ক্ষমতার দম্ভ
arrogance-of-power_0

‘চায় পে চর্চা’ তাহলে বঙ্গ রাজনীতিতে মান্যতা পেয়ে গেল! এখন আর তা প্রধান বিরোধীদলের সর্বভারতীয় সহ সভাপতির একচেটিয়া ব্যাপার নয়। রাজ্যের শাসকদলের সর্বভারতীয় সম্পাদকও উত্তরবঙ্গে ‘নবজোয়ার’ কর্মসূচিতে এসে চা-পান পর্বে জনসংযোগ সারছেন। কর্মী সমর্থকদের সাথে তো বটেই, জনতার ছেঁড়া ছেঁড়া ভীড়ের মানুষজনের সঙ্গেও টুকরো আলাপ চলছে।

দিন কয়েক আগে তপনের চক সাথীহারা গ্রামে চলছিল সেই চা-পর্ব। সেখানেই ঘটল সেই ঘটনা। তিনি সেই তিন লাঞ্ছিতা আদিবাসী নারীকে নিজের হাতে চা এগিয়ে দিলেন, তাদের সঙ্গে চা খেলেন আর আলাদা করে তাদের সঙ্গে কথাও বললেন! অবশ্য ‘দলিত’ পরিবারে মধ্যাহ্নভোজনও করেছিলেন ক’দিন আগে তৃণমূলের যুবরাজ। আহা, ভোট বড় বালাই! (তিনি ধন্য হয়েছিলেন, না ধন্য করেছিলেন সেটা পাঠক বুঝে নিন।)

হ্যাঁ, সমস্ত রাজনৈতিক দল যেদিন ডাঃ বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকরের জন্মজয়ন্তী পালন করছিল তার মাত্র দিন সাতেক আগের ঘটনা। দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাটের তপন থানার বাসিন্দা তিন আদিবাসী মহিলাকে বিজেপি থেকে আবার তৃণমূলে ফিরে আসার আগে এক ভয়ঙ্কর ‘প্রায়শ্চিত্ত’ করতে হয়েছিল। তাদের বালুরঘাট কোর্ট মোড় থেকে নাকে খত দিয়ে দণ্ডী কাটতে কাটতে তৃণমূলের দলীয় কার্যালয়ে ঢুকতে হয়েছিল। সেই ‘প্রায়শ্চিত্তের’ নিদান দিয়েছিলেন মহিলা তৃণমূলের জেলা সভানেত্রী — এমনটাই ছিল অভিযোগ। আদিবাসী সমাজ তার গ্রেপ্তারির দাবিতে পথে নেমে বিক্ষোভ দেখিয়েছিল। তাকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে — এটাও তাদের দাবি ছিল। রাজ্যের অভিজাত বুধমণ্ডলী অবশ্য এই বর্বরতার অভিঘাতে কতটুকু বিচলিত হয়েছিলেন তা জানা নেই। তবে বঙ্গ বিজেপি’র শীর্ষ নেতৃত্ব সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে যা যা করার, করে ফেলেছিলেন। যেখানে যেখানে নালিশ করার করেছেন। এরাজ্যে ‘দলিত’, ‘আদিবাসী’, ‘দরিদ্র’ মানুষের, বিশেষত মহিলাদের ‘সুরক্ষা’ নিয়ে তারা বড্ড ‘ভাবিত’ কিনা! অন্য রাজ্যে তাদের জন্যে বিজেপি’র ‘বুলডোজার’ তৈরি থাকে — তাতে কী!

যাই হোক, পুলিশ ‘ধরি মাছ, না ছুঁই পানি’ করে গত ১৩ এপ্রিল ২০২৩ জাতীয় মহিলা কমিশনের কাছে এক রিপোর্ট পেশ করে জানিয়েছিল — এখানে কোনও অপরাধের ঘটনা ঘটেনি এবং মহিলারা নাকি ‘স্বেচ্ছায়’ দণ্ডী কেটেছেন। কিন্তু তাও ‘ভীষণ কর্তব্যনিষ্ঠ’ পুলিশ দুই যুবককে গ্রেফতার করে। তারা আবার অচিরে জামিনও পেয়ে যায়। আর তৃণমূল শীর্ষনেতৃত্ব আদিবাসী ক্ষোভের আঁচ পেয়ে ঐ জেলা সভানেত্রীকে পদ থেকে সরিয়ে সেখানে এক আদিবাসী মহিলাকে বসিয়েছে। তাকে (প্রদীপ্তা চক্রবর্তী) বালুরঘাট পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান পদ থেকেও সরানো হয়েছে। (এই মহিলা অবশ্য আগেও প্রকাশ্য ভাষণে কুকথা বলে সংবাদমাধ্যমের সমালোচনায় এসেছিলেন।)

কিন্তু প্রশ্ন হল, ‘স্বেচ্ছায়’ দণ্ডী কাটার পরেও পুলিশ কেন দু’জনকে গ্রেফতার করল? আর ঐ নেত্রী যদি নাই দোষী হন তাহলে তাকে পদ থেকে সরানো হল কেন? আর যদি দোষী হন তাহলে তাকে পার্টির তরফে কঠোর সাজা দেওয়া হলনা কেন? এই ব্যাপারে পুলিশ যথাযথ তদন্ত করল না? এমন একটা শাস্তিযোগ্য অপরাধের প্রকৃত দোষীর উপযুক্ত সাজা আদৌ হবে কি?

আসলে এই জঘন্য ঘটনা সমাজ বা রাজনীতি’র কাছে ততটা ন্যক্কারজনক হয়ে উঠতে পারেনি যেহেতু লাঞ্ছিতারা একে ‘দরিদ্র’, তায় ‘আদিবাসী’, তায় আবার ‘মহিলা’। সমাজের গভীরে ঘৃণ্য ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতন্ত্র, নারীবিদ্বেষ, জাত পাত বর্ণের (এমনকি গাত্রবর্ণও!) বিভাজন যে ভয়ঙ্কর শিকড় চারিয়ে দিয়েছে তাকে উন্মূল করা এক কঠিনতম কাজ। একমাত্র সমাজ বদলের লক্ষ্যে কঠোর শ্রেণিসংগ্রামের হাত ধরেই এগোতে পারে সেই কাজ! আর সেইজন্যই এটা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া সাপেক্ষ কিন্তু প্রতি মুহূর্তের লড়াই। ‘চায়ের কাপে’ সেই লাঞ্ছনার অপমান অভিমান মুছে যাওয়ার নয় — এটা তৃণমূলের যুবরাজকে বুঝতে হবে! সবটাই ভোটের রাজনীতির নিখুঁত পাটিগণিত নয়। আজ ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুরের কুড়মি সমাজও তাদের ১২ দফা দাবি নিয়ে রাস্তায় জোরালো আন্দোলনে নেমেছে। সেই আন্দোলনকে ‘খালিস্থানপন্থী’দের মতো সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের তকমা দিয়ে একেবারে মুখোমুখি সংঘাতে নেমে গেলেন ক্ষমতার শাঁস জলে পুষ্ট তৃণমূলের দুই অর্বাচীন নেতা। ক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীরা তাদের কুশপুতুল দাহ করছে। ক্ষমতার দম্ভ এইভাবেই শাসককে জনবিচ্ছিন্ন করে তোলে। পায়ের নিচে মাটি সরে যায়, চোরা বালি ক্রমশ গ্রাস করে নেয়। কালিয়াগঞ্জের ঘটনা থেকে শাসকদল ও তার প্রশাসন আদৌ কি কিছু শিক্ষা নেবে?

- জয়ন্তী দাশগুপ্ত

খণ্ড-30
সংখ্যা-14