মন কী বাতের পেছনে আছে প্রচারের ধূর্ত কৌশল
behind-man-ki-vaat

আজকের সময়টা কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার, আজকের সময় ইন্টারনেটের, আজকের সময় প্রযুক্তির, কিন্তু তাও আমাদের প্রধানমন্ত্রী মনে করেন, রেডিও হচ্ছে এমন একটা মাধ্যম, যা দিয়ে আরও সরাসরি দেশের প্রান্তিকতম মানুষটির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা যায়। তাই তিনি শুরু করেছিলেন তাঁর ‘মন কী বাত’ অনুষ্ঠান, যা প্রতি মাসের শেষ রবিবার সম্প্রচারিত হয় সকাল ১১টায়। এই অনুষ্ঠনটি আপাতত শততম পর্বে পড়ল। হয়তো অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা একটি পর্বও শোনেননি, কিন্তু তাও কেন্দ্রের শাসকদলের এই অনুষ্ঠান নিয়ে প্রচারে কোনও খামতি রাখতে চাননি। এবার তো ছিল শততম অনুষ্ঠান, তাই এবার প্রচারের মাত্রাও ছিল আরও অনেক বেশি। কেন্দ্রীয় নেতা মন্ত্রীরা একমনে শুনছেন, তাঁদের একমেদ্বিতীয়ম নেতা নরেন্দ্র মোদী কী বলছেন, এই দৃশ্য টিভি চ্যানেল থেকে সামাজিক মাধ্যম সর্বত্র ছড়িয়েছে। যদিও এমন কিছু ছবিও এসেছে, যে আয়োজন করা সত্ত্বেও মানুষকে একত্রিত করে শোনানো যায়নি, কিন্তু তাতে কী, প্রচার এমনভাবে হয়েছে যেন ১৩০ কোটি মানুষ এই বক্তব্য শোনার জন্য মুখিয়ে আছেন।

নরেন্দ্র মোদী ভালো করে জানেন, কেন তিনি এই অনুষ্ঠান করছেন। তিনি তাঁর ভাবমূর্তিকে এমন উচ্চতায় নিয়ে যেতে চান, যে সেখানে তিনি প্রশ্নাতীত এক অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবেন। প্রথমে জানা জরুরি, এই অনুষ্ঠানটিতে কী থাকে, যা শুনে এইরকম মনে হতে পারে? এই অনুষ্ঠানটি আসলে একটি মনোলগ, অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদী একাই কথা বলে যান, নানান বিষয় নিয়ে। কখনো তা তাঁর ছোটবেলার কথা, কীভাবে তিনি দারিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করে বড় হয়েছেন, কীভাবে তাঁর মা, কাঠের আগুনে রান্না করতেন, তাঁদের চোখ দিয়ে জল পড়তো, সেই কষ্টের কথা। কেন কাঠের বা কয়লার উনুনের পরিবর্তে গ্যাসে রান্না করা উচিৎ? সেই জন্যেই সরকারের পক্ষ থেকে উজালা গ্যাসের সংযোগের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কেন ‘স্বচ্ছ ভারত’ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে? কেন প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো জরুরী এইরকম নানান বিষয়। এক একটি পর্বে এক একটি বিষয়। এমনিতে রাজনৈতিক বিষয় নয় কিন্তু সামাজিক বিষয় নিয়েই তিনি কথা বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন এই অনুষ্ঠানে। এই অনুষ্ঠান শুনতে শুনতে একজন শ্রোতাও যদি মনে করেন, এই তো আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী কত কষ্ট করে আজকে এই জায়গায় পৌঁছেছেন, তাঁর জীবনের সঙ্গে তিনি যদি প্রধানমন্ত্রীর নিজের জীবনের তিনি সাদৃশ্য খুঁজে পান তাহলেই নরেন্দ্র মোদীর লাভ। কখনো তিনি হকির যাদুকর ধ্যানচাঁদের কথা বলেন, কখনো তিনি খেলাধুলায় জোর দেওয়ার কথা বলেন, ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার ভয় কাটানোর কথা বলেন, মানুষ প্রভাবিত হতে থাকেন, আর ‘মন কী বাত’ সফল হতে থাকে। হয়তো দেখা যাবে, এই কথার বেশিরভাগই মিথ্যে, হয়তো কেন বেশিরভাগই মিথ্যে, কিন্তু তাঁর বলার ধরনে এমন একটা জাদু আছে, যে সাধারণ মানুষও ধীরে ধীরে প্রভাবিত হতে শুরু করেন।

আসলে তিনি জানেন, কীভাবে মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে হয় এবং কীভাবে মানুষকে প্রভাবিত করতে হয়। মিথ্যেকেও কীভাবে সাজিয়ে বলতে হয়, তা নরেন্দ্র মোদীর থেকে শিখতে হয়। যে সরকার বলে তাঁদের কাছে, দেশে কত পরিযায়ী শ্রমিক কাজ করেন, সে তথ্য নেই, সেই সরকারের প্রধান যদি মন কী বাত অনুষ্ঠানে সেই শ্রমিকদের দুর্দশার কথা বলেন, তখন কি তাকে কুমীরের কান্না ছাড়া আর কিছু বলা চলে? আজকে যে প্রধানমন্ত্রী দামী খাবার খান, দামী গাড়ি চড়েন, দামী বিমান কেনেন, সেই মানুষটির মুখে কি এই ধরনের কথা শোভা পায়? আসলে তিনিও জানেন, তিনি অভিনয় করছেন, তাঁর মধ্যে গরিব মানুষের প্রতি কোনও সহানুভূতি নেই, তিনি এখন আদানি আম্বানির বন্ধু, কিন্তু তাও এই মন কী বাতের মাধ্যমে তিনি একটা সুখানুভূতির প্রভাব বিস্তার করতে চান, যা থাকলে খারাপ বিষয় নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন উঠবে না। তাঁর সঙ্গে আদানির কী সম্পর্ক তা নিয়ে কথা উঠবে না।

আজকের মন কী বাত শুনতে শুনতে, যদি কোনও একজন ব্যক্তিও প্রভাবিত হয়ে যান, তাহলে সেটাই যে শাসকদলের লাভ, তা নরেন্দ্র মোদীও জানেন, বিজেপিও জানে, তাই তাঁরাও নরেন্দ্র মোদীর ভাবমূর্তিকে ব্যবহার করেই এই প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে চলেছেন। যদিও তাঁদের নেতা মন্ত্রীরা বলে থাকেন, এই অনুষ্ঠান রাজনৈতিক নয়, তবুও যা সামাজিক তা তো রাজনৈতিকও বটে। তিনি যখন ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ সংক্রান্ত কথা বলেন তাঁর অনুষ্ঠানে, তিনি নিশ্চিত মহিলাদের সমাজে প্রতিষ্ঠার কথাই বলেন, কিন্তু যখন এই প্রধানমন্ত্রী ভারতীয় মহিলা কুস্তিগিরদের যৌন হেনস্থা বিষয়ে চুপ থাকেন, তখন কী মনে হয় না, তাঁর মন কী বাত আসলে মন কি ঝুট? প্রতিদিন একই মিথ্যে বলে গেলে একদিন সেই মিথ্যেও সত্যি বলে মনে হয়। যদি ইতিহাসে ফেরা যায়, তাহলে দেখা যাবে হিটলারের প্রচার সচিব জোসেফ গোয়েবেলসও এই রকম একটি রেডিও সম্প্রচারের মাধ্যমে ইহুদি নিধনকে মান্যতা দিতেন। আজকে হয়তো নরেন্দ্র মোদী শুধুমাত্র ভালো ভালো কথা বলছেন, আগামীদিনে যে এই মাধ্যমটিই রাওয়ান্ডা রেডিও হয়ে উঠবে না, তা কি জোর দিয়ে বলা যায়? যেভাবে রাওয়ান্ডাতে ঘৃণা ছড়ানো হয়েছিল, সেভাবে যদি এই মন কী বাত অনুষ্ঠানকে ব্যবহার করা হয়, তখন কী হবে? আজকে দেশের নামী দামী চিত্রতারকারা এই অনুষ্ঠানের প্রশংসা করছেন, আগামীদিনে ঐ রকম কোনও ঘটনা ঘটলে তখন পারবেন তো তার বিরোধিতা করতে? যাঁরা আজকে দু’হাত তুলে এই অনুষ্ঠানের প্রশংসা করছেন, তখন বলতে পারবেন তো, এই মন কী বাত আসলে মন কি ঝুট ছিল? তখন মেরুদণ্ড সোজা থাকবে তো?

- সুমন সেনগুপ্ত

খণ্ড-30
সংখ্যা-13