ইতিহাসবিদ অধ্যাপক রণজিৎ গুহ স্মরণে
professor-ranjit-guha

শতবর্ষ পূরণের কিছুদিন আগে চলে গেলেন বিশ শতকের ইতিহাস চর্চার অন্যতম স্তম্ভ অধ্যাপক রণজিৎ গুহ। অধ্যাপক গুহ এবং তাঁর সঙ্গীরা মিলে “নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চা” নামে যে ইতিহাস রচনার ধারাকে জনপ্রিয় করে তোলেন তার প্রভাব আমাদের দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক দুনিয়াতেও পৌঁছেছিল। নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চা যে নকশালবাড়ির কৃষক আন্দোলনের বিপ্লবী রাজনীতি থেকে তার প্রেরণা সংগ্রহ করেছিল, সেকথা অধ্যাপক রনজিৎ গুহ নিজেই বিভিন্ন সময়ে জানিয়েছেন।

ছাত্র অবস্থা থেকেই বাম এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন রণজিৎ গুহ। প্রেসিডেন্সি কলেজের বিশিষ্ট মার্কসবাদী অধ্যাপক সুশোভন সরকারের অত্যন্ত প্রিয় ছাত্র ছিলেন তিনি। সে সময়েই রণজিৎ গুহ জড়িয়ে পরেন রাজনীতিতে। এম এ পাশ করার পর তিনি অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে কাজ করতে থাকেন। গ্রামে গ্রামে ঘোরেন। জমিদারি শোষণ ও জনযুদ্ধের চরিত্র বিশ্লেষণ করেন। পার্টির কাজ নিয়েই তাঁকে যেতে হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপে। সেখানে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৩ অবধি ছিলেন তিনি। সদ্য বিপ্লবোত্তর চিনকে ১৯৪৯-এ স্বচক্ষে দেখার সুযোগও তাঁর হয়েছিল। দেশে ফিরে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা স্বাধীনতায় নিয়মিত লিখতে থাকেন। তবে ১৯৫৬ সালে স্তালিনের মৃত্যুর তিন বছরের মাথায় ক্রুশ্চেভ ঘোষিত নিস্তালিকীরণের দিনগুলিতে সোভিয়েত রাশিয়া যখন হাঙ্গেরি আক্রমণ করল, সারা বিশ্বের নানা দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী নিজ নিজ দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলো থেকে সেইসময় সরে আসলেন। অধ্যাপক রণজিৎ গুহও ছিলেন তাঁদের মধ্যে। কিছুদিন পড়ান বিদ্যাসাগর কলেজ, চন্দননগর কলেজ ও সদ্য প্রতিষ্ঠিত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপরই তিনি পাকাপাকিভাবে বিদেশে চলে যান।

অধ্যাপক রনজিৎ গুহ আবারো সক্রিয় রাজনীতির দিকে ঝুঁকলেন ৭০ এর দশকে। তিনি নিজেই বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন নকশালবাড়ি আন্দোলন এবং চারু মজুমদার তাঁকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। সিপিআই(এমএল)-এর সঙ্গে বিভিন্ন সূত্রে তাঁর এক নিবিড় সম্পর্কও তৈরি হয়। কথিত কিন্তু অলিপিবদ্ধ সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে তিনি পার্টিকে নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতাও করেছিলেন। গোপন অবস্থায় এই কাজে যথেষ্ট ঝুঁকি ছিল বলাই বাহুল্য। এর নথিপত্র পাওয়াও তাই কঠিন। সিপিআই(এমএল) এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও লিবারেশন পত্রিকার সম্পাদক সুনীতিকুমার ঘোষ বিদ্যাসাগর কলেজে পড়ানোর সময় রণজিৎ গুহর সহকর্মী ছিলেন। এই যোগাযোগ সেই সময় সহায়ক হয়েছিল।

সিপিআই(এমএল) রাজনীতির প্রথম ধারাটি ভেতরের কিছু ভুলভ্রান্তি এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মুখে পড়ে দমিত হল, কিন্তু অধ্যাপক রনজিৎ গুহ এই রাজনীতি থেকেই খুঁজে পেলেন ইতিহাস চর্চার নতুন দৃষ্টিকোণ। তাঁর মনে হল ইতিহাস চর্চা মূলত উচ্চ বর্গর দৃষ্টিকোণ থেকেই লেখা হয়েছে। দরকার নিম্নবর্গের দৃষ্টিতে ইতিহাস লেখা, যা সেভাবে এতাবৎ হয়নি। এই ভাবনা থেকেই নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চা নামক একটি নতুন ধারার জন্ম দিলেন তিনি ও তাঁর সঙ্গীসাথীরা। ইতালির মার্কসবাদী নেতা আন্তোনিও গ্রামশি মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট জমানায় জেলে থাকার সময় যে সব লেখালিখি করেছিলেন সেখানে তিনি বিশেষ প্রয়োজনে শাসকের দৃষ্টিকে আড়াল করার জন্য সাব অল্টার্ন শব্দটি ব্যবহার করেন। কিন্তু সামরিক অধস্থন বোঝানো এই সাব অল্টার্ন শব্দটির ব্যঞ্জনা গ্রামশির লেখায় শুধু প্রলেতারিয়েতের প্রতিশব্দ হিসেবেই সীমিত থাকেনি। এর সঙ্গে নিম্নবর্গের, বিশেষত কৃষকের সাংস্কৃতিক মনন ও মনস্তত্ত্বের দিকটিও যুক্ত হয়ে গেল। এই কাজে অধ্যাপক রণজিৎ গুহর বিশিষ্ট সহকারীদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক পার্থ চট্টোপাধ্যায়, অধ্যাপক গৌতম ভদ্র, অধ্যাপক দীপেশ চক্রবর্তী, অধ্যাপক জ্ঞানেন্দ্র পান্ডে, অধ্যাপক শাহিদ আমিন, অধ্যাপিকা গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক প্রমুখ। নিম্নবর্গের ইতিহাসের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে। ১৯৮৩ সালে হয় সাব অল্টার্ন স্টাডিজের প্রথম সম্মেলন। দু-দশকের মধ্যেই এর দশটি খণ্ড প্রকাশিত হয় আর ছটি সম্মেলনও অনুষ্ঠিত হয়। এতজন ইতিহাসবিদকে নিয়ে এই ধরনের সমবায়ী ও সমন্বয়ী একটা প্রকল্প কীভাবে সাফল্যের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে চালানো সম্ভব হল সেই প্রসঙ্গে তিনি খানিক রসাভাষেই জানিয়েছিলেন যে কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠক হবার পূর্বতন অভিজ্ঞতা তাঁকে এই কাজে সাহায্য করেছে। সাব অল্টার্ন স্টাডিজের প্রথম পাঁচ ছটি খণ্ড বেরনোর পর অবশ্য একটা বড় বাঁকবদল করতে হয়। মূলত গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের তোলা কিছু প্রশ্নকে ধরে। নিম্নবর্গের স্বতন্ত্র চৈতন্য অন্বেষণের সেই সঙ্গত প্রশ্নের পর নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চা মনযোগী হয় ইতিহাসে নিম্নবর্গের নির্মাণের প্রক্রিয়াগুলির বিশ্লেষণে।

অধ্যাপক রণজিৎ গুহর নিজস্ব বইপত্রের দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখতে পাবো সেখানে অধ্যাপক রনজিৎ গুহ ভীষণভাবেই নজর দিয়েছেন কৃষক প্রশ্নের দিকে, জমির অধিকার এবং তার সুষম বণ্টনের দিকে। আমরা সবাই জানি যে কৃষক আন্দোলন এবং জমি আন্দোলন ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলন তথা নকশালবাড়ি আন্দোলনের অন্যতম ভরকেন্দ্র ছিল।

রণজিৎ গুহ স্নাতকোত্তর স্তরে পড়ার সময়েই প্রকাশিত হয়েছিল ফ্লাউড কমিশনের রিপোর্ট। ছয় খণ্ডের সেই বিস্তারিত রিপোর্ট মন দিয়ে পড়েন তিনি। সেখান থেকে উদ্ভূত প্রশ্নগুলি নিয়ে যান তাঁর মাস্টারমশাই নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহের কাছে। সেই সময় প্রশ্নগুলির নিরসন হয়নি। এই প্রশ্নগুলিকে সামনে রেখেই এরপর অনুসন্ধান চালিয়ে যান রণজিৎ গুহ। এর ভিত্তিতে লেখেন ‘এ রুল অফ প্রপার্টি ফর বেঙ্গল’ (চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ভূমিকা নামে বাংলায় প্রকাশিত) নামে একটি ছোট কিন্তু বীজগর্ভ বই। ১৯৬৩ সালে প্যারিস থেকে প্রকাশিত এই বইটিই তাঁর প্রথম বই। বঙ্কিমচন্দ্র যাকে বলেছিলেন ‘আধুনিক বাঙালি সমাজের ভিত্তি’ সেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নির্মাণ কীভাবে হয়েছিল এই বইটিতে অধ্যাপক রণজিৎ গুহ সেইটা দেখান।

সমকালীন ইংলণ্ড যখন সামন্ততন্ত্র ও বাণিজ্য পুঁজিবাদ ভেঙে অবাধ পুঁজিবাদের দিকে এগোচ্ছিল, উপনিবেশের দুনিয়াতে তখন জমিদারি প্রথাকে চিরস্থায়ী করার মাধ্যমে সামন্ততন্ত্রের নক্সাকে আবারো বাংলার বুকে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত করছিল ঔপনিবেশিক শাসক। ম্যাঞ্চেস্টারের বস্ত্রশিল্পের প্রসারের স্বার্থের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছিল বাংলার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে। এই ইতিহাস লিখতে গিয়ে শুধু বাংলা আর ব্রিটেনকে মেলান নি অধ্যাপক গুহ, গোটা দুনিয়ার রাজনীতির জগতে ও চিন্তার দুনিয়ায় যে পালাবদলের পর্ব চলছিল, তাকেও সামনে নিয়ে এসেছেন।

রণজিৎ গুহ দেখিয়েছেন ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিজয়যাত্রা শুরু হলেও ১৭৬৪-র বক্সার যুদ্ধের পর থেকেই এদেশের ভূমি ব্যবস্থার ইতিহাসে বদল আসা শুরু হয়। প্রথম দশ বছরে পুরনো ব্যবস্থার ভাঙনের দিকটিই ছিল প্রধান। স্বাধীন চাষি আর কারিগরদের স্বার্থকে পদদলিত করে কোম্পানি প্রাধান্য দিতে শুরু করল ব্রিটেনে কাঁচামালের রপ্তানি আর শিল্পদ্রব্যের আমদানিকে। চাষি ও কারিগরদের অনেকেই ভূমিহীন গরিবে পরিণত হলেন। ১৭৭৬ সালে একদিকে মার্কিন উপনিবেশ হাতছাড়া হল ও অন্যদিকে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য অধিকারের বিরুদ্ধে মুক্ত বাণিজ্যের পক্ষে লেখা অ্যাডাম স্মিথের ম্যাগনাম ওপাস ‘ওয়েলথ অব নেশনস’ প্রকাশিত হল। রণজিৎ গুহ দেখান একদিকে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার বজায় রাখার জন্য পুরনো সামন্তী শক্তি আর নতুন বুর্জোয়া শক্তি কীভাবে ইংলণ্ডের পার্লামেন্টে নিজেদের মধ্যে বিতর্ক করছে। এই বিতর্কে তখনো অবধি সামন্তীদের রাজনৈতিক শক্তিকে পরাস্ত করা সম্ভব হয়নি। এমনকী তাঁদের থেকে অর্থসাহায্য নিয়েই মুক্ত বাণিজ্যের পক্ষের অনেককে, যেমন ১৭৮৪-র ভারত শাসন আইনের রচয়িতা পিটকে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে হয়েছিল ও মন্ত্রী পদে বসে সাহায্যের হিসেব মিটিয়ে দিতে কোম্পানির আমদানি করা চায়ের ওপর কর হ্রাস করতে হয়েছিল। তবে এতদ সত্ত্বেও ধীরে ধীরে বদল আসছিল। ১৭৭৩ সালের রেগুলেটিং অ্যাক্ট থেকে পিটের ভারত শাসন আইন ১৮৭৪ পর্যন্ত আইনি সংস্কারে এর ছাপ রয়েছে। ভারতের নিয়ন্ত্রণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে থাকবে না ব্রিটিশ রাজের হাতে, তাই নিয়েও অনেক বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। মার্কিন উপনিবেশ হাতছাড়া হওয়া, ইঙ্গ ফরাসি দ্বন্দ্ব সহ নানা আন্তর্জাতিক ঘটনা কীভাবে তাতে প্রভাব ফেলেছিল সেই সবও রণজিৎ গুহ দেখিয়েছেন।

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সামন্তী পুঁজিবাদী দ্বন্দ্বের রেশ এদেশের কোম্পানি শাসনকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল, কোম্পানির বোর্ড অব ডিরেক্টরদের মধ্যে এই সংক্রান্ত চিন্তা ও নীতির দ্বন্দ্ব কী ধরনের ছিল, তার এক বিস্তারিত আলোচনা রণজিৎ গুহ করেছেন। এই আলোচনা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রেক্ষাপটের আখ্যানটিকে আমাদের সামনে স্পষ্ট করে। এই দ্বন্দ্বের একদিকে ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস, অন্যদিকে ছিলেন ফিলিপ ফ্রান্সিস। হেস্টিংস কোম্পানির অধীনেই এদেশের জমির মালিকানা রেখে ইজারাদারদের হাতে রাজস্বের ভার দেওয়ার নীতির পক্ষে ছিলেন। কিন্তু ফিলিপ ফ্রান্সিসের মতো অবাধ পুঁজিবাদের বিকাশের পক্ষের লোকেদের মনে হয়েছিল জমির মালিকানা জমিদারদের হাতেই দিতে হবে। চিরস্থায়ী ভিত্তিতে জমির মালিকানা নিজেদের হাতে পেলে তবেই তারা কৃষির উন্নতির দিকে মনযোগী হবে। কৃষির উন্নতি হলে তবেই দেশের আর্থিক বিকাশ সম্ভব হবে। জমিদারদের ফিলিপ ফ্রান্সিস ও মুক্ত পুঁজির পক্ষে থাকা লোকেরা ধনী কৃষক হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। বড় জমিদারী ভেঙে অনেক বেশি পরিমাণ জমিদার তথা ধনী কৃষক সৃষ্টি করার দিকেও তাঁদের আগ্রহ ছিল। প্রথম পাঁচশালা ব্যবস্থার ব্যর্থতা ও রাজস্ব সংকটের প্রেক্ষিতে হেস্টিংসরাও বুঝতে পারছিলেন ইজারাদারী ব্যবস্থার অসাড়তা। ফলে নতুন এক বন্দোবস্তের দিকে তাঁরাও যেতে চাইছিলেন। জমির অধিকার জমিদার আর রায়তের মধ্যে কীভাবে বণ্টিত হবে এই নিয়ে ফিলিপ ফ্রান্সিস ও হেস্টিংসের মধ্যে স্পষ্ট মতভেদ ছিল। হেস্টিংস ও বারওয়েল চেয়েছিলেন রায়তের সঙ্গে বন্দোবস্ত। কিন্তু রায়ত ও জমিদার উভয়ের অধিকারের মধ্যে ফিলিপ ফ্রান্সিস পুঁজিবাদী কৃষক ও কৃষির বিকাশের স্বার্থে জমিদারের সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তর পক্ষেই দাঁড়ালেন। তবে রায়তের অধিকারের প্রশ্নে তার প্রজাসত্ত্ব ও পাট্টার গুরুত্ব ফ্রান্সিসকে মেনে নিতে হল। রণজিৎ গুহ চিরস্থায়ী ব্যবস্থার সঙ্কট বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখান যে ফ্রান্সিস ভেবেছিলেন কৃষকের তুলনায় অঢেল জমি থাকায় কৃষক শ্রমশক্তি বেচার ক্ষেত্রে সুবিধেজনক অবস্থানে থাকবেন। কিন্তু পরবর্তীকালে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ও জমির ওপর জনসংখ্যার চাপ বৃদ্ধির ফলে পরিস্থিতি উলটে যায় ও নতুন ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ফজলুল হক মন্ত্রীসভা এই পরিপ্রেক্ষিতেই ফ্লাউড কমিশন গঠন করেন ও তার ছয় খণ্ডের বিস্তারিত রিপোর্ট পড়ার পরেই রণজিৎ গুহ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের এই ইতিহাস অনুসন্ধানে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

অধ্যাপক রনজিৎ গুহ যখন ঔপনিবেশিক শাসকের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলনগুলির ইতিহাস এবং সেই ইতিহাসের পেছনে লুকিয়ে থাকা কৃষক চৈতন্য বা মনস্তত্ত্ব নিয়ে ভাবছিলেন তখন আমরা বুঝতে পারি সেখানেও তাঁর কমিউনিস্ট শিকড়, নকশালবাড়ি আন্দোলন এবং চারু মজুমদারের প্রতি তাঁর আগ্রহের প্রভাব পড়েছে। Elementary Aspects of Peasant Insurgency in Colonial Indiaবইটি ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে একটি মাইলস্টোন। এই বইতে মার্কসবাদের প্রচলিত ধারাটিকে মনে রেখেও ভারতীয় কৃষকের চৈতন্যকে বোঝার জন্য কিছু নতুন দৃষ্টিকোণ ব্যবহারের প্রয়োজন বলে রণজিৎ গুহর মনে হয়েছিল। কারণ কৃষকের চেতনায় একইসঙ্গে সংঘাত ও সমন্বয়ের দুই বিপ্রতীপ সূত্র কাজ করে। কীভাবে ইতিহাসবিদ কৃষক চৈতন্যের এই জটিলতাকে ধারণ করবেন তার সমস্যাবলী নিয়ে এই বইতে নানা কথা তুলেছিলেন রণজিৎ গুহ। রণজিৎ গুহর ইংরাজিতে লেখা অন্যান্য বইপত্রের মধ্যে আছে History at the limit of world history, Dominance without Hegemony: History and Power in Colonial India, The Small Voice of History ইত্যাদি।

জীবনের শেষ তিন দশকে রণজিৎ গুহ মূলত লিখেছেন বাংলা ভাষাতেই। ইতিহাসের পরিধি ছাড়িয়ে সাহিত্য, দর্শন, বাঙালি মনীষার অবদানের নানা দিককে ছুঁতে চেয়েছে তাঁর লেখালিখি৷ তিনি মনে করলেন ইতিহাসকে কেবল শুষ্ক দলিল দস্তাবেজ থেকে বোঝার একদেশদর্শিতা থেকে সরতে হবে, সাহিত্যের সাহায্য ইতিহাস বোঝায় অপরিহার্য। রামমোহন, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যেমন লিখলেন, তেমনি লিখলেন জীবনানন্দ বা বিভূতিভূষণকে নিয়ে। বিশ্লেষণ করলেন সমর সেন, শঙ্খ ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসুর মতো তাঁর সমকালীন আধুনিক কবিদের রচনার।

সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ বুদ্ধিজীবী বলতে যা বোঝায় অধ্যাপক রণজিৎ গুহ ছিলেন তাই। অসামান্য মৌলিক চিন্তাশক্তির অধিকারী এক ইতিহাসবিদের পাশাপাশি সেই পরিচয়ও তাঁকে স্মরণীয় করে রাখবে।

- সৌভিক ঘোষাল

খণ্ড-30
সংখ্যা-13