় শ্রী রাম রণহুঙ্কারে। একুশ শতকের আধুনিক ভারতে দেশের ভেতরে লঙ্কা ও রাক্ষস খোঁজার অর্থ বা পরিণতি কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। এবার রামনবমীকে ঘিরে বহু জায়গায় হিন্দুরাষ্ট্রের ব্যানার দেখা গেছে। স্লোগান উঠেছে ‘হিন্দুস্তান মে় রহনা হোগা তো জয় শ্রী রাম কহনা হোগা’। ধার্মিক উৎসবের সীমানা পেরিয়ে আজ রামনবমী হয়ে উঠেছে হিন্দু রাষ্ট্রের আগমনবার্তা প্রচারের আগ্রাসী রাজনৈতিক অভিযান।

সংবিধানে ঘোষিত ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের নীতিকে প্রত্যাখ্যান করে চৈতন্য, রামকৃষ্ণ, লালন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের বাংলার সমন্বয়ী মানবতাবাদী সংস্কৃতির বিপরীতে রামনবমীর নামে এই সংকীর্ণতা ও সহিংসতার তাণ্ডব নৃত্য যে চলতে পারে না এ কথা বাংলার সমাজ জীবনে অবশ্যই জোরের সাথে ঘোষণা করতে হবে। যত মত তত পথের উদারতাকে ছেড়ে কোনো এক মতকে চাপিয়ে দেওয়ার আগ্রাসী অভিযানকে অবশ্যই রুখে দিতে হবে। এক কথায়, ধর্মকে ফিরিয়ে দিতে হবে ধর্মের জায়গায়, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি থেকে আলাদা রাখতে হবে সমস্ত ধর্মকেই। আরও নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনাকে আজ অবশ্যই ধর্মথেকে আলাদা করতে হবে।

ধর্ম এবং জাতীয়তাবাদকে মিশিয়ে ফেললে তার দুষ্পরিণাম কী হতে পারে সেই বিভীষিকা আমরা দেশভাগের সময় প্রত্যক্ষ করেছি। পঞ্চাশ বছর আগে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ গড়ে ওঠাও চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল ধর্ম আর দেশ এক নয়, ধর্মের পরিচিতি নিয়ে বা তার ভিত্তিতে দেশ চলতে পারে না। আজ স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বার্ষিকীতে ভারতে কেন সেই সর্বনাশকে আবার ডেকে আনা হবে?

গত বছরের রামনবমী ও হনুমান জয়ন্তীতে ঘটে যাওয়া ব্যাপক হিংসার বিস্তারিত তথ্য সংকলিত করে এ বছর রামনবমীর আগে আইনজীবী ও নাগরিক সমাজের উদ্যোগে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে দেখা যায় রামনবমীর শোভাযাত্রা নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে প্রশাসনিক গাফিলতি ও ব্যর্থতা হিংসার এক বড় কারণ। কিন্ত এবার আবার সেই একই ছবি দেখা গেল। রামনবমীর পরেও বিভিন্ন জায়গায় শোভাযাত্রার অনুমতি, অপর্যাপ্ত পুলিশী বন্দোবস্ত এবং পূর্বপরিকল্পিত হিংসা রোধে চূড়ান্ত ব্যর্থতা। নালন্দার বিহারশরিফে ঐতিহ্যবাহী আজিজিয়া মাদ্রাসা এবং সাড়ে চার হাজারের বেশি পুস্তক সংরক্ষণকারী লাইব্রেরি জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনা রামনবমীর আড়ালে সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে।

হিংসার আশঙ্কা থাকুক বা না থাকুক, কোন ঘটনা ঘটুক বা না ঘটুক, কিছু মৌলিক নীতি অবশ্যই সর্বত্র মেনে চলা উচিত। রামনবমীর শোভাযাত্রায় তরবারি বা কোনো আগ্নেয়াস্ত্র কেন ব্যবহৃত হবে? বুলডোজার নিয়ে কেন মিছিল চলবে? মিছিলকে কেন কোনো সংবেদনশীল এলাকা দিয়ে যেতে দেওয়া হবে? মিছিলে কেন উস্কানিমূলক এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণা বর্ষণকারী স্লোগান, সঙ্গীত বা ভাষণ চলবে? সহিংসতা ও ঘৃণাবর্ষণের উপর নিষেধাজ্ঞার শর্তসাপেক্ষেই শোভাযাত্রার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। এই শর্ত যাতে পালিত হয় সে ব্যাপারে প্রশাসনকে কড়া নজর রাখতে হবে এবং শর্তলঙ্ঘন হলে দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে অপরাধীদের শাস্তিদানের ব্যবস্থা করতে হবে। আইনের শাসনে এই প্রশাসনিক দায়বদ্ধতার প্রশ্নে কোনো শিথিলতার জায়গা থাকতে পারে না।

সমাজ ও প্রশাসনের ভূমিকার পাশাপাশি রাজনীতি, বিশেষ করে নির্বাচনের সঙ্গে সাম্প্রদায়িক হিংসা ও মেরুকরণের প্রশ্ন অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। হিন্দী ও ভোজপুরী ভাষার বিপ্লবী কবি গোরখ পান্ডে রচিত প্রায় চার দশক আগের একটি ছোট কবিতার শেষ কয়েকটি পংক্তি মনে আসছে। ইস বার দাঙ্গা বহুত বড়া থা/ খুব হুই থি/ খুন কী বারিশ/ অগলে সাল অচ্ছি হোগী/ ফসল/ মতদান কী - এ বছর দাঙ্গা ছিল অনেক বড়/ রক্তের বিপুল বর্ষণে/ আগামী বছর ঘরে উঠবে/ ক্ষেতভরা ভোটের ফসল। বিহারশরিফের আজিজিয়া মাদ্রাসার ধোঁয়া থামতে না থামতেই পাশের জেলা নওয়াদাতে গর্জে উঠলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। কোনও রকম রাখঢাক না করেই সোজা বললেন – ‘লোকসভা নির্বাচনে বিহারের চল্লিশটি আসনই মোদীজীকে দিন আর পরের বছর বিধানসভায় বিজেপিকে দিন স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা। আমরা দাঙ্গাকারীদের উল্টে ঝুলিয়ে দেব।’

অমিত শাহের বক্তব্যের অর্থ খুবই স্পষ্ট। তথাকথিত ধর্মসংসদের মঞ্চ থেকে যেভাবে এর আগে মুসলিম জনগণের গণহত্যার ডাক দিতে আমরা শুনেছি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও ঘুরিয়ে সেই কথাই বললেন। পাঠকের হয়তো স্মরণে থাকবে গুজরাত নির্বাচনে অমিত শাহ দাবি করেছিলেন গুজরাতে বিজেপি এবং রাজ্য সরকার দাঙ্গাকারীদের এমন শিক্ষা দিয়েছে যে রাজ্যে স্থায়ী শান্তি কায়েম হয়েছে। অমিত শাহের ভাষায় দাঙ্গাকারী কারা নিশ্চয়ই বুঝতে আমাদের অসুবিধে নেই। বিলকিস বানো ও তাঁর পরিবারের গণধর্ষণ ও গণহত্যার মামলায় যারা জেলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দন্ডিত হয়েছিল তাদের তো স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বার্ষিকীতে কারামুক্ত করে বীরোচিত সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছে। নিশ্চয়ই অমিত শাহের ভাষায় তারা দাঙ্গাকারী নয়। দাঙ্গাকারী, বিদেশী আক্রমণকারী, অনুপ্রবেশকারী, সন্ত্রাসবাদী থেকে শুরু করে উইপোকা, এই সমস্ত সাংকেতিক ভাষাই সংঘ পরিবারের অভিধানে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য ব্যবহৃত হয়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন উল্টে ঝুলিয়ে দেওয়ার কথা বলেন তখন আমাদের মনে সংবিধানসম্মত আইনের শাসনের ভরসা জেগে ওঠে না, চোখের সামনে ভেসে ওঠে পুলিশী অত্যাচার, সাম্প্রদায়িক গণহত্যা এবং ভীড় হিংসার শিকার সহনাগরিকদের অসহায় চেহারা।

উৎসব যখন আতঙ্ক ছড়ায় আর সাম্প্রদায়িক হিংসার আগুনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন ভোটের ভাষণ দেন তখন বুঝতে অসুবিধে হয় না রামনবমীকে ঘিরে হিংসার ঘটনা আসলে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের এক গভীর অসুখের লক্ষণ। রবীন্দ্রনাথের ভারততীর্থ এই অসুখ সারিয়ে সুস্থ হয়ে উঠুক, হিন্দুরাষ্ট্রের বিপর্যয় থেকে মুক্তি পাক আম্বেদকারের সংবিধানে বর্ণিত ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারত।

খণ্ড-30
সংখ্যা-10