তিল তিল মরণেও জীবন অসংখ্য ... ... জীবনকে চায় ভালবাসতে!
even-in-the-death

আর জীবনের জন্য, ভালোবাসার জন্য এই অন্তহীন পথচলার শ্বাশত শপথ নিয়ে এবারের মে দিবস আবার নতুন শিখরে উঠল। শুধু আমাদের দেশেই নয়, সারা বিশ্বজুড়ে এবার মে দিবসে হাজার হাজার শ্রমিক আরও একবার নিজেদের শ্রেণিগত আত্মপ্রকাশ ঘটিয়ে কর্পোরেট ও দেশে দেশে শাসকবর্গের বিরুদ্ধে হুশিয়ারী দিয়ে জানান দিলেন — লড়াই আজ রাস্তায় নেমে এসেছে। প্রতিরোধ হবে। শাসকের আইনকে করা হবে অস্বীকার।

এদিকে, এই অভূতপূর্ব শ্রেণি উত্থানের ভাষাকে যারা পড়তে পারে না, কর্পোরেট স্বার্থবাহী প্রচার মাধ্যমের কয়েকটি প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্র এই মে দিবসেই মোদী সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে, জনসংখ্যায় চিনকে টপকে যাওয়ার পর এবার চিন থেকে সরে আসতে চাওয়া উৎপাদন শিল্পগুলোকে এদেশে আকর্ষণ করতে শ্রম আইনকে আরও শিথিল করা হোক। ইতিমধ্যে, অ্যাপেল ও তার সরবরাহকারী ফক্সকন্, শ্রমিকদের নির্মম দমনে ইতিমধ্যেই দুনিয়া জুড়ে কুখ্যাতি কুড়োনো এই তাইওয়ান সংস্থাটি যাতে কর্ণাটকে পা রাখতে পারে তারজন্য ওই রাজ্যে শ্রম আইনকে শিথিল করা হচ্ছে। ১২ ঘণ্টার শ্রম দিবস, নাইট শিফটে মহিলা কর্মীদের নিয়োগ, ঢালাও কন্ট্রাক্ট শ্রমিক নিয়োগ, ন্যূনতম মজুরি আইনকে প্রায় তুলেই দেওয়া প্রভৃতি শর্তে নিয়োগকর্তাকে এই বিজেপি শাসিত রাজ্য দিচ্ছে অবাধ ছাড়। তামিলনাড়ুও এই লক্ষ্যে সেই রাজ্যের ফ্যাক্টরি আইনকে শিথিল করে। সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের তীব্র প্রতিরোধে তামিলনাড়ু সরকার তা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।

ভারতে ৬ কোটি ৩ লক্ষ শিল্প সংস্থার মধ্যে মাত্র ১০ লক্ষ শিল্প সংস্থা ভারতের বর্তমান শ্রম আইনের অধীনে রয়েছে। বাকি সংস্থাগুলো ছোট মাঝারি, যেখানে বিপুল সংখ্যক ইনফর্মাল শ্রমিক, প্রায় ৯০ শতাংশ কর্মরত। ২০১৯’র ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্টেই বিশ্বব্যাঙ্ক জানিয়েছিল, ভারত ২০৪৭এ স্বাধীনতার শতবর্ষে পা রাখবে। তারমধ্যে বিশ্বের মধ্যম বর্গীয় অর্থনৈতিক দেশে নিজেকে রূপান্তরিত করতে হলে স্বনিযুক্ত বা ইনফর্মাল নয়, তাকে আরো বেশি সংগঠিত ক্ষেত্রে, নিয়মিত ধরনের বেতনভুক কাজ সৃষ্টি করতে হবে। এদিকে, ক্ষুদ্র এই সংগঠিত শ্রমিকদেরও সমস্ত শ্রম আইনের বাইরে বার করার সওয়াল করে আসছে দেশি বিদেশি কর্পোরেট, তাদের আজ্ঞাবহ সংবাদ মাধ্যম ও মোদী সরকার। যার পরিণতিতে আনা হল কর্পোরেট স্বার্থবাহী চারটে শ্রমকোড। শ্রমিকদের উচ্চহারে বেতন বা মজুরি যে কর্পোরেট জগতে লোকসান ডেকে আনছে, বাস্তব ঘটনা তা নয়। ১৯৯৫-৯৬ পর্যন্ত প্রকৃত মজুরি কিছুটা বাড়লেও তারপরের ১৪ বছর (২০১১-১২) প্রকৃত মজুরি একেবারেই থমকে দাঁড়ায়। অর্থনীতিবিদরা দেখিয়েছেন গত আট বছরে প্রকৃত মজুরির কোনো বৃদ্ধি হয়নি। প্রকৃত মজুরির বৃদ্ধিকে রুখতে কঠোর শ্রম আইন দরকার, যা শিল্প মহলকে আকৃষ্ট করবে এই যুক্তি যে নেহাতই অসাঢ় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

কোভিডের সময়ে একাধিক বিজেপি শাসিত রাজ্য যখন শ্রম কানুনকে আপাদমস্তক সংস্কার করার জন্য উদ্যত হয়, তখন উইপ্রো’র কর্ণধার আজিম প্রেমজি ইকনমিক টাইমসে এক উত্তর সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লেখেন যা হৈচৈ ফেলে দেয় শিল্প মহলে। তিনি বলেন, “বিগত বেশ কয়েক দশক যাবত ভারতের শ্রম কানুনগুলো বদলাতে বদলাতে তার নখ দাঁত হারিয়েছে। এগুলো এখন আর শিল্প মহলের কাছে মাথা ব্যথার কারণ নয়। আবার, সামাজিক সুরক্ষার রক্ষা কবচগুলো এতটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে যে তা অগণন ইনফর্মাল শ্রমিকদের বিপন্নতা অনেক বাড়িয়েছে। ছিঁটেফোটা যে সমস্ত কানুন রয়েছে, তা তুলে দিলে শিল্প ও আর্থিক বিকাশের অনুকূলে তা যাবে না।”

কিন্তু, ক্ষমতাদর্পী অন্ধ ফ্যাসিস্ট রাজ আজ মরিয়া। যে পাথর সে তার মাথার উপর তুলেছে, তাই অচিরে পড়বে নিজের উপর — ইতিহাস বার বার সেই সাক্ষ্য দেয়। অনাগত দিন তারই অপেক্ষায়।

খণ্ড-30
সংখ্যা-13