‘এআই’ দানবকে বোতলবন্দি কি করা যাবে?
AI-monster

ফ্রাঙ্কেনস্টাইন এবার তার সৃষ্টিকর্তা সহ গোটা মানবজাতিকেই গোগ্রাসে গিলতে উদ্যত হল। তার সর্বগ্রাসী ক্ষিধে, বীভৎস বিভীষিকাময় অবয়বে আতঙ্কিত খোদ কৃত্রিম মেধা বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (এআই) আবিষ্কর্তা জিওফ্রে হিন্টন। তিনি তাঁর জীবনের প্রায় শেষ লগ্নে এসে নিজের কর্মক্ষেত্র গুগুল থেকে পদত্যাগ করলেন এই দানব সম্পর্কে গোটা মানবজাতিকে সতর্ক করতে। এতদিন পর তাঁর ঘুমিয়ে থাকা বিবেক হঠাৎ জাগ্রত হওয়ায় নিন্দুকেরা বাঁকা হাসি হাসছেন।

মাইক্রোসফট মদতপুষ্ঠ স্টার্ট আপ ওপেন এআই বিরাট শক্তিধর চ্যাটজিপিটি বাজারে আনার পর এক আলোড়ন পড়ে গেছে। আত্মপ্রকাশের মাত্র দু’মাসের মাথায় এই এআই’এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ কোটি ছাড়িয়ে যায়, যা একটা রেকর্ড। বড় বড় টেক কোম্পানিগুলো ব্যাপক সংখ্যায় কর্মী কমিয়ে সেই কাজগুলো এআই মারফত করানোর জন্য বিপুল আর্থিক বিনিয়োগ করছে। ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামও জানিয়েছে ২০২৭’র মধ্যে ৮৩ মিলিয়ন কাজ উবে যাবে। মানুষের মেধা, দক্ষতাকে বহুগুণ ছাপিয়ে যাওয়া এই এআই আজ পৃথিবীর বুকে সাক্ষাৎ এক মানুষখেকো দৈত্য। অল্প সময়ে অত্যাধিক মুনাফা আদায়ের লক্ষ্যে অন্ধ বেপরোয়া কর্পোরেট দুনিয়া কল্পনাতীত সর্বনাশকে সযত্নে ডেকে আনল।

২০১৪’র ডিসেম্বরেই বিশ্বশ্রুত পদার্থবিদ স্টিফেন হকিন্স বলেছিলেন, “উন্নত ধরনের এআই গোটা মানব জাতির পতন ডেকে আনবে”। এলন মাস্ক বলেছেন, “এটা মানবজাতির অস্তিত্বের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিপদ, যা পারমানবিক বোমার থেকেও ভয়ংকর”। টুইটারকে নিজের মুঠোয় আনার পর যে এলন মাস্ক মুহূর্তের মধ্যে ব্যাপক সংখ্যায় কর্মীদের ছাঁটাই করলেন, তিনিই আজ এই কৃত্রিম মেধার মধ্যে কাজ খোয়ানোর মারাত্মক বিপদ খুঁজে পেলেন। এমনই পরিহাস। ওপেন এআই’এর চ্যাটজিপিটি এবং অন্যান্য সংস্থাকে টেক্কা দিতে মাস্ক বাজারে আনছেন ‘ট্রুথ জিপিটি’র মতো এআই। তাঁর দাবি, এই নতুন প্রযুক্তির মূল লক্ষ্য হবে ‘পাথ টু সেফটি’, যার অর্থ এটা গোটা মানবজাতির মঙ্গলার্থে নাকি ব্যবহৃত হবে। ইতিমধ্যে মাস্ক, অ্যাপেলের অন্যতম কর্ণধার স্টিভ ওজনিয়াক, দুনিয়াব্যাপী স্বনামধন্য এআই’এর বিজ্ঞানী সহ প্রায় ১০০০ জন এক গণস্বাক্ষর করে আবেদন জানিয়েছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলি তৈরি না হওয়া পর্যন্ত অন্তত ৬ মাসের জন্য এআই’এর সমস্ত কাজকর্মের উপর স্থগিতাদেশ জারি করা হোক। এমন এক প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হোক যারা শুধু এআই কার্যকলাপের উপরই নজর রাখবে না, বরং তার সঙ্গে সঠিক পদ্ধতি ও তার সীমারেখা নির্ধারণ করবে যেখানে এআই’এর প্রবেশ হবে নিষিদ্ধ। অবস্থা এতই গুরুতর যে এই প্রথম বাইডেন প্রশাসন ওয়াইট হাউসে গুগুল-অ্যাল্ফাবেট-মাইক্রোসফট, গুগুল সাহায্যপুষ্ঠ এনথ্রোপিক, চ্যাটজিপিটির প্রস্তুতকারক ওপেন আই’এর সিইওদের নিয়ে উচ্চপ্রর্যায়ের এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক ডাকে, যেখানে উপস্থিত ছিলেন উপরাষ্ট্রপতি কমলা হ্যারিস, আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সর্বময় কর্তাব্যক্তি, এমনকি তিনটি সেনাবাহিনীকে নিয়ে গঠিত অখন্ড সংস্থার প্রধান কর্ণধার ও হোমচোমড়া আমলাকুল! অল্পক্ষণের জন্য বাইডেন সেই বৈঠকে হাজির ছিলেন। বৈঠকের পর হ্যারিস বলেন, “আমরা ওই সমস্ত বেসরকারি সংস্থাগুলোকে বলেছি যেন তারা যথাযথ নীতিসম্মত আচরণ বিধি, নৈতিকতা ও আইনানুগ পদ্ধতি অনুসরণ করে তাদের পণ্যগুলোর ক্ষেত্রে সুরক্ষাজাল ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করে”। বাইডেন বলেছেন, “আপনারা যা করছেন তার মধ্যে যেমন রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা, তেমনি নিহিত রয়েছে মারাত্মক বিপদ”।

‘রোবো স্যাপিয়ান্স’ বনাম ‘হোমো স্যাপিয়ান্স’এর এই অস্তিত্ববিনাশী যুদ্ধে কে জিতবে কে হারবে তা এখনো নির্ধারিত হয়ে যায়নি। এই দানবকে বশ মানাতে কি পারবে মানবসভ্যতা, তার অগ্নিপরীক্ষা আজ সামনে।

খণ্ড-30
সংখ্যা-14