পশ্চিম বাংলার কৃষি — তার গতিপ্রকৃতি ও সংকট
dynamics-and-crisis

পশ্চিম বাংলা কৃষি সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। এই প্রবণতা আজকের নয়, ১৯৯০ থেকেই আমাদের এই রাজ্যে কৃষির স্থবিরতা ফুটে ওঠে। বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের শাসন বা মমতার নেতৃত্বাধীন সরকারের তিন তিনবার নিরবচ্ছিন্ন শাসনকাল যে কৃষি অর্থনীতি বা রাজ্যের সার্বিক আর্থিক উন্নয়নে সহায়ক হয়ে উঠল না, তা বলাই বাহুল্য। অন্যভাবে বলা যায়, রাজ্যের মসনদে স্থায়ী শাসন আমাদের রাজ্যে কৃষি বা শিল্প বা সামগ্রিক অর্থনীতির বিকাশ ঘটাতে ব্যর্থ। ২০০৮ সালে রাজ্য বিধানসভায় ২৯৪টি আসনের মধ্যে ২৩৪টি আসন বামফ্রন্টের পক্ষে থাকলেও তখন থেকেই কৃষি বা শিল্পে পতনের লক্ষণগুলো প্রকট হতে শুরু করে।

বর্তমানে ফিরে আসার আগে একবার পেছনের দিকে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। বাম জমানায় মানব উন্নয়নের সূচকের মাপকাঠিতে ১৭টি প্রধান প্রধান রাজ্যের সাপেক্ষে বাংলা ছিল ১০ নম্বরে। তখন গ্রাম বাংলায় মাত্র ৩২ শতাংশ পরিবার বিদ্যুতের সংযোগ পেয়েছিলেন, যা এই রাজ্যকে দেশের মধ্যে সেই সময়ে নামিয়েছিল ১৩ নম্বরে। স্বাক্ষরতার মাপকাঠিতে কিছুটা ভালো অবস্থানে থাকলেও পড়ুয়ারা স্কুলে গড়ে ৪.৪ বছর টিকে থাকত। সবার নিচে বিহারের অবস্থান থেকে যা ছিল মাত্র একধাপ উপরে। সেই সময় থেকেই অন্য রাজ্যের তুলনায় এই রাজ্যে প্রাইমারি স্তরে স্কুলছুটের গড় হার খুব বেশি ছিল। এতদসত্ত্বেও বামফ্রন্ট সংসদীয় রাজনীতিতে কিভাবে তার আধিপত্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়, তার আলোচনার পরিসর এটা নয়। (তথ্যসূত্রঃ দ্য ইকনমি অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল, রতন খাসনবিস, ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি, ২৭ ডিসেম্বর, ২০০৮)।

সম্প্রতি এক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি’র ২২ এপ্রিল ২০২৩ সংখ্যায়। লেখকদ্বয় : সোহম ভট্টাচার্য, ইন্দ্রনীল দাসগুপ্ত। সেখানে তাঁরা রাজ্যের কৃষি সম্পর্কে যে সমস্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, তা সংক্ষিপ্তভাবে এখানে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।

১) ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে-৫’র সর্বশেষ সমীক্ষায় (২০১৯-২০) দেখা যাচ্ছে, রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে দুই-তৃতীয়াংশ পরিবারের (৬৫.২ শতাংশ) হাতে এক ছটাকও কৃষি জমি নেই। গ্রাম বাংলার প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল — কৃষিজীবী পরিবারগুলো অত্যন্ত দ্রুত গতিতে তাদের জমি খোয়াচ্ছে। উল্লিখিত সংস্থাটি যখন ১৯৯৮-৯৯ সালে এনিয়ে সমীক্ষা চালায় তখন দেখা যায়, গ্রামাঞ্চলে কৃষি জমি খোয়ানো পরিবারের সংখ্যা প্রায় অর্ধেক, ৫০.৮ শতাংশ। যত দিন গড়াচ্ছে, ততই জমি খোয়ানোর প্রবণতা বাড়ছে। অর্থাৎ, বাম জমানায় যে প্রবণতার শুরু, তৃণমূলের ১২ বছরের শাসনে তা আরও গতি পেয়েছে।

২) গ্রাম বাংলায় এখন কৃষিকে প্রধান জীবিকা করে টিকে থাকা পরিবারের সংখ্যা আরও কম। আর, এর মধ্যেও রয়েছে বিরাট তারতম্য। ২০২০’র পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে (যা কোভিডের আগে করা হয়েছিল) থেকে উঠে আসছে সমগ্র গ্রামীণ পরিবারের মধ্যে ২৪.১ শতাংশ কৃষিতে স্বনিযুক্ত, অর্থাৎ, যাদের আয়ের প্রধান উৎসই হল কৃষিতে স্বনিযুক্ত শ্রম। এই বর্গকে ব্যাপক অর্থে কৃষিজীবী পরিবার হিসাবে গণ্য করা হচ্ছে।

৩) যে সমস্ত পরিবারগুলোর কাছে আয়ের প্রধান উৎস এখনও কৃষি রয়েছে, অত্যন্ত ক্ষুদ্র জোতের কারণে কৃষি থেকে আয়ের প্রধান রাস্তাও দ্রুতই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সমীক্ষা দেখিয়েছে, রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে ৮০ শতাংশ কৃষি জোতের আকার হল ০.৫ হেক্টারের কম। আর, গড়ে, যা ০.২ হেক্টার। এত ক্ষুদ্র জোতে চাষবাস করে বেঁচে বর্তে দিন গুজরান করার মতো আয় ওই জমি থেকে সম্ভব নয়। ফলে, ওই সমস্ত পরিবারগুলো বিরাট পরিমাণে অ-কৃষি ক্ষেত্রের উপর নির্ভরশীল। ফলে বলা যায়, ৮০ শতাংশেরও বেশি কৃষিজীবী পরিবারগুলো, যাদের নিম্নতম স্তরটি হচ্ছে প্রান্তিক কৃষক, তাঁদের সর্বহারাকরণ ঘটছে। ২০০২-০৩ সালে বাম জমানায় এই হার ছিল ৭০ শতাংশ।

৪) কৃষিকাজে স্বনিযুক্ত ব্যক্তিদের বয়সের হারও বিগত দশকে বদলেছে। বর্তমানে কৃষিতে স্বনিযুক্ত কাজে নিয়োজিত ব্যক্তির গড় বয়স ৪৫’র বেশি। এক দশক আগে যা ছিল ৩৭.৫ শতাংশ।

৫) বাংলার কৃষকদেরও বয়স বেড়ে গেছে। তাঁরা এখন অ-কৃষি কাজের উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। কৃষিজীবী পরিবারগুলোর মধ্যে ছোট্ট একটা অংশের হাতে রয়েছে ০.৫ হেক্টারের বেশি জমি, যেখান থেকে তাঁরা প্রয়োজনীয় উদ্বৃত্ত আহরণ করে দিন কাটান। কিন্তু অবশিষ্ঠ গরিষ্ঠাংশ সব কিছু খুইয়ে সর্বহারা হয়েছে। লেখকদ্বয়ের অভিমত, এই কারণে উত্তর-পশ্চিম ভারতের চাষিদের মতো এরাজ্যের বৃহদাংশ কৃষক কৃষি উপকরণের, চাষবাসের ক্রমাগত ব্যয় বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আলোড়িত হন না, কারণ বিপুল সংখ্যক কৃষকদের কাছে অ-কৃষি কাজই উপার্জনের প্রধান উৎস।

৬) ২০১৯-২০ সাল পর্যন্ত কৃষিতে অনিয়মিত বা ক্যাজুয়াল মজুর, যাদের কাছে কৃষিই উপার্জনের প্রধান অবলম্বন — এই সংখ্যাটা ছিল সমগ্র কৃষিজীবী পরিবারের ১৯ শতাংশ। ২০১১-১২ সালে এই সংখ্যাটা ছিল ৩৪ শতাংশ। কৃষিতে অনিয়মিত মজুর হিসাবে গ্রামীণ মজুরদের যুক্ত থাকার হার বর্তমানে প্রায় ২১ শতাংশ। এই তথ্য থেকে লেখকেরা যে সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছেন তা হল, বাংলার কৃষি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের স্থিতিস্থাপকতা ক্রমেই কমছে, আর তার অন্যতম কারণ হল বেশ কিছু ক্ষেত্রে শ্রম সাশ্রয়কারী যন্ত্র কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। নানা তথ্য দিয়ে তাঁরা দেখিয়েছেন, ২০১১-১২-তে হেক্টর পিছু ধান চাষের জন্য গড়ে দৈনিক আট ঘন্টা হিসাবে ১৪৮.২ শ্রম দিবস ব্যবহৃত হয়েছিল, যা ২০১৯-২০-তে ১২৪.২ শ্রম দিবস অর্থাৎ ১৬ শতাংশে নেমে এসেছে। এই সময়কালে এরাজ্যে বরো চাষের জমির পরিমাণও বেশ খানিকটা হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছে। সেচের খরচ ক্রমে বাড়ার কারণও এর অন্যতম।

৭) কৃষিক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তি স্থান না পেয়ে যে গ্রামীণ উৎপাদন ক্ষেত্রে স্থানান্তরিত হচ্ছে, তা কিন্তু নয়। বরং আমাদের রাজ্যে ঘটছে ঠিক তার বিপরীত। গ্রামীণ উৎপাদন শিল্পে গ্রামীণ শ্রমশক্তি জায়গা করে নেওয়া বিগত দশকে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছে ৪.৫ শতাংশ বিন্দুতে। ২০১১-১২-তে ১৬ শতাংশ থেকে নীচে গড়িয়ে ২০১৯-২০ সালে ১১ শতাংশের সামান্য উপরে দাঁড়িয়েছে।

উৎপাদন শিল্পে গ্রামীণ শ্রমশক্তি স্থানান্তরিত হওয়ার বদলে তা বড় মাত্রায় যেখানে জায়গা খুঁজে নিয়েছে তা হল নির্মাণ ক্ষেত্র। এখন নির্মাণ শিল্পের গোটাটাই অনিয়মিত মজুর। গ্রামীণ বাংলায় মহিলা শ্রমিকদের অংশগ্রহণ গত এক দশকে মোটেই বাড়েনি।

বাংলার গ্রামে এই বদল, শ্রেণিশক্তিগুলোর মধ্যে ভারসাম্যের এই পরিবর্তন, কৃষি অর্থনীতিতে ঘনিয়ে আসা গভীর সংকট আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে কঈ প্রভাব ফেলে তা ভবিষ্যৎই বলবে। তবে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, গ্রাম বাংলায় দারিদ্রতা, সর্বহারাকরণ বিরাট গতিতে বাড়ছে, বিপুল সংখ্যক গ্রামীণ শ্রমশক্তি পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে পাড়ি দিচ্ছেন ভিনরাজ্যে উন্নত মজুরির সন্ধানে। এখন দেখা যাচ্ছে শুধু পুরুষই নয়, গোটা পরিবার নিয়েই ভিনরাজ্যে চলে যাওয়ার এই প্রবণতা শুরু হয়েছে।
গভীর সংকটে নিমজ্জিত বাংলার গ্রাম্যজীবন।

- অতনু চক্রবর্তী

খণ্ড-30
সংখ্যা-14